দিন প্রতিদিন বইমেলায়-- (২)
আমাদের জীবনে কত কি ঘটে, দেশে দুর্যোগ দুর্বিপাক কত কি ঘটে যায় প্রতিনিয়ত তাও মানুষ উৎসব করে আনন্দ ফুর্তি করে। কিন্তু এখন দেশে যা অবস্থা সামান্য হাসতে গেলেও, অন্তরে গিয়ে এক বেদনাই জমে উঠে। আমরা হো হো হাহা করছি, আর সমগ্র দেশজুড়ে কত কান্না হল্লাহাটি দুঃখের গল্প। নিউজপেপার তো পড়ি না, সকাল বেলা যখন এক বন্ধুর মুখে শুনলাম সাতজন নিহত হবার খবর। তখন কিছুদিন আগে আমার নিজের বাসযাত্রার কথা মনে পড়লো। কি আর বলবো, সেই কুমিল্লা থেকেই উঠেছি, সন্ধ্যার সময়। প্রায় অন্ধকার সব কিছু ভুলে আমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে। জীবনকে আমার কাছে খুব প্রেশাস কিছু মনে হয় না, কাটাতে হয় কাটাচ্ছি। যদি এভাবেই মরি, মরলাম। কিন্তু বাকী সবাই তো জীবনকে অনেক দামী মনে করে। তাঁদেরকে টপটপ করে আগুনে পুড়িয়ে মারলো, কতজনকে আশিভাগ পুড়িয়ে নির্মম বেঁচে থাকা উপহার দিলো, এ কেমন রাজনীতি তা আমার জানা নাই। মাঝেমধ্যে চুলায় কলসীতে পানি সিদ্ধ দেই। পিসিতে বসলে মনে থাকে না। তাড়াহুরা করে যাই গ্যাস নেভাতে। পানি মাঝে মাঝে পায়ে ছিটে আসে, মনে হয় পুরো শরীরে একটা শক খেলাম। সামান্য গরম পানিতে আমার এই দশা। তাহলে গরম আগুনে পুড়ে যারা বেঁচে থাকে কিংবা মরে কি চরম কষ্ট পায় তা আসলে আমরা বুঝবো না। ছোটবেলায় ইসলামী বই পুস্তকে পেতাম-- দোযখের আগুন ৭০ গুন বেশী তাপের হবে দুনিয়ার চেয়ে, আমি চাই প্রত্যেকটা পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ কারী, হুকুমদাতা সহ জড়িত সবার ইহকালেই দোযখের আগুন লাগবে না এই আগুনেই পুড়ে মরুক। সবাই বলে দুনিয়ায় নাকি মানুষ খারাপ কাজ করলে দুনিয়াতেই বিচার হয়, এদের এত পাপ তাও বাংলাদেশ ধসে যায় না কেন? দুনিয়া মনে হয় ঈশ্বরহীন হয়ে পড়লো।
দিন শেষে এইটা সরকারের ব্যর্থতা ও সরকারও এইসব ঘটনার একধরনের বেনিফিসিয়ারী। হোক প্রতিবাদের গুষ্টি কিলাই। #হোকবিচার কিংবা #হোক #নির্বাচন! শুয়োরের বাচ্চা বিএনপি জামাত আগামী ২০ বছর কিংবা আওয়ামীলীগ ২০৪১ সাল অবধি পাওয়ারে থাকলেও এই নিহত মানুষদের জীবন কি ফিরিয়ে দিতে পারবে? বিচার চাই এই অন্যায়ের, যতক্ষণ পর্যন্ত বিচার না হবে আমার ধারনা সরকারী দল প্রত্যক্ষ ইন্ধন এর সাথে বিরাজমান! অভ্যাসবসত বাসায় এসে একটু টিভি ছেড়ে ছিলাম। দেখি এনটিভিতে, কয়েক লোক পোড়া সারিবদ্ধ লাশের ভেতর থেকে নিজের আত্মীয়কে দেখে যে কান্নাটা দিল। সেই কান্নার ওজনে পুরো দুনিয়া কেন ভেঙ্গে পড়ে না সেটাই আমার প্রশ্ন?
এই সামগ্রিক জাতি রাষ্ট্রের তীব্র ব্যর্থতার দিনগুলোতে বই মেলা আমার কাছে সবকিছু ভুলে যাবার এক অনুষঙ্গ। সব কিছু ছাপিয়ে বইমেলায় বই কিনুক না কিনুক, মানুষের কমতি নাই। তরুনরা আড্ডা দিচ্ছে, ফেসবুক সেলিব্রেটিরা তাঁদের আশেকান নিয়ে ঘুরছে, টুকটাক কিছু বই কিনছে কেউ কেউ, আমার মতো দেখছে অনেকে। অলস ভাবে দাঁড়িয়ে আছে স্টলের মেয়েরা। কেউ খাচ্ছে বাদাম কিংবা পুরি। দেখতে ভালো লাগে, মনের দুঃখ ভুলে যাই। এত হেঁটে এসেছি সেই ক্লান্তি চলে যায়। আর আমি ও জেমসে যেই স্টলেই ঢুকি- অনেকের ধারনা হয় আমরা বই কিনবো। অফিস করে আসে জেমস নরমালী ফরমাল জামা কাপড় পড়া, আর আমি স্টলে স্টলে গিয়ে এত পটরপটর করি যাতে মনে হয় আমি এক বিশাল আতেল। জেমসকে তো আজ চার পাচবার নানান চ্যানেল ইন্টারভিউ নিতে চাইলো, ও সানন্দে প্রত্যখান করলো। তবে উপস্থাপিকাদের দেখতে খুব চকমকে, সবাই চেয়ে থাকে তাঁদের দিকে, তারা চেয়ে থাকে ভাইয়ার দিকে। প্রডিউসার কিংবা এসিটেন্টকে জিগেষ করে, 'ভাইইয়া কি প্রশ্ন করবো'? দাঁড়িয়ে ছিলাম আজ এক উপস্থাপিকা জিগেষ করছে 'আপনার কটা উপন্যাস এবার আসছে? উনি উত্তর দিলেন- আমি কবি, সবাই অবাক। মনেই পড়ছে না কবির নাম। ভালো মতো দেখা উচিত ছিল। তবে ইন্টারভিউ মাষ্টার হলো আনিসুল হক, মেলা প্রাঙ্গণে আসলেই গোটা আটেক ইন্টারভিউ দেন। সোমবার হয়েছিল মজা, আমরা যেখানে যেখানে যাই আর উনিও সেখানে হাজির হন। আমরা মনে মনে মতিকন্ঠের টাইটেলটা উচ্চারণ করি। জোরে বলি না, কারন এখন সবার কাছে ইন্টারনেট সবাই জানে ঘটনা। তবে কথা দিয়ে হক ভাই প্রকাশকদের যে প্রশংসাটা করেন আনিসুল হক, তা জবাব নাই। সবাই বিগলিত হয়ে যায়। আজ দেখি জার্নিম্যান নামে কোন দোকানে ছবি তুলছেন। কি হাসি? জেমস আমাকে জিগেষ করে অবান্তর প্রশ্ন। ইন্টারভিউ দিয়ে কি টাকা পাওয়া যায়? আমি বলি পরোক্ষ ভাবে পাওয়া যায়। ২০জনও যদি এই ইন্টারভিউ দেখে বই কিনে, তাহলেও তো কম লাভ না। মোস্তফা মামুন, মোস্তফা কামাল, সুমন্ত আসলাম- এদের কিছু বইয়ের পাতা উল্টালাম। কনভিন্সিং কিছু লাগে নাই। এরচেয়ে কবিতার বইয়ের পাতা উল্টানো ভালো, কিছু নতুন অনুভুতির বিবরন পড়ে অবাক হওয়া যায়।
সুপরিসর বিস্তৃত মেলায়--স্টল ম্যাপিং এখনো মাথায় আত্মস্থ হয় নি। বারবার দেখা যায় একই পথ দিয়ে হাটি। কত অজনপ্রিয় প্রকাশকদের নাম দেখি। এরাও তো ব্যবসা করতেই আসছে। উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে, আমাদের দিকে দেখে। সেইসব প্রকাশকদের স্টলে কিছু চঞ্চল মেয়ে থাকে। বই একটার দিকে তাকালে তাঁরা খুব উৎসুক হয় কিনবো বলি। কিনি আর না। প্রতিদিনআসি কত কষ্ট করে, এখন বই কিনলে এই মাসে আর নেট চালানো হবে না, ডিশের বিল দেয়া হবে না। বইয়ের চেয়ে এখন আমার কাছে প্রায়োগিক কারনে ইন্টারনেটের মুল্যই বেশী। আর ডিশের বিলওয়ালা শুক্রবারের দিন এসে যেই লুকটা দেয়, মনে হয় বিল না দিলে আমাকে এখনই বাসা ছাড়া করবে। তবে নিজের বই কেনা নিয়ে আমার কোনো আপসোস নাই কারন আমি বই ধারে পাই। কিন্তু বন্ধুকে বই না কিনে দিতে পেরে মন উদাস হয়। তাও মনে মনে গান গাই জিঙ্গেল-- একদিন আমি হবো ডাক্তার। আমাদের আর ডাক্তার হওয়া হয় না। মাহবুব মোরশেদের সাথে দেখা হবে হবে এমন সময় আমি কাট মারছি। আর শরীফ ভাই একজনের সাথে কথা বলছিলো তাই আর কথা বলা হয় নাই। এছাড়া মেলায় আর কোনো পরিচিত মুখ দেখি না। কষ্ট হয়, এতীম হয়ে গেলাম বইমেলায়। টিএসসির তেল চুপচুপা পাকোড়া খেয়ে একটু অসস্তিতে ছিলাম। সেই অসস্তির মাত্রা বাড়িয়ে দিলো এক বোরখা পরিধান করা মেয়ের সিগারেট খাওয়ার। চেইন স্মোকারদের মতো ভুসভুস করে টানছে। ছেলেমেয়ের সিগারেট খাওয়া মোটেও দোষের না, কিন্তু পুরো দুনিয়া দেখিয়ে, রিক্সাওয়ালাদের হা করিয়ে এত শো অফের মানে নাই। বইমেলায় আমাকে আনন্দ দেয়, সাবের ভাই। দুনিয়ায় যাই হোক, উনি চুপচাপ স্টলে বসে থাকে্ন সস্ত্রীক। আমাদের মুখের দিকে তাকায়। দিব্য প্রকাশ এবার ভালো কিছু ইতিহাস বইয়ের অনুবাদ আনছে। নিজে না পড়লেও জেমসের জন্য কিনবো। ওর এগুলা বই প্রিয়। ওকে পাইছিলো সংঘ প্রকাশের এক লোক, পছন্দ হয়েছে অনুবাদ গ্রন্থ, কিনিয়েই ছাড়বে। আমাদের দুজনের কাছে সেইদিন টাকা ছিল মোটে আশি টাকা। শেষে প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুক্তি মিললো। বামপন্থীরাও তক্কে তক্কে থাকে ভোলাবালার আশায়, বিপ্লবের গব্ধ শুকিয়েই বিক্রি করতে চায় বই। তবে মাঝে মাঝে কিছু দোকানে আদিবাসী নারী দেখি, তাঁদের বন্ধুরা আসে, নিজেদের ভাষায় কথা বলে। ইন্টারেষ্টিং লাগে। মানুষের কত আকুলতা নিজের ভাষায় কথা বলার। আজ আরেক জিনিস দেখলাম হুজুরদের লিটলম্যাগে দেখে। সবাই এক সাথে ছবি তুলছে ম্যাগাজিন হাতে- হাসি পেল। লিটলম্যাগ একদিকে আর এই মেলা আরেকদিকে ব্যাপারটা আমাকে খুব পীড়া দেয়। যাওয়াই হয় না ওদিক। আজ গেলাম, আহা এই লিটলম্যাগ আগে কি গ্ল্যামারাস লাগতো, এখন কেমন জানি গ্যাঞ্জির দোকানের ভীড়ে শুনশান লোক কিংবা পড়ুয়ার স্টলের মতো লাগে।!
আজকাল মন খুব বেশি ভালো হইলেও একটু অপরাধবোধ টের পাই। টিভি দেখি না, নিউজ দেখাও কমাইয়া দিছি। খুব দরকার না থাকলে কোথাও যাইতে ইচ্ছা করে না, লাইফের ডর খুব বাইড়া গেছে আজকাল। কি একটা লাইফ! রাস্তায় বার হইতে ভাল্লাগে না পুইড়া মরার ভয়ে, স্বার্থপরতা বাড়তাছে আমার দিনে দিনে।
এই দেশের রাজনীতিটাকে আজ কাল ঘৃণা করতে কষ্ট লাগে। মানুষের জন্য খারাপ কিছু প্রার্থনা করতে হয় না, তবু মন থেকে বেরিয়ে আসে 'এদের উপর পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টময় মৃত্যুর পরিস্থিতি আসুক।'
সাত জনের ছবিটা পেপারে দেখে পেটের মধ্যে পাঁক দিয়ে উঠেছিলো। আহারে, বাংলাদেশে জন্মানোর পাপ শোধ দিলো।
আনিস ভাই ইজ আ গুড টকার এন্ড আ ভেরী আড্ডা প্রিয় পার্সন
আপনার দিকে চেয়ে আগামীতে আর কিছু বলবো না!
ইয়ে মানে একটা প্রশ্ন- 'আপনার কটা বই এবার মেলায় এসেছে/আসছে?
তুমি অন্তত "ডিজিটাল ডায়েরী" নামে একটা বই প্রকাশ করতেই পার।
আমার এই জীবনে কোনো ধরনের বই বের করার খায়েশ নাই!
অপেক্ষায় আছি!৭ জন না!৭০ লাখ পুড়ালেও ঘুম ভাংবে না
কথা সত্য!
মন্তব্য করুন