গল্প: সহজলভ্য অসুস্থতা এবং বিবর্তনবাদের হারানো সুর
হোটেল নাজ গার্ডেন তৈরী হবার আগে বগুড়ার ছিলিমপুর জায়গাটা পুরো অজ পাড়াগাঁই ছিলো বলা যায়। গ্রামে পল্লীবিদ্যূতে লাইন। এবং সেটা একটা ফিলিপস্ বাতি জ্বালানো আর ফ্যান চালানোর জন্য। পল্লীবিদ্যূতে কাজ করতেন রোমেলের মা। তিনি মহিয়সী নারী ছিলেন। রোমেল আর অ্যঞ্জেলের মতো দু'টো ছেলেকে বড় করার পর তিনি আরো দু'টো ছেলে নিয়েছিলেন। চার ছেলে ধারণ করার কাবিলিয়ত মহিলার মধ্যে ছিলো। রোমেলকে দেখলে সেটা বোঝা যেত।
উদ্দামতার যে কোনো বাঁধ থাকতে পারে সেটা রোমেলকে দেখলে ভুলে যেতে হতো। পৃথিবীর কোনো কাজ নেই যেটা সে ভালভাবে পারতো না। আর শরীরটা ছিলো পুরো পেটা। ২০ বছর বয়সে তার যে দোহারা শক্ত গঠন তার দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকতো ২৭-২৮ বছরের অনেক ছেলেও। ক্রীকেট খেলতো ভালো। তবে খেলার চেয়েও ভালো পারতো ছেলে-পিলেকে মেরে-ধরে যেকোন ভাবে ঠান্ডা করে রাখতে। রহমান নগরে রোমেলের নাম বেশ পাকাপাকি ছড়িয়ে পড়েছিলো সেই সময়েই। অন্য মহল্লার মাস্তানদের সঙ্গে ছেলেটার মূল পার্থক্য ছিলো সে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত ভালো ছাত্রও ছিলো। এরপর ভুল পরিকল্পনার পাকে-চক্রে তার জীবন অনেক সম্ভাবনার ফুলকি ছড়িয়ে শেষতক মোটর পাটর্সএর এক দোকানের গদিতে গিয়ে পাকাপাকি আসন করে নেয়। তার পরিচিতজনেরা খুশিই হয়তো হয়েছিলো। বন্ধুরাও হয়তোবা। কিন্তু আসলে ছেলেটার যাওয়ার ছিলো অনেকদূর।
তবে রোমেলে জীবন বগুড়ার মফস্বল পরিমন্ডল থেকে বেরোতে না পারলেও, অর্থনীতির জোরে কালনাগ পেরেছিলো। তবে ঢাকায় এসে অতিরিক্ত আলসেমী সেই ছেলেটাকে প্রায় মুছে দিয়েছিলো, যে পকেটে ঝকঝকে ধারালো এক দো'ফলা চাকু নিয়ে ঘুরতো সবসময়। ছেলেটার এত চমৎকার টেম্পার ছিলো যে ভাষায় বর্ণনা প্রায় অসম্ভব। দুই বছরে একবার সেই চাকুতে রক্ত লাগে নি। কিন্তু অজস্র কাজ হাসিল হয়েছে সেটা দিয়ে। শুধুমাত্র তার প্রদর্শনের গুণে। এ কৃতিত্বও নাগের। বন্ধুমহলে তার নাম কালনাগ হবার পেছনে কারণই ছিলো সেটা। তার সাপের মতো হিসহিসে স্বরে ভয় দেখানোর সংলাপগুলো এমনভাবে মস্তিষ্কে প্রবেশ করতো যে জমে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় কারোই থাকতো না। না ছেলেটার চেহারা বিকট ছিলো, না শরীর বিরাট ছিলো; শুধু একটা ঠান্ডা গলা ছিলো মাইরি। ওর মতো অসাধারণ থ্রেট দিতে পারতো না বন্ধুমহলে আর কেউ। সিএন্ডবি কলোনীর একদম ভেতরে বড় উঠোনসহ ওদের একতলা সরকারী বাড়িটা অবশ্য খুব আনন্দের একটা জায়গা ছিলো। সেখানে ইমনের ছোট্ট বোনটি ছুটে বেড়াতো। তার পা থেকে ঝরে পড়তো ছোট ছোট অদৃশ্য মুক্তার দানা। তাতে পুরো জায়গাটা ঝকমক করতো।
রাফিদ অবশ্য এসব কোনো কাজের এক্সপার্ট ছিলো না। দলে একজন থাকতে হয় যার কাজ হলো পাগলামির দায়িত্বটুকু নেয়া। বিপজ্জনক কাজে যেকোন সময়ই ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। সেসময় যে কেউ একজনকে পাগলের মতো কিছু একটা করে পরিস্থিতি সামলে নিতে হয়। সাময়িক সময়ের জন্য অপরিকল্পিত কাজ চলার ফলে সব পক্ষই খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়তো। নিজের দলের ছেলেগুলোকে এ সুযোগটি পাইয়ে দিতো সে। এরপরে বাকীটা কপালের হাতে ছেড়ে দেয়াই ছিলো ওদের প্ল্যানের একমাত্র কমন স্ট্রাকচার। এর ওপর নতুন নতুন মাংস চড়ানো হতো বারবার।
সেবার নাটাইপাড়ায় সেবায়েতদের ছেলেটাকে আটকানোর সময়েও প্ল্যান করা হলো এবার একটু ভিন্নতা আনতে হবে। কথামতো রাফিদ এক শুক্রবার দুপুরে ভাত খাওয়ার পর পাঞ্জাবী-পায়জামা পড়ে, বেশ আতর-টাতর মেখে তপন নামের ছেলেটার বাসায় চলে গিয়েছে। তপন রাফিদকে দেখেই আৎকে উঠেছে। কিন্তু কিছু বললে যদি সব ফাঁস করে দেয় তাহলে ঝামেলা হয়ে যাবে বলে কিছু বলতেও পারছিলো না। তপনের বাবা-মা'র পর্ব শেষ হলে পর রাফিদ ওকে একা পেয়েই কাজের কথা ছাড়লো, সন্ধ্যার মধ্যে পুরো পাঁচ হাজার টাকা পৌছে দিতে হবে। নাহলে ছবিগুলো রীনার বাবা-মা'র কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
তপন ঠিক তিন দিন আগে ময়না নামের সুন্দর ফর্সা একটা মেয়েকে নিয়ে ম্যন্ডেলিন হোটেলে তিন তলায় একটা রুমে ঢুকে পড়েছিলো। দুপুর একটায়। সেটা আগে থেকে হোটেলের ম্যনেজার কাম রাফিদদের বন্ধু শাওনের সুবাদে সবাই জানতো। পুরো ঘটনা শাওনের নতুন ক্যমেরা মোবাইলে খুব সহজে তুলে নেয়া হয়েছিলো। তখনকার মোবাইল ক্যমেরাগুলোয় শুধু ছবি তোলা যেতো। এবং ভিজিএ ক্যমেরা হওয়ায় ছবির কোয়ালিটিও তেমন থাকতো না। তবু সে ছবিগুলোই ছেলে-মেয়ে দু'টোর মনে এমন ভয় ধরিয়ে দিলো যে ওদের আর কোনো কষ্টই করতে হয় নি। এমনকি ইমনকেও গলা থেকে বের করতে হয় নি কোনো ভয়াল হিসহিসানি। অবশ্য ওরা ডাকাত হলেও নিজেদের সীমানা জানতো। মেয়েটাকে তাই পাশের রুমে নিয়ে পালা করে কিছুক্ষণ টিপাটিপি ছাড়া আর কিছুই করে নি কেউ। এমনকি সেরকম অবস্থায় কোনো ছবিও তোলে নি। ছবি যা তোলার তাতো তপনের সঙ্গে তোলাই হয়েছে। দু'জনের বাসার ঠিকানা নিয়ে, মিথ্যা ঠিকানা হলে ঝামেলা বাড়বে বই কমবে না- এ তথ্য স্পষ্টভাবে জানিয়ে, সঙ্গে থাকা এক হাজার টাকা রেখে দিয়ে বেচারা দু'টিকে ছেড়ে দিয়েছিলো ওরা।
তপন সন্ধ্যার পর শাওনের মোবাইলে ফোন দিয়ে জানতে চাইলো টাকা কোথায় দিতে হবে। ওকে বলা হলো এসপি ব্রীজের ওপর আসতে। এরপর রাফিদ সেবায়েতদের ছেলেটাকে ফোন করলো।
মন্তব্য করুন