হেথাক তুকে মানাইছে নারে, ইক্কেবারে মানাইছে নারে...(শেষ পর্ব)
এক.
ভোরে একবার চোখ বন্ধ করছিলাম। সম্ভবতঃ ক্লান্তি আর অবসাদ ছিলো। চোখ খুলতে দেখি প্রায় ঘন্টা খানেক ঘুমাইছি। আজকে চইলা যাইতে হইবো ভাবতেই কেরম অস্বস্তি লাগতেছিলো। গতোকাল পরিচিত সবার কাছ থেইকা এরমধ্যেই বিদায় নেয়া হইয়া গেছে যদিও বাসের টিকিট কাটা হয় নাই, মনে হয় অবচেতনে প্রত্যাশা করতেছিলাম আজকে কোন বাসেই আমার জায়গা না হোক। সুধাকরদা ফোন দিলেন এমন সময়, সকাল ১০টায় বাস আছে জানাইলেন। তিনি নিজের গরজেই বাস কাউন্টারে ফোন কইরা বইলা রাখছেন আমার কথা। ঘড়িতে সময় দেখলাম প্রায় ৯টা। তারমানে আমার এখন এক্সপ্রেস গতিতে সব প্রাতকৃত এবং স্নান সারতে হইবো।
আমার জন্য যেইটা নরমাল গতি সেইটাই হয়তো অন্য সবার জন্য তাৎক্ষণিক। ঠিক ১৫ মিনিটে তৈরী হইয়া গেলাম। তারপর আর কিছু না ভাইবা রওনা দিলাম শহরের প্রান্তে অবস্থিত বাস কাউন্টারে। যাইতে ১০ মিনিট লাগলো। টমটম থেইকা নামনের পর কেরম খচখচ করাতে আশপাশে তাকাইয়া দেখি পরিচিত দুইজন আমার সাথে চইলা আসছে। বাংলাদেশি একজন নাগরিক হিসাবে স্বাধীনভাবে চলার অধিকার নাই আমারও এই অঞ্চলে। দূর থেইকা তারা আড়চোখে কখনো সোজাচোখেই আমারে দেখে। বাস ছাড়তে যতক্ষণ দেরী হইলো ততক্ষণেও তাগো নড়তে দেখলাম না। বেশ রোমাঞ্চ বোধ হইলো। এর আগে কখনো এইরম পরিস্থিতিতে পরি নাই। নিজেরে রীতিমতোন বিপ্লবী মনে হইলো, রাষ্ট্রযন্ত্র যার ভয়ে কাতর...
দুই.
পাহাড়ি পথ ধইরা বাস রওনা দিলো শহুরে জনপদে। আমি নিরাপদ বোধ করতে শুরু করলাম হয়তো। পেছনে দুইজোড়া চোখের অনুসরণ নিয়া আসলে খুব স্বস্তিবোধ হয় না। আমার মনে পইড়া গেলো সঞ্জীবদার কথা তিনি কিছুতেই আমার সাথে একমত হন নাই, তার বক্তব্য এই অঞ্চলে সেনাশাসনই চলে। খাগড়াছড়ির আইন তৈরী করে সেনা কর্মকর্তারা। সুধাসিন্ধু বাবু যেইটারে বলতেছিলেন জেনারেল টু ইন্টেলিজেন্সের শাসন। আমি যতোই বলতেছিলাম রাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া কিভাবে একটা এলাকায় সেনাবাহিনী তার নিজের অবস্থানরে জায়েজ করে...তারা সবাই প্রায় একভাবে বলতেছিলেন, আপনি সমতলের বাঙালি, আপনি খাগড়াছড়ির বাস্তবতা কিভাবে বুঝবেন। মিথুনতো তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মাহবুবুর রহমানরে স্মরণ করলো। সে নাকি চূক্তির সময়কালেই পার্বত্য এলাকার কোনো এক সুধী সমাবেশে স্পষ্টভাবেই বলছিলো যে সেনাবাহিনীরে পাশ কাটাইয়া পার্বত্য এলাকায় যেই চূক্তি হইছে, সেইটার আসলে কোনো ভিত্তি থাকতে পারে না।
আমার কল্লোলদার কথা মনে পড়ে, যুদ্ধবিক্ষুব্ধ এই জনপদে সে একসময় অস্ত্র হাতে লড়ছে। সেই চায়ের দোকানে আমি তারে একবারের জন্যও বাইরে তাকানো ছাড়া কথা বলতে দেখি নাই। এখনো সে যেনো আশংকা নিয়া থাকে যেকোনো সময়ে আবারো আক্রমণ আসতে পারে। নিজের এলাকাতেও নিরাপত্তার কোন নিশ্চয়তা নাই তার। অন্যদিকে সরকার ভোটযুদ্ধে পার্বত্য সমস্যার সমাধানের কৃতিত্ব দাবী কইরা বিশাল ফর্দ তৈরী করে। শেখ হাসিনা এই চূক্তির বরাতে বিদেশি ডিগ্রী ধারী হইতে পারেন। যেইসব বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় তারে সম্মাননা দিছিলো তারা কোন সূত্রে তাগো মূল্যায়ণ করছে কে জানে। পাহাড়ি নেতারা বারবার আমারে একটা কথা শুনাইতে চাইছে। একটা বিরাট দেশ ইংল্যান্ড যদি অলিখিত সংবিধানে পরিচালিত হইতে পারে। শেখ হাসিনা কেমনে তার প্রতিশ্রুতিগুলি বিস্মৃতত হইছেন। আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ কিম্বা আতাউর রহমান কায়সার তখন বলছিলেন রাজনৈতিক কারনে অনেক কিছু চূক্তিতে লেখা যাবে না। কিন্তু অলিখিতভাবেই তারা সেইসব বাস্তবায়ন করবেন। কোথায় সেইসব প্রতি্শ্রুতির সায়র!
সুধাসিন্ধু খীসার চোখে জল চইলা আসছিলো, যখন তিনি বলতেছিলেন, বিশ্বাস ছাড়া মানুষের আর কি থাকে। বিশ্বাস হারাইলেতো মানুষ আর সামাজিক জীব থাকে না। আমি সুধাসিন্ধু বাবুরে পাল্টা প্রশ্ন করছিলাম, এতোদিন ধইরা রাজনীতি করলেন আর এই সাধারণ বিষয়টা আপনেগো মাথায় আসলো না! সমতলের রাজনীতিবিদেরা জানে আমরা যারা বাঙালি তারা কৌমকেন্দ্রীক ভাবতেই জানি না। আমরা অনেক আগেই দীক্ষা নিছি ব্যক্তির স্বাধীনতা নামক পশ্চিমা মতবাদে। তারা সেইখানে এমন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের রাজনীতির চর্চাই করতেছেন স্বাধীনতার পর থেইকা। মানবেন্দ্র লারমারে নাইলে কোন সাহসে শেখ মুজিবর কইছিলেন বাঙালি হইয়া যাইতে!? সুধাসিন্ধু খীসা ভেজা চোখেই মুখ তুইলা, আমার চোখে চোখ রাইখা যখন উত্তর দিলেন, আপনারা বাঙালিরা সব বিশ্বাসঘাতক! আপনারা পাহাড়ি মানুষের সরলতার সাথে প্রতারণা করে আমাদের শোষণ করতে চান। আমি তার পালটা জবাব দেওনের কোনো পথ খুঁইজা পাই নাই।
তিন.
মেঘলা দিনের বাতাসে আমার ঘুম চইলা আসছিলো। ঘুম ভাঙলো কেউ একজন কাঁধে হাত দিয়া ঝাকুনি দেওয়াতে। তাকাইয়া দেখি বাস থাইমা আছে। আমারে ধাক্কা দিতেছে একজন সেনাসদস্য। তারা আমার গা হাত পা চেক করলো তন্ন তন্ন কইরা। তারপর ব্যাগ খুলাইলো, ব্যাগের ভিতর আমার ছোট রেকর্ডার। ক্যামেরা। কোনো কথা না বইলা রেকর্ডার থেইকা মিনি টেইপটা বাইর কইরা নিয়া নিলো। আমি চূপ কইরা তাকাইয়া তাকাইয়া দেখলাম। আমার মুখে কোন কথা আসলো না তাগো কাজকর্ম দেইখা। তারাও আমারে কিছু কওনের প্রয়োজন বোধ করলো না আর গট গট কইরা নাইমা গেলো। বাসের অন্যসব যাত্রী আমার দিকে তাকাইয়া আছে। ভয়ে কেউ কোনো কথা কইতেছে না। হতভম্ব আমি যদিও খুব বেশি বিব্রত হই নাই, কারণ আরেকটা টেইপ বাঁইচা গেছে। ঐ টা জামা কাপড়ের সাথে ছিলো। আর এই টেইপটা ভরা ছিলো রেকর্ডারে ট্রান্সক্রিপ্ট করতেছিলাম বইলাই। মোটামুটি বেসিক কথাবার্তাগুলি লেখা হইয়া গেছিলো।
যা গেছে সেইটার চিন্তায় না থেইকা আমি আবারো ঘুম দিলাম। ঘুমে ঘুমেই শহরে ঢুকলো বাস। আমি আধো ঘুমে দৌড়াইয়া একটা সিএনজি নিলাম। শহরের জটিলতারে কেরম অসহ্য লাগতেছিলো। বাসায় ফিরা আবারো ঘুম দিমু...এই শহরে থাকতে হইলে তো জাইগা জাইগাই ঘুমাইতে হয়...কোথায় কি ঘটে তারে উদাসীনতায় উপেক্ষা করতে না শিখলে আমরা কীসের শহুইরা!
দেশের ভেতর অন্য দেশ...বিনা কথাবার্তায় টেপ রেকর্ডার নিয়া গেল!
কোথায় কি ঘটে তারে উদাসীনতায় উপেক্ষা করতে না শিখলে আমরা কীসের শহুইরা!
যেইভাবে পাহাড় চলছে সেইভাবে চলতে থাকলে একদিন না একদিন আমাদের ওখানে ভিসা নিয়ে যেতে হবে।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ টপ ক্লাস একটা ভ্রমন কাহিনী আমাদের পড়ার সুযোগ দেয়ার জন্য। যেইটা পড়ার সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায় না। মগজের ভিতর আন্দোলন করেই চলে।
ভালো। কৃতজ্ঞতা জানাইলাম।
পুরাটা পড়লাম ............
কিচ্ছু কওয়ার নাই।
দুর্দান্ত।
লেখাটা মারাত্মক..।পড়ার পর ..।
ধন্যবাদ সবাইকে পড়ার এবং উৎসাহসূচক মন্তব্যের জন্য...
একেবারে অন্য রখম অসাধন লেখা। এই পর্ব পরেই অন্য পর্বগুলি পড়ার আগ্রহ তৈরি হল। একটূ ঘুরে আসি সেই পর্বগুলি।
সামুতে আপনাকে অনুরোধ করেসিলাম লিখতে। আপনি লিখছেন অথচ পড়ি নাই... মনটা খুব বিষনন লাগছে।
যা হোক একটানে সবটুকু পড়লাম। লেখাটা যেমন ভালো লাগলো তেমনি মনটাও খারাপ হল।
যাই অন্য গুলো পড়ে আসি।
ভালো থাকুন।
আপনার শেষ এই সিরিজটা পরশুদিন প্রায় ১ ঘন্টা সময় নিয়ে লাইন বাই লাইন কয়েকবার পড়ে বুঝার চেষ্টা করলাম বাংলাদেশের ওইদিকটাতে এই রকম কেন হচ্ছে ? স্বাধীন একটা দেশের নাগরিকরা এই রকম ভাবে জীবন যাপন করবে কেন ? আপনার পিছেই বা এই রকম টিকটিকি লাগানোর মানে কি !!! জলপাই লোকজন কি সাধারন একজন নাগরিককেও ভয় পাচ্ছে নাকি ? তবে তাদের ব্যাবহার দেখে মনে হচ্ছে সেইখানে তারা নিজেদের সরকার মনে করে । আপনার ব্যাগ যেইভাবে চেক করে আপনার মিনি টেপটা নিয়ে গেল তাতেতো মনে হচ্ছে এইটা ৭১ এর আগের সময়কার ব্যাবহার ।
খাবার খাইছেন ভাল কথা তাই বলে এইরাম লোভনীয় বর্ননা দিলেন কেনু ? রাত-বিরাইতে এইরাম খাবার পামু কই ?
হারাইয়া যাওয়া ভাস্করদারে অনেক দিন পরে খুঁজে পেলাম... এরকম অন্য কোন লেখার অপেক্ষায়...
~
আপনার সিরিজটা পড়ে শেষ করলাম। দুর্দান্ত একটা কাজ হয়েছে!
প্রয়োজন মনে করছি বিধায় আমার এই দুইটা পোস্টে আপনার লেখার লিংক দিয়ে দিলাম:
দেশপ্রেমিক (!)
আদিমানুষ: পড়ো, শক্তিমানের নামে
আরেকটা বিষয়, আপনার এই সিরিজের একটা পোস্টের সঙ্গে অন্য পোস্টের লিংক দিলে ভাল হয়, তাহলে একজন শেষ পোস্ট পড়া শুরু করলে সূত্র ধরে আগের পোস্টগুলো পড়তে পারবেন।
ধন্যবাদ দিয়ে খাটো করি না। আপনার যদি ব্লেসিং-এ বিশ্বাস থাকে তাহলে এই অসহায় মানুষগুলোর ব্লেসিং আপনাকে অবশ্যই তাড়া করবে...।
ভাল থাকুন, অনেক।
মন্তব্য করুন