হতবিহবল কিংবা থমকে থাকা সময়!
এবারের মত বাজে ফেব্রুয়ারি মাস আমার এই জীবনে আর আসে নি! ফেসবুকে লিখেছিলাম একটু আগে। গোটা দশ লাইকও পেলাম। তাহলে আমারই শুধু খারাপ সময় যাচ্ছে না, অনেকেরই মন্দ সময় কাটছে। আমার অবশ্য এখন ব্লগ টগ লিখতে সিরিয়াস বিরক্ত লাগে। তিনদিন ধরে চেষ্টা করেছি, এক লাইনও লিখতে পারি নি। এসব লিখে টিখে কি হয়? অভিজিৎ রায়ের মতো দেশ সেরা বিজ্ঞান লেখককে হাজার হাজার মানুষের সামনে দুই তিন মিনিট কুপিয়ে খুন করা হয়, তাঁর স্ত্রীকে নির্মম ভাবে জখম করা হয়। আঙ্গুল হীন রক্তাক্ত অবস্থায় তিনি সাহায্য চান, কেউ আসে না এগিয়ে। কেউ কেউ ছবি তোলে। এরকম শুয়োরের বাচ্চাদের দেশে আমরা আছি শুয়োর হয়ে, কোনোরকমে প্রান বাঁচিয়ে। এটাকে কি বেঁচে থাকা বলে? টিকটিকি তেলাপোকার জীবনও মনে হয় এর চেয়ে ভালো। প্রয়াত শ্রদ্ধেয় কবি নবারুণ ভট্টাচার্য তো লিখেছিলেন তিনি ইতরের দেশে থাকেন। বজ্র কন্ঠে কবিতায় বলেছিলেন, এই মৃত্যু উপত্যাকা আমার দেশ না। আমাদের অবস্থা সেই তুলনায় কত করুণ, এই শুয়োরের বাচ্চার দেশে থাকতে হয়, মানুষদের এখানে জবাই করা হয়। আর নিতান্তই কপাল ভালো থাকলে সড়ক নৌ দুর্ঘটনা কিংবা পেট্রোল বোমায় ঝলসে মরতে হবে। স্বাভাবিক মরন এখানে খুবই অস্বাভাবিক। ছোটবেলায় নেয়ামুল কোরআনে পড়েছিলাম, অপঘাতে কিংবা দুর্ঘটনায় মরলে শহীদি মরন নাকি হয়। এই বঙ্গদেশে এত শহীদ, বেহেশত তো আলাদা বানাতে হবে।
ঘটনার দিন আমি রংধনু বাসে ঝুলে ঝুলে বাসায় ফিরেছি। জানতামই না। ইভানের সাথে কি নিয়ে কথা বলছিলাম, এমন সময় দেখলাম হিল্লোল দার স্ট্যাটাস। নিমিষেই আমার মেজাজ খারাপের চুড়ান্ত, তাও ধারনা করে ছিলেম এ যাত্রায় অভিজিতদা বেঁচে যাবে। কিন্তু কি, বাসাতে গিয়েই দেখলাম টিভিতে উনি আর নেই। জীবনে একবারই দেখা হলো মেলায়, সেইদিনই। খুব লোকজন পরিবেষ্টিত ছিলেন, যখন একা হলেন তখন গিয়ে উনাকে নিজের পরিচয় দিলাম। উনি হাসিমুখে বললেন আপনার নাম তো আমি জানি, লেখাও পড়েছি, আপনি অনেকদিন ব্লগে। আরো বললেন, শুদ্ধস্বরের এই বইটা এবার ভালো হইছে। আমি বললাম আমার বন্ধু জেমস আপনার খুব ভক্ত, আপনার সাথে দেখা হলে ঈদের খুশী হতো। উনি হেসে বললেন, আমি তো কাল পরশুও আসবো মেলায়, আনেন একদিন জেমসকে। অভিজিৎ দা, আপনার মেলায় আসা হলো না। শুদ্ধস্বরের অনুষ্ঠানে বলেছিলেন মিজান স্যারের চলে যাওয়ার কথা, আপনিও চলে গেলেন উনার মতো। আপনাকে জোর করে পাঠিয়ে দেয়া হলো এমন এক জায়গায়, শত সহস্র মানুষ জীবন ভর কাদলেও আপনাকে আর ফেরত পাওয়া যাবে না। আমি অন্যদের মতো বিচার চাই না, কারন আমি জানি বিচার হবেনা এই বাংলাদেশে। পাশবিক জানোয়ারদের বিচারের মতো শক্তি রক্তস্নাত বাংলাদেশের নাই। এখানে সমস্ত ক্ষতি ব্যাক্তিগত। আজ মেলায় আসছিলাম অল্প সময়ের জন্য। একমাত্র শুদ্ধস্বর ছাড়া কেউ আপনাকে নিয়ে একটা ব্যানার টাঙ্গানোরও প্রয়োজন অনুভব করে নি। সবাই হাসছে, খেলনা কিনছে, বই কিনছে, মিলন ভাইরা অটোগ্রাফ দিচ্ছে, আড্ডা মারছে, যেখানে আপনাকে হত্যা করা হলো-- সেখানে ফুল আলো দিয়ে শোভিত। যাই নি ইচ্ছে করেই, কারন সেখানে সারা জীবন পড়ে থাকলেও আপনাকে আর পাওয়া যাবে না। বরং বাসায় আসতে আসতে আপনার বছর পাচ ছয় আগের একটা ব্লগ পড়ছিলাম, তিনি বৃদ্ধ হলেন- রিক্সাতেই চোখে পানি এসে গেল। আপনি আপনার বাবার আগেই বৃদ্ধ হয়ে হারিয়ে গেলেন। আজ চায়ের দোকানে এক লোক বললো, আপনারা নাকি নবীজীর নামে কুৎসা রটনা করতেন, আমি ভদ্রতার মুখোশ খুলে ফেললাম, বললাম প্রমান দেন নয়তো আপনি একটা শুয়োরের বাচ্চা। ভদ্রলোক রাগে গজগজ করে চলে গেলেন। এই অসভ্য ইতররা আপনার হত্যার জাস্টিফিকেশনে নামছে, আমি চাই ঈশ্বর এদের উপযুক্ত শাস্তি দিক।
আমাদের সামাজিক জীবন, এই বেচেঁ থাকা, জীবনযাপন খুবই মর্মান্তিক। যে আমি বিষুদবার রাতে ঘুমোতে পারি নাই অভিজিৎ রায়ের নৃশংস খুনের পর থেকে, সেই আমাকে শুক্রবারে সারাদিন বাসা পাল্টানোর মত এক আজাইরা কাজে ঘামে পান্জাবী ভেজাতে হচ্ছে! নতুন বাসায় উঠলাম, আগের বাসার স্মৃতি নিয়ে মন খারাপ টারাপ কিছু হচ্ছে না। আমাকে এই সব আজাইরা আবেগ এখন আর স্পর্শ করে না। কত অজস্র মানুষ যেদেশে মানবিক বিপর্যয়ে মরছে, সেই দেশে এসব সম্পর্কের স্মৃতি, স্থান কাল পাত্রের নষ্টালজিয়া রেখে হিন্দি চুলটাও হয় না। এই দেশে জীবন নিয়ে আশা করাটাই ভুল। তাও আমরা বেহায়া প্রজাতির সর্ব নিম্নমানের মানুষ, আমরা দাত কেলাই, স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি গড়ি, ক্রিকেট ফুটবল দেখে পুলকিত হয়, ভালো বই পড়ে জ্ঞানী ভাবি, মিথ্যার এক সংসারে বেঁচে থাকি। আগে আমি দেশ নিয়ে খুব আশাবাদী ছিলাম, বয়স বাড়ছে জ্যামিতিক হারে দেশ নিয়ে আশাবাদীতা শুন্যের কোঠায় যাচ্ছে। কামাল ভাই কদিন আগে কথার ছলে বলছিলেন কাকে জানি, 'যে আপনারা এখনো ভাবেন রুখে দাড়ালে কিছু একটা হয়, আমি তাও ভাবি না, কারন এদেশের কিছুতেই কিছু হবে না, কোনোরকমে বেঁচে থাকাটা শুধু।
শুধুই হতাশা
এই বঙ্গদেশে এত শহীদ, বেহেশত তো আলাদা বানাতে হবে...
আমাদের সামাজিক জীবন, এই বেচেঁ থাকা, জীবনযাপন খুবই মর্মান্তিক...
এদেশের কিছুতেই কিছু হবে না, কোনোরকমে বেঁচে থাকাটা শুধু...
তোর লেখা থেকে তিনটা লাইন তুলে দিলাম। আর কিছু বলার নেই
এই দেশে নিরাপদে বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বইমেলা হচ্ছে যে জায়গায়, এমন জায়গায় একটা মানুষকে এভাবে মেরে চলে গেলো! বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। নিরাপত্তা কোথায় আসলে!!
হত্যাকারীদের থেকেও বড় বদমাইশ মনে হয় যারা যদি, কিন্তু, তবে ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার করে হত্যাকে জাস্টিফাই করে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে শফিগোষ্ঠীই আমাদের দেশকে পরিচালনা করেছে। প্রতিটি সরকারে তাদের বড় একটা অবস্থান ছিল। তাই এসব হত্যার বিচার হতো না তেমনি অভি দা হত্যারও বিচার হবে না।
আরাফাত মিয়া, কিরাম আছ?
অভিজিৎ বা বিশ্বজিত, রাফি বা রাজিব, মাদ্রাসার এতিম ছাত্র বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, কারও অস্বাভাবিক মৃত্যুই কাম্য না। বিচারের সংস্কৃতি যেখানে নাই সেখানে এরকম অগনিত মৃত্যুর মিছিল চলতে থাকবে। মাদ্রাসার ছাত্র মরলে তখন অভিজিত-রাজীবরা খুশি হবে, তালি দেয়, উল্লাস করে, আবার অভিজিতরা মরলে তখন অনেক ফেসবুক-ব্লগারবাসী মুসলিমরা তালি দেয়, উল্লাস করে। মৃত্যুতে আনন্দ উদযাপন আমার দেশের মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
উল্লেখ্য তুমি চায়ের দোকানে যে লোকের সাথে কথা বললে, সে লোক যা বলেছে সেটা ঠিক। অভিজিত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে মহাউন্মাদ লিখত, এর চেয়ে ঢের বেশি উপহাসকর এবং অশ্লীল লেখা অভিজিত লিখেছে, আমি নিজে পড়েছি। এখন এসব সাফ-সুতরো করার কাজ চলছে, যেমন চলেছিল রাজীবের বেলায়। মুক্তমনা ব্লগ থেকে প্রকাশিত আকাশ মালিকের ইসলাম-বিদ্বেষী অনলাইন বইসমূহে মিথ্যা আর প্রতারণামূলক লেখায় ভরা, অনেকেই বলেন অভিজিত আর আকাশ মালিক একই লোক, যদিও সেসব প্রমাণ করা যাবেনা। কিন্তু তার ছত্রছায়ায় ইসলাম-বিদ্বেষ প্রচার হয়েছে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এখন তিনি মৃত, তাই এসব ময়লা নিংড়িয়ে গন্ধ বের করার ইচ্ছে নেই। উল্লেখ্য এসব কোন ইসলামের সমালোচনামূলক লেখা না, সেরকম সমালোচনায় কোন আপত্তি নেই। বইমেলা থেকে তার যেসব বই বের হয় সেসব সমালোচনামূলক লেখা, যদিও অনেক ভুলভাল এবং মিথ্যা কথা আছে সেসবেও, কিন্তু সেখানে ইসলামবিদ্বেষ বা উপহাস সেভাবে নেই। তবে ফেইসবুক বা ব্লগে অভিজিত অন্য মানুষ, সেখানে আমরা প্রচন্ড ইসলামবিদ্বেষী, ঘৃণাপূর্ণ একজন মানুষের পরিচয় পায় আমরা। এসব অনেকেই শুনতে চাইবেনা এখন, কিন্তু এটাই সত্যি।
কিন্তু ইসলামবিদ্বেষী হোক বা না হোক, ঘৃণাবাদি হোক বা না হোক, মৌলবাদি হোক বা না হোক, সবার স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা থাকতে হবে। আমার দেশে যিনি দেশ স্বাধীন করেছিলেন তাঁকে খুন করে বিচারের পথ বন্ধ করে রেখেছিল, সেখানে অভিজিত-রাফির হত্যার আর কি বিচার হবে।
অনেক কিছু বলার ছিলো। কিন্তু আপনার শেষের প্যারার জন্য আর কিছু বল্লাম না....
" কিন্তু ইসলামবিদ্বেষী হোক বা না হোক, ঘৃণাবাদি হোক বা না হোক, মৌলবাদি হোক বা না হোক, সবার স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা থাকতে হবে। আমার দেশে যিনি দেশ স্বাধীন করেছিলেন তাঁকে খুন করে বিচারের পথ বন্ধ করে রেখেছিল, সেখানে অভিজিত-রাফির হত্যার আর কি বিচার হবে।"
মন্তব্য করুন