ইউজার লগইন

মধ্যবিত্তের ছবি "দহণ"

মধ্যবিত্ত সমাজ যুদ্ধ করে বাস্তবতার সঙ্গে। পৃথিবীর সমস্ত কঠিন বাস্তবতা যেন তাদের ঘিরেই তৈরী হয়। এক অদৃশ্য দেয়াল ঘিরে থাকে তাদের। তারা না পারে হার মানতে না পারে জয়ী হতে। মধ্যবিত্তরা রয়ে যায় হার-জিতের ঠিক মাঝখানটাতে। ভাগ্য যেন তাদের জালের মধ্যেই রেখে দেয়। এমনই বাস্তবতার; বলতে হয় ঢাকার মধ্যবিত্তদের এমনই টানাপড়নের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে শেখ নিয়ামত আলী রচিত এবং পরিচালিত “দহণ” ছবিটিতে।
ছবিটির শুরুই হয় মুনিরের চোখে আটকানো ঢাকার সদ্য গড়ে ওঠা বড় বড় ইমারত দিয়ে। ষ্পষ্ট, ঢাকায় তৈরী হচ্ছে কালো টাকাওয়ালাদের দেয়াল। যে দেয়ালের তলে চাপা পড়বে মধ্যবিত্তরা। প্রধান চরিত্র মুনির ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে সব। ইট ভাঙছে মহিলা-শিশু। কিংবা মায়ের পাশে শিশু বসে আছে। আবার রিক্সা চালকের উপর ক্ষোভ ঝারছে কোন এক যাত্রি। কারণ খুবই সামান্য। অধিক ভাড়া চাওয়া রিক্সা চালকের একটা অভ্যাস। চালকের উপর চড়াও হয়ে চড়-থাপ্পর ঢাকার রাস্তার এক অহরহ দৃশ্য। সেই দৃশ্যই উঠে এসেছে ছবিটির একদম শুরুতেই। কহিনীর শুরুতেই এতসব দৃশ্যপটের প্রদর্শন দর্শকের কাছে অহেতুক মনে হতেও পারে। তবে এককথায় বলতে হয় পরিচালক ঢাকার অভ্যাসগত বেড়ে ওঠাকেই এখানে প্রধান্য দিয়েছেন।
এবার আসি ছবিটির চরিত্রগুলোর দিকে। কেন্দ্রিয় চরিত্র মুনির শিক্ষিত বেকার যুবক। পরিবারে রয়েছেন বৃদ্ধ মামা। যিনি একসময়ের তুখড় রাজনীতিবিদ। পরিবারের সবচাইতে বৃদ্ধ মানুষগুলো অতীত স্মৃতি একটু বেশী আওড়ান। এবং নিজের সময়ের সাথে বর্তমান সময়ের পার্থক্য তুলে ধরাটাও তাঁদের আচরণের একটি। তাই মুনিরের মামাও তার ব্যতিক্রম নন। তাই তো তিনি বলে উঠেন,
...... আরে বাপু রাজনীতি করবি মানুষের উপকারের জন্য, দেশের জন্য। তা নয়। সবাই করছে নিজের জন্য। ঐ ত্যাগ-ব্যাগ না করলে দেশ সেবা হয় না। বুঝলি রাবেয়া। সততা, নিষ্ঠা-ফিষ্টা মানুষের মধ্যে না থাকলে রাজনীতি হয় না। এই পোড়া দেশে সৎ মানুষের বড় অভাব। .....
সে যাইহোক। মুনিরের মামা ছাড়াও পরিবারে আছে তাঁর মা। এবং ছোট বোন লিনা। অর্থের অভাবে যার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেছে। এবং লিনার ভালোবাসার মানুষের জন্য দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা ছবিটিতে আরেকটি ট্র্যাজেডির তৈরী করে। মুনির একটি টিউশনি করে সংসার বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। কোন কোন দিন সংসারের হাড়িতে ভাত রান্না হয় না। তখন মুড়ি খেয়ে পেটের ক্ষিধাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে তারা। বেকার মুনির ঘরে ফিরে প্রতিদিন মায়ের চিরাচরিত প্রশ্ন, আজ কিছু হলো? এবং মুনিরের সেই একই উত্তর, না, হলো না। এরপর, সংসার রক্ষার চিন্তায় হতাশাগ্রস্থ মা-র ক্ষোভ যেনো সব বেকার ছেলের উপর-ই পড়ে। মুনির ভাবে। চিন্তায় মগ্ন। রাতের বেলায় ছাদ থেকে দেখে পাশ্চাত্য দেশের সংস্কৃতি কিভাবে এদেশে ঢুকে পড়ছে। একটি জেনারেশেনের উপর এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এ নিয়ে একটি লিখাও লেখে মুনির। তবে পত্রিকার সম্পাদকের মানুষ খাবে না সুলভ উত্তর মুনিরকে আবার হতাশায় ডোবায়। লেখার বিষয়বস্তু অত্যন্ত বাস্তবসম্মত। কিন্তু তা মানুষ পড়বে না।
দহণের রোমান্টিসিজম-টা ছিল আরও অসাধারণ। মুনিরের সাথে তার ছাত্রি আইভির চাপানো রোমান্টিকতা ছবিটির মাত্রাটা আরও বাড়িয়ে দেয়। সেই সাথে আইভির সাথে তার কিছু দর্শনের আলোচনা দর্শককে ভাবতেও বাধ্য করবে। যেমন,
“ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষমতার জন্য সমাজে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। এই পার্থক্যের জন্য বিভিন্ন লেভেলের মানুষ একেকটা লেভেলে বিভক্ত হয়ে পড়ে।”
এ যেনো পরিচালকের সামাজিক সিষ্টেমকে ভাঙার এক প্রচেষ্টা। স্পষ্টত হয় মার্কসবাদী চেতনার। যে চেতনা তিনি কৌশলে গুঁজে দিতে চেয়েছেন দর্শকের মস্তিষ্কে। যা হয়ত নতুন চিন্তার উদ্রেক করবে।
বেকার মুনির এক সময় চাকরীর আশা ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় নেমে পড়ে। এবং এখান থেকেই শুরু হয় আরেক হতাশার। আদম ব্যবসার নামে ভন্ড চক্রের সাথে ব্যবসা শুরু করে সে। আর্কিটেক্ট বন্ধুর থেকে ৫০ হাজার টাকা ধার নিয়ে আরেক ভন্ড বন্ধুর সাথে ব্যবসার শুরু করে মুনির। আবার হোঁচট খায় মুনির। হতাশায় ঢুবে অবশেষে বলে, ক্রমাগত নিজের কাছে হেরে যাচ্ছি।
ছবিটির বেশকিছু বিচ্ছিন্ন সিকোয়েন্স দর্শককে মুগ্ধ করবেই। রাজনীতিবিদ বৃদ্ধ মামার বাজেট নিয়ে আলোচনা অনেকটাই বাস্তবসম্মত। হঠাৎ করে মামার ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া। মাথায় সমস্যা ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় অনেকটা উন্মাদ হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান তিনি। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান তিনি। আর বলতে থাকেন, ‘মানুষকে তুমি দাবার গুটি পেয়েছ?’ এ যেনো তিনি শাসকগোষ্ঠির প্রতি কথা বলছেন। তাদের সাবধান করছেন। তিনি সব বোঝেন। এছাড়াও, মামুনের বোন লিনার প্রেমিকার বিশ্বাসঘাতকতা তাঁকে আরও মুষড়ে দেয়। বোনের চোখে পানি দেখে মামুন বলে ওঠে, ‘তোর কান্না দেখলে নিজেকে আর শক্ত রাখতে পারি না।’ এক সময় লিনাও ঘর ছেড়ে চলে যায়। বাস্তবতার সঙ্গে যুদ্ধে হার মানে লিনা। তাই তার নিরুদ্দেশ যাত্রা মামুনকে আবারও পরাজিত করে। সবশেষ ট্র্যাজিডির শিকার হয়, আইভির বিয়ে ঠিক হয় জার্মান প্রবাসী এক যুবকের সঙ্গে। ভালোবাসার চাপা বেদনায় বিপর্যস্ত মামুন যেন ক্রমাগত নিজেকে হারিয়ে ফেলছিল। আঘাত আর আঘাত যেন তার ভেতরটাকে তছনছ করে তুলছিল। আর তাই ছবিটির শেষ অংশ আমাকে মুগ্ধ করে তোলে। কাটা তারের বেড়া ভাঙার এক আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে মামুন। রক্তাক্ত হয় তার হাত। বেদনায় কাতর মামুন ভাঙতে চায় মধ্যবিত্তের শৃঙ্খলকে নাকি তার পরিণতিকে? নাকি দারিদ্রকে? হয়তো সে ভাঙতে চেয়েছে তার নিশ্চিত পরাজয়কে।
ছবিটিতে মামুনের বোন লিনার নিরুদ্দেশ যাত্রার ঘটনা আমার কাছে অনেকটাই অমূলক মনে হয়েছে। বাস্তবতার নির্মমতা থেকে মানুষ কখনও পালাতে পারে না। জীবনের নির্মমতা সামনে থেকে দেখতে হয় মানুষকে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত সমাজকে। আর তা যদি হয় ইট-পাথরে ঘেরা ঢাকার অভ্যন্তরে তবে তা হবে আরও নির্মম গল্পে ঘেরা। জটিল জীবনের জটিল সব হিসেব-নিকেশ মানুষকে কষতেই হবে। মৃত্যুই তাকে নিস্তার দিতে পারে। তবে তা পরাজিত মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই নয়। পরাজয় নিয়ে বেঁচে থাকার পর অন্তত মৃত্যটাকে সার্থক করে তোলা মানুষের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। অথবা, পরাজয়ের পরও জয়ের স্বপ্ন নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া মানুষের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।
দহণ- এ পরিচালক শেখ নিয়ামত আলী খুজেছেন মুক্তির পথ। মানুষের জীবনের সকল ফ্যাক্টসকে তিনি তুলে এনেছেন। আলোচনার শেষ ভাগে দহণে আবৃত্তি করা একটি কবিতা দিয়ে শেষ করতে চাই।
মুখে আমার মৃদু হাসি/ বুকে আমার পুঞ্জিভূত ফুটন্ত লাভা
সিংহের মতো আধো বোঝা চোখে আমি কেবলই দেখেছি
মিথ্যার ভিতে কল্পনার মশলায় গড়া তোমার শহর..........

পোস্টটি ১১ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মীর's picture


আপনার রিভিউ পড়ে ছবিটা আবার দেখতে ইচ্ছে করছে। দারুণ মুভি এবং দারুণ রিভিউ। আপনাকে ধন্যবাদ।

নুশেরা's picture


শেখ নিয়ামত আলীর সূর্য দীঘল বাড়ীর পর দহন ছবিটা আমার ভালো লাগেনি। বয়সানুপাতে বেশী বয়স্ক অভিনেতা-অভিনেত্রী, ববিতা,-প্রবীর মিত্র এদের বিরক্তিকর অভিনয় এসব মিলে। চলচ্চিত্রের ভালোমন্দ জ্ঞান আমার বিশেষ নেই তবে আমরাবন্ধুতেই সম্ভবত কাঁকনের কোন পোস্টে ভাস্করদা বলেছিলেন, গল্প বলার স্টাইলটা ইউরোপিয়ান চলচ্চিত্রের, যেটা মানানস্ই হয়নি আমাদের প্রেক্ষাপটে (হুবহু মনে নেই)

তানবীরা's picture


ছবিটা ভালো লেগেছিল। অনেক গবাজবা ছবির ভিড়ে আশা জাগিয়ে ছিলো মনে

শওকত মাসুম's picture


নুশেরার বক্তব্যে তীব্র নিন্দা জানাই। X(। ববিতা ছিল মুভিটায় এইটাই তো যথেষ্ট। :\
ছবিটায় অনেক বক্তব্য রাখতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন পরিচালক। ছবিটাকে বলা যায় গুড ট্রাই।
তবে ববিতা থাকাটাই ছবিটার জন্য যথেষ্ট Smile

তানবীরা's picture


তবে ববিতা থাকাটাই ছবিটার জন্য যথেষ্ট

এটা ঠিক মাসুম ভাই, সে সময় ববি খালাম্মার যা ওজন ছিল, একলা ওনিই যথেষ্ট ছিলেন Wink

শওকত মাসুম's picture


ওজন যাই হোক, ববিতা ববিতাই। Smile

সাঈদ's picture


একমত ।

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.