কিছুটা শোক বাকীটা অভিনয়
আতিক মারা গেলো। না কেউ উনাকে মারে নি কিংবা কেউ হত্যার হুমকিও দেয় নি। তিনি মারা গেলেন শারীরিক অসুস্থতায়। বয়সে আমার চেয়ে দু তিন বছরের বড় হবে। সাধারন মানুষ, পড়াশুনা করে নাই, দুইটা বিয়ে করেছেন, কাজ করেন মুলত রড মিস্ত্রি হিসেবে। উনাকে আমার চেনার কথাও না। চিনি মুলত উনি আর আমি এক দোকানে চা খাই বলে, উনি মাঝি সাহেবের আদরের ছোট সন্তান বলে, আর উনি খালি গায়ে সব সময় ঘুরতেন বলে কিংবা সারা শরীরে উনার অনেক কাটা ছেড়ার দাগ আছে বলে। এই তো সেদিন ভারত- বাংলাদেশের ম্যাচের দিনও উনার সাথে বসে ছিলাম খেলা দেখতে। আমি জিগ্যেস করেছিলাম, আপনি রোদে কেন? উনি জবাব দিয়েছিল- আমার স্টীল বডি- রোদ হলেও সমস্যা নাই। খেয়াল করেছিলাম উনার পেশী বহুল কাজ করা শরীর, আমির খানের মতোই সিক্স প্যাক নাই তাও যা আছে তা ব্যাপক শক্তিশালী এক মানুষের ইঙ্গিত দেয়। যাই হোক শক্তিশালী মানুষরাও এত অল্পবয়সে মারা যায় জেনে বিস্মিত হলাম। সুস্থ ছিলেন দিব্যি, উনার স্ত্রীর সন্তান হবে কমাস পরেই, সাত দিন আগেই ভর্তি হলেন হাসপাতালে, টেস্ট মেস্ট শেষে জানা গেল উনার কিডনী প্রায় দুটোই বিকল। ডায়লাইসিস করে বেঁচে থাকতে হবে। এই অবস্থার ভেতরেই উনার নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার সিদ্ধান্ত নিলো ডাইলাইসিস করাবে- আরো দু দিন যাক। বাসাতে আনা হলো। শরীর নাকি ভালো হচ্ছে। সব পেরেশানীর অবসান ঘটিয়ে আজ দুপুরে তিনি মারা গেলেন। আজ সকালেও উনাকে আমি দেখেছি, চুল ছোট করে কাটা, লোকজন কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে, উনি আমাকে দেখে একটা শুকনা হাসি দিলেন। আমি হাসির জবাবে বললাম, ভয় পাবেন না সব ঠিক হয়ে যাবে, মনের শক্তি আসল। তার আড়াই ঘন্টা পরেই জুম্মার নামাযের আগে আগে- যখন জেমসের সাথে আমি সত্যজিৎ রায়ের 'প্রতিদ্বন্দ্বী' সিনেমা নিয়ে আলাপ করছি। ট্র্যাডিশনাল সিনেমার মতো কাক অথবা পাখি না উড়েই, পুরো এলাকা কান্নায় মুখর। এক নিস্তব্ধ শোকের সময় নেমে এলো আমাদের সবার মনে, তা ঘনীভুত হলো পুরো রাস্তায়।
মানুষের মৃত্যুর পর শোক অদ্ভুত এক অবস্থা পরিনত হয় চারপাশ। পরিচিত মানুষজন থাকলে তো কথাই নাই। কেউ সান্তনা দেয়, কেউ দেয় উপদেশ, কেউ বিলাপ করে কাঁদে, কেউ শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়। তবে আতিকের মৃত্যু শোক পরবর্তী অবস্থা হলো কিছু টা ভিন্ন। কারন গত চার মাসে সেই বাড়ীর তিনজন মানুষ মারা গিয়েছে। ডিসেম্বরে আতিকের মা অসুখে ভুগে, জানুয়ারীতে আতিকের সেজো বোনের জামাই হুট করে হার্ট এট্যাকে, আর এই মাসে আতিক। তাই আতিকের মৃত্যুকালীন শোক পুরো এলাকাকেই মোটামুটি স্তম্ভিত করছে। চার মাসে এক পরিবারে তিন মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুর শোকে যখন হতবিহবল পরিবারের সবাই, পুরুষদের চোখে জল আর নারীরা বিলাপ করে কাঁদছে তখন উৎসুক পাড়া প্রতিবেশী জনতা এসে ভীড় করে, সান্তনার বানী দেয়। এইসব সান্তনার বানী শুনলে আমার গা জ্বলে, যার যায় সেই বুঝে সেই হারানোর বেদনা কোন সান্তনাবানীতে ভুলে যাওয়া সম্ভব। একমাত্র সময়ই পারে সব ভুলিয়ে দিতে। সেই শোকসন্তপ্ত সময়ে মানুষের কথাও আজব, যেমন একটা কথা কাল শুনলাম-- নিশ্চয়ই আল্লাহ এর মধ্যে ভালো কিছু রাখছে। আদরের ছোট সন্তান মারা গেল, তাঁর সন্তান সম্ভবা স্ত্রী বিধবা, শোকের মাতম চলছে, এইটা যদি হয় ভালোর পূর্বাভাষ হয়, সেই ভালো আমাদের দরকার নেই। সন্তানের লাশ যে পিতার কাঁধে উঠবে, তাঁর চেয়ে মর্মান্তিক আর কিছু নাই। আরেকটা কাজ আমার খুব বিরক্ত লাগে যে শোকে স্তব্ধ মানুষদের জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা। যার স্বজন হারিয়েছে তাকে কাঁদতে দেয়াই উচিত কিন্তু সেই মুহূর্তে তাকে জোর জবরদস্তি করে খাওয়ানোর মানে কি? এক বেলা না খেলে মহাভারত অশুদ্ধ হয় না, কিন্তু শোকের সময়ে কাদতে না দিলে তা জগদ্দল পাথরের মতো বুকে চেপে থাকে। সেই ছোট বেলায় খুলনায় আমাদের কলোনীর এক ছেলের বাবা মারা গিয়েছিল, মাস দুই লেগেছিলো আমি তাঁর সাথে কথা বলি নাই বা কথা বলতে পারতাম না। কারন চোখের দিকে তাকালেই হুহু করে কান্না এসে যেত ছেলেটার জন্য। এইরকমের অপরিমেয় হারানোর বেদনায় সিক্ত মানুষকে জোর করে বারেকের দোকানের পচা কেক- চা খাওয়ানোর কি মানে তা আমার জানা নাই! লাশ রাখা হলো পানির পাম্পের আঙ্গিনায়, একটু দুরেই আমরা বসে ছিলাম। চুপচাপ আমি চা খাচ্ছি, এইসব শোকের দিনে আমার গলা শুকিয়ে যায়। আবির উদাস মনে সিগারেট ফুকছে, জেমস ঠায় দাঁড়িয়ে আছে রোদে। আর আমরা মানুষের শোক পালন দেখছি, লাশ দেখতে আসা উৎসুক জনতা দেখছি, কে কি বলছে তা শুনছি। হিসাব মিলিয়ে দেখলাম আতিকের বঊ, বোনরা আর তাঁর বাবাই খুব কাঁদছে, তাঁর ভাইরা আনুষ্ঠানিকতায় ব্যস্ত। কাকে জানানো হলো, কখন জানাযা হবে, গাড়ীর ব্যবস্থা করা, লঞ্চে কে কে যাবে, এইসব নিয়ে মোবাইলে আলাপ করছে। এই ব্যাপারটা সব সময়ই হয়, এক গ্রুপকে কাঁদতে হয় আরেক গ্রুপকে শব আয়োজনে ব্যস্ত থাকতে হয়। এই জন্যেই আমার আম্মু সব সময় চাইতো আমি যেনো বড় আলেম হয়, অন্তত সেই সময়ে আত্মীয় স্বজনের সব চেয়ে উপকারে আসতে পারি। আমি আলেমও হলাম না জালেমও হলাম না হলাম এক হিপোক্রেট ভীরু মানুষ।
ভীত লোকেরা যা করে আমিও তাই করলাম। যখন জুম্মার নামায শেষ তখন আরো মানুষ বাড়লো, আতিকের বাবাকে পুরো এলাকা এক নামে চিনে তাই সবাই দেখতে আসলো। লাশের কাছে থেকেও আমার লাশ দেখতে ইচ্ছে করলো না। সাইফ আসলো, মনে করিয়ে দিলো আজকে আমাদের স্টারে লাঞ্চ করার কথা। ইচ্ছে ছিল না যাবার- তাও সব শোক ভুলতে গেলাম। শুক্রবারের ভরদুপুরে স্টারে লোকে ভরা থাকবে তাতো জানিই, কিন্তু অবিশ্বাস্য মানুষ, জায়গা নেই এক ফোটাও, সাইফকে বললাম তুমি ওই টেবিলের সামনে দাঁড়াও তাঁদের খাওয়া শেষ, আমরা আসছি। আমরা আসলাম উনাদের উঠার নাম নাই, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলাম আরো ১৫ মিনিট। এরপর এলো সেই সময়, আমরা বসলাম এক টেবিল। এত মানুষ যে এসিতেও দরদর করে ঘামছি, এক ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি তাকে চিনেছি আমি আর উনি এক স্কুলে পড়েছি, এক বছরের সিনিয়র, নাম মনে নাই তাই আমাকেও অচেনার ভান করতে হলো। এ এক অদ্ভুত অবস্থা, যাদের নাম আপনার মনে থাকবে তাঁদের দেখা আপনি পাবেন না জীবনে, আর যাদের সাথে দেখা হবে তাঁদের নাম মনে রাখা যায় না। এমনিতে হয়তো পরিচিত হওয়া যেত, আমি যাই নাই। কাচ্চির অর্ডার দিলাম। টেষ্ট নাই। এত ভীড়ে স্টারের খাবারের মানও নেমে গেছে। কানে ধরলাম আর আসবো না এখানে। এরচেয়ে বাসার কাছে আল্লাহর দান বিরিয়ানী হাউজ ভালো, গেলে যে তওয়াজটা করে, পারে না লোক উঠিয়ে দিয়ে আমাদের বসাতে। লাচ্ছির নামে দিলো টেলটেলা পানি। যে এক ঐতিহাসিক ঝাড়ি খেলো ওয়েটার, পাল্টিয়ে দিলো, পাল্টানোর পরে যা আসলো তাও যুতের না। তারপর আবার দিতে হয় ভ্যাট, ভাবলাম অনিষ্ঠ কিছু করি, চিন্তার সাথে সাথেই দেখি এক বয় তিনটা গ্লাস ফেলে দিয়েছে অসতর্কতায়। হাতে দিলাম তালি। আমার তালিতে পুরো ফ্লোর তালি দিলো। সবাই মনে হয় বিরক্ত সার্ভিসে। আসলাম রিকশা ভাড়া চায় যা তা নাই পকেটে। দোকান থেকে নিয়ে টাকা দিলাম। লাশ মসজিদে, একটু আগে যারা শোকার্ত ছিল সবাই কম বেশী স্বাভাবিক, পান সিগারেট খাচ্ছে, রসিকতা করছে। 'যমুনা লাশ ফ্রীজার ভ্যান' নামে এক গাড়ী আসলো। জানাযা হয় নাই তখনো। মাগরিবের পরে জানাযা হলো। পড়লাম আর বাসায় আসলাম। বাসায় হেঁটে আসার সময় ভাবছিলাম, এই কঠিন সময় সবার জীবনে আসবে, প্রিয় মানুষের লাশ কাঁধে নিয়ে শব যাত্রা করতে হবে, কাঁদতে হবে। কি দুর্বিষহ একদিন আমাদের সবার জন্য অপেক্ষমাণ। সেই দিনটার কথাই ভাবলে তো আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না, আমার মরে যে যাবো আমার সময়েও তো সেই একই চক্রের ফিরে আসা। তাই বেঁচে থাকি আমরা। এক ধরনের সামাজিক সমঝোতা নিয়ে। সময়ের হাতে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে। দারুন কথা লিখে গিয়েছেন সন্দীপণ-- এত কম সামাজিক সমঝোতা যে মৃত্যুর পর চারজন শব বাহক জুটবে আশা করি না।' আমি আশা করি তবে আমার যেনো কারো শব বাহক হতে না হয় এই আশাবাদ সবসময় করি। কারন আপনজন হারানোর যন্ত্রনা নিজের মরন যন্ত্রনার চেয়েও কম হবে বলে ধারনা আমার!
মন খারাপ করা লেখা। কিছু কিছু সান্তনার বানী শুনলে আসলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
কাচ্চি রান্না শুরু করুম কিনা চিন্তাইতেছি
আলু ভর্তা ডিম ভাজি খেতে খেতেই তো তোমার দিন কেটে গেল!
আলু ভর্তা আর ডিম ভাজির উর্পে কোন খাবার আছে নাকি? >)
আমি এত খেয়েছি এইসব এখন আর ভাল্লাগেনা!
বাস্তবটা
নির্মম বাস্তবতা!
মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। আজকাল কারো মৃত্যু খবর মানতেই পারি না। চোখ ভরে যায়। এই এক জীবনে কতজনকে যে চলে যেতে দেখলাম! ছোটবেলা থেকে যাদের দেখে বড় হয়েছি, কতজন যে চলে গেলেন! বুকের ভেতরটা হু হু করে। আল্লাহকে সবসময়ই বলি, পৃথিবীটা আর খালি করে দিও না।
দুনিয়াটাই এরকম কি আর করবেন বলেন?
এই মন খারাপের পোষ্টেও তোমার কমেন্ট দেখে খুব ভালো লাগলো!
মন্তব্য করুন