মৃত্যুর গল্প
মৃত্যু একদম সহ্য করতে পারি না। কেউ মারা গেছে শুনলেই আমি দূরে ভাগি। কারণ মৃত্যুকে বড্ড ভয় হয়। একটা অন্ধকার জগতে থাকাটাকে ভয় পাই না। ভয় পাই একা হয়ে যেতে হবে এই ভেবে।
তারপরও মৃত্যু দেখতে হয়েছে। দাদুকে যেদিন শুয়ে থাকতে দেখেছি সেদিন ভয়ে সারা শরীরটা ঝিম ধরে ছিল।
দাদুকে যখন কবরে নামানো হচ্ছিল তখন ভয়ে আমার শরীর কাপছিল। সেই দিনই একটা মানুষকে কবর দেয়া দেখি। মাটির ঘর। বাশের ছাউনি। তার ভেতর দাদুকে শুইয়ে দেয়া হলো। মাটি চাপা দিল। আব্বুর চোখের পানি সেই প্রথম দেখি। নিজ মা'কে এভাবে মাটিতে শুইয়ে দেয়া পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন কাজ।
তারপর নানুকেও দেখি।
এক মামা ছিল। আমার চেয়ে দুইতিন বছরের বড় হবে। সেই মামাকেও দেখি। নিথর দেহটা পড়ে আছে। মিষ্টি হাসি মুখে। মনে হচ্ছে ঘুমাচ্ছে। অথচ সেই মামার সাথে তার মৃত্যুর দুই মাস আগেও দেখা হয়েছিল ধানমন্ডিতে। মামা রিক্সা থেকে নেমে আমার সাথে কথা বলল। তার কিছুদিন পরই শুনি মামার দুটি কিডনি নষ্ট। তারপর একদিন ঘুম থেকে উঠে শুনি মামা নেই। এমন হুট করে মানুষ চলে যায় কীভাবে? হুট করে মানুষের দেহ কীভাবে রোগের নিচে চাপা পড়ে?
১।
আমার বন্ধুর অভাব নেই। এতো বন্ধুর মাঝেও সেরা থাকে। কাছের বন্ধু থাকে। যে বন্ধুর কাছে লুকানোর মতো কিছু থাকে না। বন্ধুত্ব যেটাকে বলে। তেমনই বন্ধু তুহিন।
এক সময় আমার সেকেন্ড হোম ছিল তুহিনের বাসা। সারাদিন স্কুলের ক্লাস শেষ করে চলে যেতাম তুহিনের বাসায়। সেখানে তুহিসের মা আমার জন্য রান্না করতো। তুহিনের ছোট বোন রুমা আপা আমাকে ভাত বেড়ে খাইয়ে দিতো। এমন আদর; যেনো আমি সে ঘরেরই সন্তান। আন্টি আমার সাথে গল্প করতো। নানান গল্প।
স্কুল শেষ হলে কলেজ। কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়।
কিন্তু আর যে তুহিনের বাসায় যাওয়া হয়নি। দেখাও হয়নি আন্টির সাথে। হজ্বে যাবে আন্টি। তখন তুহিন বাসায় এসে আমার মায়ের সাথে দেখা করে গেলো। কিন্তু আমি অকৃতজ্ঞ। যাইনি। আন্টির কাছে দোয়াটাও নিতে যাইনি।
আমি বড় স্বার্থপর। তুহিনের বিয়েতেও যেতে পারিনি। অফিসের কাজে ছিলাম সিলেট। সেখানেও দায়িত্বের কাছে আমি পরাজিত। শেষমেষ তুহিনের বড় ভাই শাহীন ভাইয়ের বিয়েতে গেলাম। আন্টি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল- তোমাকে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াইতাম! ভুলে গেলা কেমনে তুমি?
লজ্জায় আমার মাথাটা নুয়ে যাচ্ছিল। অপরাধীর মতো দাড়িয়ে ছিলাম। কিচ্ছু বলার নাই। কী বলব? সত্যিই তো। ভুলে গেলাম।
এইতো দুই সপ্তাহ আগে বছর চারেক পর গেলাম তুহিনের বাসায়। তুহিনেরও অক্ষেপ ছিল। প্রায়ই বলত- এক বছর সংসার জীবন হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তুই একদিনও আমার সংসারটা দেখতে আসলি না।
তুহিনের বাসায় গেলাম। আন্টির হাতের রান্না খাবো সেটাও ফোনে জানালাম।
গেলাম। তুহিনের সংসার দেখলাম। আন্টির হাতের রান্না খেলাম। আন্টির সাথে গল্প করলাম। আমার বিয়ে প্রসঙ্গে কথা হলো। আন্টির আবার হজ্বে যাবে। সেইটা নিয়েও কথা হলো। অতীতের অনেক কিছু নিয়ে আন্টি আমার সাথে গল্প করলো।
দুই সপ্তাহ কী খুব বেশী দূরে? খুব বেশী তো নয়।
অথচ গতকাল ২৯ মে বেলা ১২টায় হুট করে ফোনে শুনতে পেলাম আন্টি নেই।
কী করবো? কী করা উচিত? কীভাবে জানাজাটা ধরবো?
চাকরির কিছু কাজ গোছাতে গোছাতে সময় গড়িয়ে গেলো কিছুক্ষণ। তারপর রওনা দিলাম। রওনা দিয়ে পৌছাতে সময় লাগলো বিকাল ৪টা। আমি আবারও প্রমাণ করলাম আমি একজন স্বার্থপর। জানাজাটাও ধরতে পারলাম না।
২.
স্কুলের অনেক দুষ্টুমির গল্প বেশ কয়েকবারই আমি করেছি বিভিন্ন সময়। শুধুমাত্র ফারহানা আপুর গল্প হয়নি কখনো। ফারহানা আপু আমাদের বড় বোন ছিল। তুহিন আর আমাকে অনেক আদর করতো। হারম্যান মাইনর স্কুলে পড়তো তখন। আমরা যখন এইটে তখন আপু মনে হয় কলেজে। এমনই হবে। মনে নেই তেমন।
আপুর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় আপুর জন্মদিনে। আপু আমাদের হট-হাটে খাইয়েছিল। সেই প্রথম কোন ফাস্ট ফুডের দোকানে আমি খাই। অল্প বয়স। আমরা তো আর এখনকার পোলাপানের মতো এতো ফাস্ট ফুড ম্যানিয়ায় স্কুল থেকেই ভুগতাম না।
যাইহোক। ফারহানা আপু ছিল আমাদের ফ্রাস্টেশনের গল্প শোনার সাথি। মনে সব ব্যথা নিয়ে ফারহানা আপুর সাথে গল্প করতাম। মন খারাপ মানেই ফারহানা আপুকে ফোন দাও। আপু একটা সাজেশান দিবে। হাসাবে। মন ভালো হয়ে যাবে।
আপু ছিল বাবার আদরের একমাত্র মেয়ে। মিরপুরে বাসা। একবার আপুর সাথে দেখা করতে গেলাম। আপু রিক্সা নিয়ে মিরপুর ক্যান্টনমেন্টের ভেতর ভুল পরিচয় দিয়ে ঢুকে গেলো। রিক্সা চালক ভয়ে শেষ। আমিও ভয় পাচ্ছি।
আপু বলছে- কীরে বল্টু ভয় পাচ্ছিস? (আপু আমাকে বল্টু বলে ডাকতো। এইটা শিখেছে আমার স্কুল বন্ধুদের কাছ থেকে।)
আমি বললাম- পাচ্ছি তো আপু্। যদি ধরে ফেলে।
আপু বলছে- ধরলে বেশী কিছু হবে না। তোর বাসায় কল যাবে। আমার বাসায় কল যাবে। মা-বাপ ছাড়া ছাড়বে না।
আমি তো হা। বলেন কী? আমার মা তো আমাকে মেরেই ফেলবে।
আপু হাসে আর বলে- চিন্তা করিস না। খালি তুই মরবি না। সাথে আমাকেও মেরে ফেলবে।
সে যাত্রায় কাউকেই মরতে হয়নি। ধরা আমরা খাইনি। আরামসে পুরো মিরপুরের দিকের ক্যান্টনমেন্ট ঘুরে বেড়িয়েছি।
আপু মাঝে মাঝে খুব আপসেট থাকতো। কিন্তু কোনো দিনই বলেনি কেন উনি আপসেট।
যাইহোক। আমি তো স্বার্থপর। আস্তে আস্তে আমাদের সবার সাথে যোগাযোগ কমে গেলো। যোগাযোগ কমতে কমতে একদিন বন্ধই হয়ে গেলো। জীবনের ব্যস্ততার কাছে সম্পর্ক কীভাবে টিকবে? সেটাই হলো। যে যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত।
তবে মাঝে মাঝে মনে হতো- ফারহানা আপুর খবর নেই। একটু কথা বলি। কিন্তু মনে না হতেই আবার ভুলে যাই।
আপুর অভিমান ছিল। আমি যোগাযোগ করি না।
বহু বছর পর ২০১০-এ এসে আমাকে ফেসবুকে অ্যাড করলো। সেদিন চেটিং হলো। অনেকক্ষণ। শুরুটাই ছিল- তুই একটা হারামি। স্বার্থপর। একটা খোজ নেসনা। অথচ তুহিন ঠিকই আমার খবর রাখে।
আমি লজ্জিত হই। আসলেই সম্পর্ক রক্ষার কাছে আমি বরাবরই তুহিনের কাছে হেরে যাই। আপুকে বলি- আপু তোমার মোবাইল নম্বরটা দাও।
আপু বলে- কেন? কোনো দরকার নাই।
আমি বললাম- আপু বিয়ে করেছ?
আপু বলে- হ্যা। বেশীদিন হয়নি। মাস খানেক।
আমি আবার বলি- আপু তুমি কী হ্যাপি?
আপু বলে- অনে---ক হ্যাপী।
বহু বছর পর এই প্রথম এবং এই শেষ কথা। তাও চ্যাটিং।
গতকাল তুহিনের মা মারা গেলেন।
তুহিন সম্পর্ক রক্ষা করে আর সেই রক্ষার্থেই ফারহানা আপুকে ফোন দিলো। ফোন দিয়ে শুনে ফারহানা আপু রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছেন সেই অক্টোবরে।
তুহিন এইবার সম্পর্ক রক্ষায় ব্যর্থ হলো। এতোদিন হয়ে গেলো একটা মানুষ চলে গেছে। এতো কাছের একটা মানুষ। অথচ আমরা কেউ জানলাম না। আমরা এতই স্বার্থপর। আমরা এতোই ব্যস্ত।
ব্যস্ততার কাছে সত্যিকার ভাবেই পরিজিত হলো সম্পর্ক।
-----------------------
এতো কাছের মানুষগুলো চলে যাওয়া হয়তো শুরু হলো। একদিন আমি যাবো একদিন আমার বন্ধু যাবে। কিংবা কাছের কেউ যাবে। এইভাবে মৃত্যুর গল্প বলা শুরু হয়ে গেলো।
ফারহানা আপুর চলে যাওয়া আমি কোনভাবেই মেনে নিতে পারছি না। কোন ভাবেই না।
কী করে সম্ভব? একটা মানুষ কীভাবে মৃত্যুর দিকে এভাবে হুট করে ছুটে যায়? কীভাবে?
আজকাল আমরা সবাই স্বার্থপর এবং প্রতিদিনই যেন সেটা আরও বাড়ছে ।
নিজের মৃত্যু চিন্তা আসলে ভাবি, আমার লাশটাই যাতে খুঁজে পাওয়া না যায় । তাতে জানাজার ঝামেলা থাকবে না, লাশ দেখতে এসে কেউ কৌশলে তাড়াতাড়ি জানাজার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করবে না, আড়চোখে ঘড়ি দেখবে না .......
~
ভালো বলেছেন।
একেকটি মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া মানে এক লাফে বয়স একশ বছর বেড়ে যাওয়া - একদিন তোমাকে বলেছিলাম, মনে আছে? মৃত্যুই চূড়ান্ত সত্য, আর কিছু নয়, তবু আমরা সেটা ভুলে থাকি, ভুলে না থাকলে জীবন-যাপনই সম্ভব নয়; আর তাই মাঝে মাঝে মৃত্যু নিজেই আসে মনে করিয়ে দিতে, আমাদের অভিজ্ঞতা আর বয়স বাড়িয়ে দিতে...
মনে আছে স্যার।
বয়স কেনো বাড়বে? এমন বাস্তবতা ভালো লাগে না।
কষ্ট হয়। যতবার আমি এখান থেকে বের হতে চাচ্ছি ততবার আমি জড়িয়ে যাচ্ছি।
দারুণ বলেছেন কামাল ভাই।
হুম...
এরকম একটা পোস্ট আমারও লিখতে হবে। কিন্তু লেখা আগায় না। তীব্র মনখারাপ লেখাটাকে এগিয়ে নিয়ে যায় না।
লিখে ফেলেন মাসুম ভাই।
দেখবেন মন হালকা হয়ে গেছে...
এসব পোস্ট পড়লে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। এই সকালবেলায় হলো
মনটা খারাপ হয়ে গেল।
নিজের জন্য চিন্তা করিনা.... ....কাছের মানুষদের জন্য অনেক অনেক কষ্ট হয়
( , কষ্টের পাহাড়ে চাপা পড়ছে আনন্দ........কিছুই ভালো লাগেনা।
এসব পোস্ট পড়লে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়।
মন্তব্য করুন