ইউজার লগইন

গল্প: রাতের খুশি খুশি ভাবের নেপথ্যে একটা কারণ ছিলো

‘স্মোকিং ইজ স্ট্রিক্টলি রেস্ট্রিক্টেড ইন দি অফিস এরিয়া’ ঘাড়ের ওপরেই কথাটা লেখা ছিলো। এরিয়াল ফন্টে এবং অন্তত ৭২ পয়েন্ট সাইজে। বোল্ডও করা ছিলো কথাটা। তার নিচে দাঁড়িয়েই সিগারেট টানছিলাম। সাধারণত আমি অফিসের আওতাভুক্ত এলাকায় এভাবে ধূমপান করি না। যদিও অফিসের অনেককেই আমি ওই নোটিশটার নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে এবং খেতে খেতে ওই নোটিশটা নিয়েই হাসাহাসি করতে দেখেছি।

অফিস থেকে একটু দূরেই চা-সিগারেটের দোকান। সেখানে দুই টাকা, এক টাকা দামের বিস্কুটও পাওয়া যায়। আমাদের গ্রামে গরুকে যেসব কলা খাওয়াতো, সেসব কলাও পাওয়া যায়। চা পানের জন্য হোক, সিগারেট টানার জন্য হোক বা ক্ষুধায় যখন মাথা ভনভন করে তখন কষ্ট কমানোর জন্যই হোক; আমি ওই দোকানটায় চলে যাই।

ক্ষুধায় মাথা ভনভন করার বিষয়টা আমি টের পাই কয়েক মাস আগে। যখন এই অফিসে প্রথম প্রথম ঢুকি। তার আগে আমার কখনো ক্ষুধায় কষ্ট পাওয়ার অনুভূতি হয় নি। আগের অফিস থেকে বাসার দুরত্ব ছিলো দু’মিনিটের হাঁটাপথ। দুপুরে যখন কাজের চাপ একটু কমে আসতো, সেটা কমতো তখনই যখন অফিসাররা বাসা থেকে আনা টিফিন ক্যারিয়ারগুলো খুলে দুপুরের খাওয়া শেষ করে ঝিমাতে শুরু করতো; সে সময় আমি টুক করে বাসায় চলে আসতাম। নাজনীন আমার জন্য থালায় গরম ভাত বেড়ে নিয়ে বসে থাকতো। আমার দু’জন একসঙ্গে বসে খেতাম এবং তারপরই আমি আবার অফিস পানে ছুট লাগাতাম। অফিসের কাউকে বলতাম না বলেই বেশিক্ষণ বাইরে থাকতাম না। সেই অফিসটার বস একদিন পাততারি গুটিয়ে আমেরিকা চলে গেলো। অফিস বিক্রি করে দিয়ে গেলো আরেকটা লোকের কাছে। সেই লোক আবার প্রথম দিন অফিসে এসেই আগের সব স্টাফদের ছাঁটাই করলো। আমি এক দুপুরে ভাত খেয়ে অফিসে ফিরে দেখি আমার আর চাকুরী নেই। গেটে দাঁড়ানো দারোয়ান জানতো কথাটা কিন্তু আমাকে বলে নি। আমি ভেতরে গিয়ে প্রথমে কাউকে না দেখে খানিকটা হকচকিয়ে যাই। অ্যাডমিনের সবুজ স্যারকে তার টেবিলের স্তুপ হয়ে থাকা কাগজগুলোকে গুছাতে দেখে তাড়াতাড়ি সেদিকে এগিয়ে যাই। স্যারকে সারাজীবন বলে এসব কাগজ গুছাতে রাজি করাতে পারি নি। সেদিন সেই কাজেই তাকে সাহায্য করতে গিয়ে জানতে পারলাম, আমার নিজেরও সর্বনাশ হয়ে গেছে।

সে সময় নাজনীনের শরীরটা প্রতিদিন তার আগের দিনের চেয়ে একুট বেশি খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। গার্মেন্টের কাজ ছেড়ে দিতে হয়েছিলো আরো বছরখানেক আগে। প্রথম প্রথম সে কিছু বলতো না। সে সময় যদি পেটে ব্যথার কথাটা মুখ ফুটে বলতো তাহলে হয়তো বিষয়টা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার আগে আমরা সবাই মিলে কিছু একটা করতে পারতাম। যেদিন সে পেটে ব্যথায় আমার ঘরের কাঁচা মেঝেতে কাটা মুরগীর মতো ছটফট করা শুরু করে দিয়েছিলো, তখন আমি মূহুর্তের জন্য দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলাম। পাশের ঘরের আলেয়া ভাবীই এসে সেদিনকার পরিস্থিতির প্রথম ধাক্কাটা সামাল দেয়। আমি নাজনীনের আগে কাউকে ওভাবে কাটা মুরগীর মতো ছটফট করতে দেখি নি।

ডাক্তার যখন ইমার্জেন্সী অপারেশনের কথা বলে ৫ হাজার টাকা চেয়ে বসে, তখন আমি আর কোনো কিছুতেই আহত হবার মতো অবস্থায় ছিলাম না। আমি জানতাম সরকারি হাসপাতালে টাকা-পয়সা খুব একটা লাগে না কিন্তু কথাটা আসলে ভুল প্রমাণিত হয়েছিলো। সেবার নাজনীনের অপারেশন করাতে গিয়ে আমার সর্বসাকুল্যে ১২ হাজার টাকা খরচ হয়েছিলো। যার ৫ হাজার একবেলার মধ্যে জোগাড় করে দিতে হয়। ভাগ্যটা ভালো যে, মা’র দেয়া একটা সোনার চেইন আমার কাছে রয়ে গিয়েছিলো। ওটা বোধহয় মা আমাকে খুব ছোটবেলায় ভালবেসে উপহার দিয়েছিলেন। মা’র যে আমাকে একটা সোনার চেন দেয়ার মতো সামর্থ্য ছিলো তা আমার কখনোই বিশ্বাস হয় নি। অনেকদিন পর্যন্ত তো চেনটাকেও আমার নকল বলেই মনে হতো। পরে জেনেছিলাম ওই চেনটা মা’কেও ছোটবেলায় নানী দিয়েছিলেন। সুতার মতো চিকন আর প্যাচানো ওই চেনটায় সোনার পরিমাণ ছিলো সামান্যই। হাজার তিনেক টাকা আমি ওই চেনটা বিক্রি করে পেয়েছিলাম। হাতে সময় থাকলে হয়তো আরেকটু বেশি দামে বিক্রি করতে পারতাম। আমার হাতে সময় ছিলো না। তাঁতীবাজারের লুঙ্গি কোঁচা মেরে আর চাঁদিতে গন্ধরাজ তেল মেখে বসে থাকা পয়সাওয়ালা ছ্যাচ্চোড়গুলো আমার পরিস্থিতি প্রথম সুযোগেই বুঝে ফেলেছিলো। ওরা আমার মতো বিপদগ্রস্থদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ‘ফয়দা’টা তুলে আনার নিয়ম খুব ভালোভাবেই জানতো। বাকী টাকাগুলোর বন্দোবস্ত কিভাবে হয়েছিলো সব ঠিকঠাকভাবে মনে নেই। মনে আছে আলেয়া ভাবী কোথা খেকে যেন পচিশশো টাকা এনে হাতে গুঁজে দিয়েছিলো।
টিউমার অপারেশন সফল হবার পর ডাক্তার বলে দিয়েছিলো ওকে দিয়ে যেন আর ভারী কাজ না করাই। আমি ওর গার্মেন্টে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলাম। নাজনীন হেসে বলেছিলো, তাইলে কি আমরার দুই বেলা খাওয়ার দিন শুরু হইলো? আমি কোনো উত্তর করি নি। অফিসের বেতনে বাসা ভাড়া দিয়ে পরে খাওয়া খরচটা পার করা আসলেই অসম্ভব একটা বিষয় ছিলো। তার উপরে ছিলো নাজনীনের ওষুধের খরচ। আমার জন্য বেশ একটা ঝামেলা হয়ে গিয়েছিলো।
প্রথম দিকে অফিসের কয়েকজন স্যারের কাছ থেকে কিছু কিছু টাকা ধার নিয়ে চলেছিলাম। এক সময় ওষুধ খরচটা ছাটাই করে দিতে হয়েছিলো। নাজনীন নিজেই সেটা করেছিলো। ওর ওষুধ ওই কিনবে বলে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে রাখতো কিন্তু ওষুধ কিনতো না। আমার টান পড়া বাজারের খরচে ও সেই টাকাগুলো সুকৌশলে ঢুকিয়ে দিতো। আমি প্রথম দিকে সত্যিই বিষয়টা ধরতে পারতাম না। যেদিন ধরতে পারি সেদিনকার একটা ঘটনা মনে আছে। একশ টাকা ধার নিয়েছিলাম আতিক স্যারের কাছ থেকে। এই লোকটা একটু ঠোঁটকাটা টাইপের ছিলো। বাসা থেকে বের হবার সময় নাজনীন আমাকে একশ টাকা দিয়ে বাজার করার কথা বলে দিয়েছিলো। আমি জানতাম বাজারের টাকা সেই মাসে শেষ হয়ে গেছে। সকাল থেকে সেটা আমার মাথায় দুশ্চিন্তা হয়ে বসেও ছিলো। তাই নাজনীনের বাড়িয়ে দেয়া টাকা দেখে ‘এই টাকা কই পাইলি’ জিজ্ঞেস না করে পারি নি। নাজনীন ওর স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বলেছিলো, আমার ওষুধের টাকা। বললাম, তোর ওষুধের টাকা দিয়া তো বাজার করলে হবে না। তাইলে আবার যখন অসুখ হবে তখন কেমনে হবে? ও জানালো, অনেকদিন থেকেই ওষুধের টাকা দিয়ে বাজার করা হচ্ছে। তাতে ওর কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
আমি কথাগুলো শুনে ওর উপর খুব রাগ করলাম। আমার কথা-বার্তায় তার বেশ খানিকটা প্রকাশও পেয়ে গেলো। সবশেষে অস্থির আক্রোশে গজরাতে গজরাতে বাসা থেকে বের হয়ে অফিসে রওনা দিয়েছিলাম। অফিসে ঢুকেই পড়েই গিয়েছিলাম আতিক স্যারের সামনে। উনি দেখেই বললো, কিরে তুই আর মানুষ হইলি না? কথাটা শুনে এতটাই মেজাজ খারাপ হলো যে, আমি খানিকক্ষণ সময় নিলাম নিজেকে সামলে নিতে। দুপুরের আগে আগে একটা কাজে তার রুমে ঢুকেছিলাম। রুমে আর কেউ ছিলো না দেখে বললাম, স্যার সামান্য একশটা টাকার জন্য আপনে সবার সামনে আমারে এইভাবে একটা কথা বলতে পারলেন? চাছাছোলা আতিক স্যারটা তখন উচ্চস্বরে হেসে উঠে বললেন, আরে তোর আবার ওই কথাটা গায়েও লাগছে নাকি? বলে দুলে দুলে হাসতে লাগলেন। শুনে আমার আর সহ্য হলো না। পকেট থেকে ওই একশ টাকার নোটটা বার করে স্যারের দিকে এগিয়ে ধরলাম। বললাম, স্যার খুব স্যরি টাকাটা ফেরত দিতে দেরি হয়ে গেলো। আপনে কিছু মনে কইরেন না। বলে চলে এসেছিলাম।
রাতে যখন নাজনীনের পাশে শুয়ে শুয়ে ওকে গল্পটা বলছিলাম, তখন সে হেসে কুটি কুটি। আমার নাকি সবসময়ই মাথাটা অনেক গরম থাকে বলে সে বেশ কিছুক্ষণ টিপ্পনী কাটলো। আমার সেসব শুনতে খুব বেশি ভালো লাগছিলো না বলে উঠে একটা সিগারেট ধরিয়েছিলাম।
সহকর্মী আর স্যারেরা ভালো-মন্দ মিলিয়ে ছিলো কিন্তু ওই অফিসটার কল্যাণে আসলে আমার পেট চলছিলো। তাই ওই অফিস থেকে বিনা নোটিশে চাকুরী চলে যাবার পর আমি আসলেই পানিতে পড়েছিলাম। নাজনীনের শরীরটা তখন আবার ক’দিন ধরে খারাপ হতে শুরু করেছিলো। বড়লোকেরা কি বলে জানি না, আমাদের মতো ছোটলোকেরা বলে- মিনস্; সেই জিনিসটা নাজনীনের ক’মাস ধরে হচ্ছিলো না। পেটটা সবসময় ফুলে থাকতো। একবার সরকারী হাসপাতালের ডাক্তারের কাছে নিয়েও গিয়েছিলাম। ডাক্তার হরমোনের সমস্যা নামের একটা জটিল সমস্যা আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ওই সমস্যাটা হয়েছে বলে সন্দেহ করছেন তিনি। এমন সময় আমার চাকুরীটা চলে গেলো।
সে বিপদেও এগিয়ে এলো আলেয়া ভাবী। উনি আমাদের বাড়িওয়ালীও ছিলেন। চাকুরীর খবর শুনেই বাড়িভাড়াটা মাফ করে দিলেন। বললেন, যেইদিন তুমি আবার একটা চাকরি পাবা সেইদিন সব ভাড়া একসঙ্গে দিয়ে দিও। আমি একটু অবাক হয়ে মহিয়সী ওই মহিলাটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার চোখ দিয়ে কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ছিলো কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছিলো না।
চাকুরী খোঁজা, নাজনীনকে নিয়মিত ডাক্তার দেখানো, ওষুধ কেনা, বাজার করা- এরকম বেশ কয়েকটা টেনশন মাথায় নিয়ে তখন আমাকে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে হতো। আলেয়া ভাবী শুধু যে বাড়িভাড়া মাফ করেছিলেন, তাই নয়; দুই মাস আমার কারেন্ট বিলও তিনি দিয়ে দেন সে সময়। যদিও আমার ঘরে একটা একশ’ ওয়াটের বাল্ব আর ঘড়ঘড়ে শব্দের ফ্যান ছাড়া বৈদ্যুতিক কিছুই চলতো না।
আমার চাকুরী পাওয়া আর নাজনীনের আমাকে ছেড়ে চলে যাবার ঘটনাটা প্রায় সমসাময়িক। নতুন অফিস থেকে বাসার দুরত্ব ছিলো প্রায় পচিশ কিলোমিটার। আমি পচিশ কিলো দুর থেকে কিছুটা দৌড়ে, কিছুটা হেঁটে, কিছুটা বাসে, কিছুটা খুশিতে লাফাতে লাফাতে একটা নিয়োগপত্র ভরা খাম হাতে নিয়ে বাসায় পৌছে দেখি নাজনীনের সময় প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। আলেয়া ভাবী ওর মাথার কাছে বসেছিলো। মহল্লার একটা ছেলেকে তিনি খবর দিয়ে এনেছিলেন। দুইজনে আর মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ধরাধরি করে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতেন। আমি আসায় তারা উভয়ে একটু ভরসা পেলেন কিন্তু আমি আমার প্রিয় নাজনীনের ওই চেহারাটা দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। দরজার আড়ে মাথা ঠুকে ডকুরে কেঁদে উঠলাম।
এক মূহুর্তেই আবার নিজেকে সামলে নিতে হয়েছিলো। আলেয়াকে হাসপাতালে নেয়ার পথেই সে মারা গিয়েছিলো। আমার হাতের মধ্যেই ওর ঠান্ডা নিস্তেজ হাতটা নিথর হয়ে পড়েছিলো। সে শেষ সময়ে আমাকে কোনো কথা বলে যেতে পারে নি। পারলে কি বলতো, সেটা নিয়ে পরে আমি অনেক ভেবেছি কিন্তু কোনো কুলকিনারা করতে পারি নি। সে খানিকটা অভিমানী প্রকৃতির মেয়ে ছিলো। হয়তো অভিমান ভরা গলায় জানতে চাইতো, কেন আমাদের সঙ্গেই এমন হলো? ওকে নিয়ে যখন হাসপাতালে যাই তখন ডাক্তার সাহেবের শুধু শেষ ঘোষণাটা দেয়া বাকি ছিলো।
নাজনীন মারা যাবার সপ্তম দিনে আমি নতুন কর্মস্থলে যোগ দিই। এর মধ্যেই খাওয়া-দাওয়ার সমস্যা সমাধানে আলেয়া ভাবী এগিয়ে এসেছিলেন। যদিও আমার কিছুই খেতে ইচ্ছে করতো না। না খেয়ে থাকার অভ্যাসটা সেই অবকাশেই তৈরি হয়ে যায়। নতুন চাকুরীতে ঢোকার মাসখানেকের মাথায় আমি ক্ষুধায় মাথা ভনভন করার অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হই। সকালে কিছু না খেয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যেতাম। অনেকটা হাঁটা পথ পেরিয়ে এসে বাসে উঠতাম। অফিসের সামনে নেমে এক কাপ চা আর একটা নোনতা বিস্কিট খেতাম। দুপুরে ক্ষুধায় মাথা ভনভন করতো। চাকুরীটায় আমি বেশি মনোযোগী হতে পারছিলাম না। নাজনীনের স্মৃতি তখনো মাঝে মাঝে জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠে। মন-মাথা-হাত-পা অবশ হয়ে আসে।
আলেয়া ভাবী সাধ্যের সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করেছিলেন। ভাইকে দেখি নি এই বাড়িতে ওঠার পর কখনোই। কখনো জানতেও চাই নি ভাইয়ের খবর। নাজনীন মারা যাবার পর, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখতাম আলেয়া ভাবী তার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। আমায় দেখে ডাক দিতেন। তার ঘরে নিয়ে বসাতেন। গুড় দিয়ে মাখা মুড়ির বাটি এগিয়ে দিয়ে বলতেন খাও। আমি খানিকটা খেতাম, খানিকটা ফেলতাম। ভাবীর সঙ্গে টুকটাক কথা হতো। তারপরে আমি ঘরে যেতাম। তখন মাঝে মাঝে আমার মনে আলেয়া ভাবীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার ইচ্ছে হতো। মহিলার বয়স ত্রিশ পেরিয়েছে। আমার এখনো আটাশ। উনি একলা থাকেন, স্বামীকে তালাক দিয়েছেন, বাড়িভাড়া দিয়ে নিজের খরচ চালান; সবই তো দেখা যায় স্বাভাবিক। আবার আমাকে পছন্দও করেন। দুপুরে একজনের বদলে দুইজনের খাবার রাঁধেন। রাতে নিজে আমার ঘরে এসে খাইয়ে যান। সমস্যা নেই কোথাও। তারপরও আমি আলেয়া ভাবীকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখতাম না। কখনো উনার চোখে চোখ রেখে কথা বলতাম না।
কিন্তু হতাশা যখন বের হবার জায়গা পায় না তখন বিধ্বংসী হয়ে ওঠে। আমার ভেতরেও তাই ঘটলো। চাকুরীতে অমনোযোগী আমি যত দিন যেতে লাগলো তত খামখেয়ালি হয়ে উঠতে লাগলাম। একেকদিন অফিসে যাবার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আসতাম। অফিস থেকে ফোন করলে বলতাম, শরীর খারাপ। রমনা পার্কে গিয়ে বেঞ্চিতে বসে বসে ছেলেমেয়েদের হাত-পা টেপাটেপি দেখতাম। এসব তথাকথিত ‘আজাইরা’ কাজে সময় নষ্ট করতে ভালো লাগতো। নাজনীন থাকাকালে যেভাবে অফিস করা, বাসায় ফেরা, আয়-উন্নতির ফিকির করা, খরচাপানির হিসাব রাখার মতো কাজগুলো করতে ভালো লাগতো এবং ইচ্ছা জাগতো; সে সবকিছুই এখন বিরক্তিকর লাগে।
এরই মধ্যে নতুন অফিসের ক্যান্টিন ম্যানেজার ওসমান গণির সঙ্গে পরিচয় ঘটলো। একই সঙ্গে ঘটে গেলো একটি সুবর্ণ অধঃপতন। ইয়াবা ট্যাবলেট আর গাঁজায় আসক্ত হয়ে পড়লাম। প্রথম দিকে গণি নিজে থেকেই আমাকে পিল এনে খাওয়াতো, স্টিক বানিয়ে দিতো। আমি হতাশায় আকণ্ঠ ডুবে থাকা সেই সময়টাতে হঠাৎ যেন একটা পথ খুঁজে পেলাম। নেশাদ্রব্যগুলো সেবন করলেই মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠতো। নাজনীনকে মনে হতো অনেক দূরের কেউ। আকাশের তারা। মনে হতো ও ওখানে বসে আমাকে দেখছে। আমি ফুরফরে মেজাজে আছি বলে খুশি হচ্ছে। এমন ভাবতে ভাবতে আমি বুঝে না বুঝে নেশার রাজ্যে পুরোপুরিই ডুবে গেলাম।
আলেয়া ভাবীর বিষয়টা বুঝতে দেরি হয় নি। উনি নিজের স্বামীকে তালাক দিয়েছিলেন এই কারণে। আমাকেও প্রথমে একদিন বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু আমার রুক্ষ উত্তর শুনে বেশিদূর এগোতে পারেন নি। এরপর থেকে আমি দেখতাম আলেয়া ভাবীর ব্যবহারে অনেক পরিবর্তন চলে এসেছে। আগের মতো আর ঘরে ডাকতেন না। আমার তখন ফিরতে অনেক রাত হতো। ঘরে ঢুকে দেখতাম প্লেটে ভাত ঢেকে রাখা আছে। আমার ঘরের চাবি যে উনার কাছে আছে, তা আমি জানতাম বলে অবাক হতাম না। তবে মহিলার প্রতি কৃতজ্ঞতাটা ঠিকই কাজ করতো।
‘স্মোকিং ইজ স্ট্রিক্টলি রেস্ট্রিক্টেড ইন দি অফিস এরিয়া’ লেখা সাইনবোর্ডটার নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যখন আমি সিগারেট টানছি, তখন দূরে দাঁড়ানোর একটা লোক আমাকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো। তিনি যে আমি যে প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করি সে প্রতিষ্ঠানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, তা জানার বা বোঝার কোনো কারণ আমার ছিলো না। আমার মতো ছোট চাকুরেদের কখনোই তার মতো লোকেদের মুখোমুখি হতে হয় না। আমি তাই দূরের আগ্রহী লোকটির প্রতি আগ্রহী না হয়ে সিগারেটটা শেষ করে অফিসের ভেতরে ঢোকার উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়ে ছিলাম। ততক্ষণে পেছন থেকে একজন সিকিউরিটি গার্ড দৌড়াতে দৌড়াতে আমার কাছে এসে পৌঁছুনোর আগেই হেঁকে জানিয়ে দিয়েছেন, বড় স্যার নাকি আমাকে ডাকে। ইশারায় দেখালেন ওই দূরের লোকটিই বড় স্যার।
আমি ধীরপায়ে হেঁটে গেলাম বড় স্যারের সামনে। গিয়ে নিজের কানে শুনে এলাম, আমার চাকুরী চলে গেছে। ওই চাকুরীতে প্রাপ্তি বলতে ছিলো অতোটুকুই। ছাঁটাই করেছিলেন প্রতিষ্ঠানের মালিক নিজে। এটা যে প্রাপ্তি সেটা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলো ওসমান গণি। সেদিন সন্ধ্যায় গাঁজার স্টিকে বুকভরা দম দিয়ে সে বললো, ‘শোনো মিয়া, তোমার চাইতে কত বড় বড় লোক এইখানে চাকরি কইরা গেছে কিন্তু জীবনে কোনোদিন বড় স্যারের দেখা পায় নাই। কত বড় বড় গুটির শিকার হইসে কত বোয়াল-কুমির তার হদিস নাই। আগের দিন অফিস কইরা বাড়ি গেছে, পরদিন শুনছে চাকুরী নাই। আর অফিসের বারিন্দায় ঢুকতেও পারে নাই। আর তুমি দুই পয়সার পিওন, ছাঁটাই হইসো মালিকের হাতে। তোমার কি আর দুঃখ আছে?’
আমি রাতে বাসে ফিরে বাড়ি ফেরার সময় জানালার কাঁচে গাল ঠেকায়ে তাকিয়ে থাকি আকাশের দিকে। ওইখানে বসে নাজনীন কি এখনো আমায় দেখে খুশি হচ্ছে? মনে হয় না। আমি তো এখন কষ্টে আছি। ওরতো খুশিতে থাকার কথা না। তারপরও আমার মনে হতে থাকে, হয়তো নাজনীন খুশিতে আছে। আমার ওকেও ওসমান গণির মতোই একজন মনে হয়। যে আমার অফিস মালিকের হাতে চাকুরীচ্যুতির সৌভাগ্যে আনন্দ পেয়েছে। আমার নিজেকেও এক সময় খুশি খুশি মনে হতে থাকে।
সেই খুশির রাতে আমি চুপি চুপি শান্তিনগরের একটা নির্মানাধীন বহুতল ভবনের ছাদে উঠে যাই। মিস্ত্রিরা ওই ভবনের ভেতরেই ঘুমিয়ে ছিলো। আমি ওদের দেখতে পাই। নয়তলা পর্যন্ত উঠে আমার আর কষ্ট করতে ইচ্ছে করে না। ওঠার কষ্টও করতে ইচ্ছে করে না, নামার কষ্টও না। চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে থাকি ফযরের আযানের সময় পর্যন্ত। তারপর লাফ দিই। লাফ দেয়ার ঠিক আগের মূহুর্তের আমি বুঝতে পারি, রাতের খুশি খুশি ভাবের নেপথ্যে এটাই একটা কারণ ছিলো।

পোস্টটি ৪ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

মীর's picture

নিজের সম্পর্কে

স্বাগতম। আমার নাম মীর রাকীব-উন-নবী। জীবিকার তাগিদে পরবাসী। মাঝে মাঝে টুকটাক গল্প-কবিতা-আত্মজীবনী ইত্যাদি লিখি। সেসব প্রধানত এই ব্লগেই প্রকাশ করে থাকি। এই ব্লগে আমার সব লেখার কপিরাইট আমার নিজেরই। অনুগ্রহ করে সূ্ত্র উল্লেখ না করে লেখাগুলো কেউ ব্যবহার করবেন না। যেকোন যোগাযোগের জন্য ই-মেইল করুন: bd.mir13@gmail.com.
ধন্যবাদ। হ্যাপি রিডিং!