হটল্যান্ড থেকে ফ্রিজল্যান্ড ৪ : অফিসে প্রথম দিন
নেদারল্যান্ডের বারটা প্রদেশের একটা, ফ্রিসল্যান্ডের (Friesland) শহর বোলসওয়ার্ড। এই ফ্রিসল্যান্ড থেকেই আমার এই কাহিনীর শিরোনাম। বোলসওয়ার্ড শহরে যেখানে আমার থাকার ব্যাবস্থা হয়েছে সেটার নাম, অল মেন হুজ। ইংরেজি অল মেন হাউজ। শহরের বিশাল গির্জার পাশে। বোলসওয়ার্ড শহরটা খুবই ছোট ছিমছাম। জনসংখ্যা দশ হাজারেরও কম। এত টিপটপ পরিস্কার যে ছবির মত সুন্দর। রাস্তায় সিগারেটের ছাই ফেলতেও খারাপ লাগত। আরো খারাপ লাগত নিজের শহরের কথা ভেবে। সুন্দর পরিচ্ছন্ন শহর, মানুষের নিরাপদ শান্তিময় জীবন এসব দেখে আমার আসলে মন ভার হত। আমাদের সাথে তুলনায় ওরা যেন বেহেশ্তে আছে।
বোলসওয়ার্ড শহরের প্রধান কেন্দ্র।
শহরের আবাসিক বাড়ি।
এই রাস্তা দিয়ে বড়শিতে জুতা গাথা মূর্তির পাশ দিয়ে প্রতিদিন যেতাম অফিসে।
অল মেন হুজের নীচতলায় রান্নাঘর আর দোতলায় তিন তলায় মিলে চার পাঁচটা রুম। আমার রুম তিন তলায়। আগে থেকেই ইডা বিভিন্ন ফল, ফলের জুস, মাখন, জেলি ইত্যাদি কিনে এনে রেখেছে, যাতে গিয়েই আমাকে খাবার নিয়ে চিন্তা করতে না হয়। আমি তো ইডার উপর মুগ্ধ, চমকৃত, কৃতজ্ঞ। পরবর্তীতে শুধু ইডা নয় সব ডাচবাসীদের প্রতিই এমন ইতিবাচক ধারণা হয়েছে। রাতে ফল ও ফলের রস খেয়ে শুয়ে পড়ি। এবং ঘুমিয়ে যাই।
আমি এসেছি নভেম্বরের শেষে। একেবারে শীতে। তাই ইউরোপের শীত মোকাবেলার প্রস্তুতি দেশ থেকেই নিয়ে এসেছি। শরীরে কয়েক পরতের কাপড় যেমন পায়ে পাতলা স্কিন তার উপর প্যান্ট, গায়ে টি শার্ট > সার্ট > জাম্পার > লেদারের জ্যাকেট। হাতে গ্লাভস মাথায় কান ঢাকা মান্কি ক্যাপ। সকালে অফিসে নিতে এসে অমার এই মূর্তি দেখে কেইস হাসতে হাসতে শেষ। গাড়িতে পাঁচ মিনিটও লাগেনা অফিসে যেতে।
কেইসের ঘোড়াগুলো
কর্নওয়ালিশ ও তার পনি (বর্তমানের ছবি)। ছয় বছর আগে যখন একদমই পিচ্চি ছিল তখনো এটায় চড়তো। একদিন কেইস বলে পিচ্চি ঘোড়া থেকে পড়ে ব্যাথা পেয়েছে।
অফিসে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় কেইস। সাবইকে আগে থেকেই চেনা, যদিও সামনা সামনি দেখা হয় নাই। আড়ং থেকে সবার জন্য মানিব্যাগ নিয়ে গিয়েছিলাম। একটা করে দেই সবাইকে। আর ওরা আমাকে একটা ফাইল দেয়। ফাইলের এক একটা পাতায় এক একজনের ছবি ও আমাকে স্বাগতম জানিয়ে প্রত্যেকের লেখা। তাতে তার পরিচয়, তার কাজ, তার স্ত্রী, পরিবার বা বান্ধবীর কথা। শুভেচ্ছার এই নিদর্শনে আমি আবারো চমৎকৃত।
সেইসব সহকর্মীদের সম্মন্ধে কিছু বলা যাক।
কেইস: তার সম্পর্কে আগে বলেছি । সে এই সফ্টওয়ার কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতা ও এমডি। জাত ব্যাবসায়ী ও কর্ম উদ্যোগি।
এডওয়ার্ড বিটোভেন: লম্বা চুলের রোমান দেবতাদের মত সুদর্শন এডওয়ার্ড আমার সেখানকার ইমিডিয়েট বস। তার অধীনেই তার টেবিলে বসে আমার কাজ করতে হয়েছে। অবিশ্বাস্য রকমের প্রতিভাবান যুবক। এমন মেধাবী প্রোগ্রামার আমি আর দেখিনি। তার সাথে কাজ করতে পারা ছিল আমার জন্য বিরাট সৌভাগ্য। কোনো নতুন জিনিস এত দ্রুত বুঝে ফেলতে পারত বিশ্বাস করা কঠিন। অসম্ভব বলে কোনো কিছু তার অভিধাবে নাই। যত কঠিন সমস্যাই হোক তার কথা করা যাবেনা এমন কিছু নাই। তার সাহচর্যে আমি নিজের সামর্থ্যে বিশ্বাসী হতে শুরু করি। এবং আমিও মনে করি আমার কর্মের ক্ষেত্রে সব কিছুই করা সম্ভব। কলেজে পড়া বান্ধবীকে নিয়ে একসাথে থাকত কাছেই।
ইডা: অফিস সেক্রেটারি। একদিন আফসোস করে বলছিল আমিই এই অফিসের সবচেয়ে বয়স্ক। তার পার্টনার থাকত জার্মানিতে। যে কয়দিন ছিলাম বড় বোনের মত টেক কেয়ার করত।
আরিয়েন: মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া সদা হাসিমুখের তরুন। আমাকে নেদারল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গেছে। বাবা মায়ের সাথে থাকত। বান্ধবীর নাম মিচিল।
ফোলকার্ট: আরিয়েনের বন্ধু, একসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা পড়া করেছে। উদীয়মান মিউজিশিয়ান। তখন বোলসওয়ার্ডের এক ব্যান্ড এ বাজাত।
এডউইন পোলভার্ট: বিশালদেহী পোলভার্ট একটা হাত কৃত্তিম। সেই হাত নিয়েই গাড়ি চালাত প্রচন্ড গতিতে। একা থাকে, মেয়েদের পছন্দ করেনা। কথাবার্তা কম বলত। আমার সাথে খাতির হয়ে যায় দ্রুত কারণ সেই একমাত্র রেগুলার সিগারেট খোর।
বাউকা: অমায়িক, ভদ্র বাউমা এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আছে। তার বউ ইরমাও কাজ করে এখানে।
ইরমা: সপ্তাহে দুইদিন আসত ইরমা। এই দুইদিন বাউকা বাসায় থাকত বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে। তাদের তিনজন ছেলেপেলে।
ফ্রিস্ট সিসওয়ার্দা: মার্কেটিং ম্যানেজার। প্রশ্নের উত্তরে হুম বললে বলত হুম কী বলো ইয়েস অর নো। গল্প করে জমিয়ে রাখত। আমার একটা অনেকদিনের পোষা শখ পূরণ করিয়েছিল সে। আইস স্কেটিং শিখিয়েছিল।
নেইল: সেও দক্ষ প্রোগরামার। দুইদিন কাজ করত আমাস্টার্ডাম তিনদিন বোলসওয়ার্ডে। আমি যে মোটেলে ছিলাম তার দোতালায় থাকত।
আরো কয়েকজন শক্ষানবীশ কাজ করত অফিসে। পরিচয় পর্ব শেষে আমার টেবিলে বসে কাজ করা শুরু। দুপুরে নেইল ও এডওয়ার্ড নিয়ে যায় সুপারস্টোর ইয়াম্বোতে। খাবার কিনি গোল বনরুটি আর কিছু একটা এখন মনে পড়ছেনা। বিকালে মোটেলে পৌছে দেয় কেইস। ওরা গাড়ির পেছনে একটা সাইকেল বাঁধা। আমার জন্য নিয়ে এসেছে। পুরান ঝরঝরে সাইকেল। কাল থেকে এটা চালিয়ে অফিসে যেতে হবে।
চলবে...
ছবি কৃতজ্ঞতা: নেট , লুতফুল্লাহিল বাকি
ফার্স্ট কমেন্ট
বিটোভেন ব্যাটারে নিয়ে যতগুলা লাইন লিখলেন, অন্য সবাইরে নিয়েও তো অতোগুলা লাইন লিখলেন না? ব্যপারটা কি?
এডওয়ার্ড ছিল আমার ওস্তাদ। শিখছি অনেক। আমার প্রফেশনের জন্য ওর কাছে প্রচুর কৃতজ্ঞতা।
না বিষয়টা আমারও ভাল্লাগসে। অসুবিধা নাই। কিন্তু আপনে কি ওই দেশে গিয়ে শুধু কাজই করলেন? অন্য কিছু করেন নাই? খালি তো অফিসের লোক, অফিসের কাজ, অফিসেরই সবকিছু দেখাচ্ছেন। এছাড়া আর কি করসেন বলেন তো।
টেকা খরচ কইরা কাম করাইতে তো নিছে। তাই কামই করছি/ তাছাড়া যেই কাজের জন্য নিছে সেই কাজ কোনোদিন করিনাই আমার জন্য নতুন তাই সময় দিতে হইছে অনেক। মনে ভয় থাকত বেইজ্জতি যাতে না হই। তারপরেো বন্ধের মধ্যে সিনেমা উনেম দেখছি। পরে লেখবোনে ঐসব।
কেইসের ঘোড়ার ছবিটা সবচেয়ে সুন্দর আসছে!
আমার আশেপাশে ঠান্ডায় সব দেখি কি আরামে ঘুরে আধাখালি হালে, খালি আমিই জুবুথুবু কাপড়ের বস্তা হইয়া থাকি!
মীরের কথা সহ্মত জানাইয়া গেলাম!
সহ্মতি জানানোর জন্য আপনাকে প্রচুর পরিমাণে ফ্রেশ
বাংলাদেশে যদি প্রথম দিন অফিস শেষে একটা সাইকেল ধরাইয়া দেওয়া হইতো... তাইলে কিরম হইতো এইটা ভাইবাই ভাল্লাগতাছে
নেদারল্যান্ডস যাইতে মন চায়
(
এইরকম একটা কোম্পানি আপনি বাংলাদেশে স্থাপন করেন। তারপর আমারে আপনার কোম্পানিতে নিয়া যান। আপনার সাথে থাইক্যা আমি শিখমু- এই দুনিয়ায় অসম্ভব বলে কিচ্ছু নাই।
আমার যদি একটা ঘোড়া থাকতো!
ঘোড়ার পিঠে বসা আপনার কোনো ছবি কি আছে? দেখতে চাই।
তারপর দেশে আইসা এই চাকরি ছাড়লেন। কেন? কাহিনী কী
এডওয়ার্ড বিটোভেন রে তো এংগেল থিকা সাঈদ ভাইয়ের মত লাগে দেখতে..
আপনার লেখার ক্যাজুয়াল স্টাইলটা ভালো লাগে
পড়ছি
বাহ্ , ভাল লাগা রেখে গেলাম।
ঘোড়ার পিঠে চড়া আমারও একটা ছবি আছে। ছুটু কালের না এই বুইড়া বয়সের।
চাইর নাম্বার থিকা পড়া শুরু করলাম.. ব্যাকে যাইতাছি
বিদেশের গল্প গড়লে মন খারাপ হয়, অনেক স্মৃতি মনে পইড়া যায়...।
(চাপা)
মন্তব্য করুন