গল্প: যে কারণে আরও একটু কাছে যাওয়া হয় না
১.
সোম থেকে শুক্রবার পর্যন্ত, যেসব দিনে আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই ঘড়ির কাঁটা আটের ঘর পার হয়ে যায়, সেসব দিনে আমাকে দেখলে আপনাদের অবশ্যই "দি ইনক্রিডিবলস্"-এর পিচ্চি ছেলেটা কিংবা "অ্যাভেঞ্জার্স: এইজ অব অলট্রন"-এর জমজদের মধ্যকার ছেলেটার কথা মনে পড়ে যাবে।
বুলেটের গতিতে আমি কফি বানাই, সিগারেট রোল করি, টয়লেটে যাই, অর্ধেক পথ যেতে যেতে মনে পড়ে টয়লেট পেপার আনা হয় নি। আবার ঘরে ফিরি, পেপার-তোয়ালে-শ্যাম্পু-শাওয়ারজেল-মি. ব্রাশো-পেস্ট-রেজার-ফোম, সবকিছু কোঁচড়ে নিয়ে দৌড় লাগাই।
২৫ মিনিটের মধ্যে সব কয়টা কাজ শেষ করে আবার রুমে ফিরি। টোস্টারে স্যান্ডউইচ বসাই। এক স্লাইস পাউরুটি, তার উপর এক পশলা মাখন, চৌকোনা করে কাটা চীজ, গোল করে কাটা পাতলা সসেজ, তার ওপর ঢেলে দিই একগাদা ম্যায়োনিজ, যেটা আমার খুবই প্রিয়, তার ওপর গেঁথে দিই দুই-তিনটা জলপাই এবং সবশেষে আরেক স্লাইস পাউরুটি চাপিয়ে বন্ধ করে দিই টোস্টারের ডালি। এইটাই মীর্স কেভের (Mir's Cave) সকালের আয়োজন।
১০ মিনিটের মধ্যে একবার স্যান্ডউচটা উল্টে দেয়ার পাশাপাশি আমাকে ওয়ারড্রোব খুলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকা এবং কোন শার্টটা পড়লে ভালো দেখা যেতে পারে- সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া, আফটার শেভ-পার্ফিয়ুম-ডিওডোরান্টের শ্রাদ্ধ ঘটানো, দুই পায়ের জন্য একই মোজার জোড়া খুঁজে বের করা এবং জুতার ফিতে বাঁধার মতো "সামান্য" কাজগুলো শেষ করতে হয়।
৮টা ৩৫-এ আমার প্যালপিটিশন বাড়তে শুরু করে। এরই মধ্যে স্যান্ডউইচ শেষ করে, ল্যাপটপটা কোনমতে ব্যাগে গলিয়ে, চাবি খোঁজা শুরু করে দিই। ওইটার পাওয়া-না পাওয়ার ওপর নির্ভর করে পুরো দিনের ভাগ্য। যদি চাবি পেতে দেরি হয়, তাহলে এত দৌড়াদৌড়ির সবই বৃথা যাবে জানি; কিন্তু খেয়াল করে দেখেছি যেসব দিনে চাবি খুঁজে পেতে দেরি হয়, সেসব দিন আমার আসলেই ভালো যায়। তবে ব্যাপারটাকে আমি সজ্ঞানে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। কেন সেটা বলছি একটু পরেই।
আর চাবি সময়মতো পেয়ে গেলে তো হলোই। দ্রুত আমার গুহা ছেড়ে বের হয়ে, দরজা লক করে দৌড় লাগাই। প্রথমদিকে আড়াই কেজি ব্যাকপ্যাক পিঠে করে, আড়াই মাইল দৌড়ে ক্লাস ধরতে জান বের হয়ে যেতো। আজকাল কিছুই মনে হয় না। মানুষের শরীর একটা চমৎকার আয়োজন। না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
২.
ক্লাস মানে "এসপিএসএস"। জগতের সবচেয়ে দুর্বোধ্য এবং জটিল সফটওয়্যার। যেটা দিয়ে "ইম্পিরিক্যাল রিসার্চ" করা হয়। এখন ইম্পিরিক্যাল রিসার্চ কি সেটা জানতে চাইলে কিন্তু হবে না। একটা ব্লগের গন্ডিতে এই জিনিস ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। তাছাড়া আমার ব্যাখ্যাও সাধারণত "সাক্স"।
যাহোক সময়মতো এসপিএসএস ক্লাসে পৌঁছানোর সুবিধা হচ্ছে দুইটা। এক, টিচারের বোঝানোর ক্রমটা মিস্ হয় না মোটেও। দুই, রবার্ট, ইনা আর মিলোর পাশে বসে পুরো সময়টা দুষ্টামী করে করে কাটিয়ে দেয়া যায়। ইনা আর মিলো সফটওয়্যারটার খুঁটিনাটি সবকিছু জানে বলে, খুব বেশি মনোযোগ দেয়া দরকার পড়ে না।
"আইরনিক্যাল" শোনালো না কথাটা? তাড়াহুড়ো করে ক্লাসে যাচ্ছি, যাতে সবকিছু ঠিকমতো বুঝতে পারি। আবার বন্ধুদের পাশেও বসতে চাচ্ছি, যাতে সময়টাকে বোরিং হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানো যায়!
আসলে আমার পুরো জীবনই ভরে আছে আইরনিতে। যাক, এবার সময়মতো ক্লাসে না পৌঁছুলে কি হয় সেটা বলি। তখন আমাকে বসতে আমাদের ক্লাসের হার্টথ্রবের পাশে। ওর নাম বির্টে। সুপার টল, সুপার হট, স্কিনি আর চুলগুলো একদম হিউ গ্রান্টের মতো করে ছাঁটা। দেখলেই মনে হয়, দৌঁড়ে গিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে যাই।
এখানেও আইরনি। এত পছন্দ করি কিন্তু তারপরও ওর পাশে যাতে বসতে না হয়, সেজন্য আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করি সকালে সময়মতো ক্লাসে পৌঁছুনোর। কারণ ওর পাশে বসলে আমার মাথা হঠাৎ করে সব ধরনের কাজ-কাম বন্ধ করে দেয়। নিউরণেরা গালে হাত দিয়ে বসে থাকে। আমি টের পাই, সবাই মাথার ভেতর থেকে ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ভাগ্যটা ভাল নিউরণদেরকে বাইরে থেকে দেখা যায় না। নাহলে ওই মাত্রার স্টেয়ারিং সহ্য করে আমার পাশে বসে থাকা বির্টের জন্য কখনোই সহজ হতো না।
শুধু নিউরণেরা কাজ বন্ধ করে দিলেও হতো, হার্টও হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়া ধীর হয়ে যায়। বিট কমতে কমতে ষাট-বাষট্টিতে নেমে আসে। কয়েকদিন ওই অবস্থার ভেতর দিয়ে যেয়ে আমি ঠিক করেছি, দরকার নেই আমার দিন ভালো যাওয়া। তারচেয়ে বরং ক্লাসে তাড়াতাড়ি গিয়ে একটা পুরো খারাপ দিন পার করাই ভালো।
বির্টে অবশ্য আমাকে পছন্দই করে। পছন্দের বিষয়টা বোঝা যায় খুব সহজে। তবে সেটা ধরে রাখাটা অতোটা সহজ না। আশ্চর্যজনকভাবে ওর পছন্দটা আমি ধরে রেখেছি ঠিক একইভাবে, যেভাবে আমার পছন্দটা সে ধরে রেখেছে। ও প্রায়ই নিজের লাঞ্চ আমার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চায়। আমি দু'একদিন খেয়ে দেখেছি, মেয়েটা দারুণ "ভেজ-উইচ" বানায়। ভেজটেবল স্যান্ডউইচকে আমার বন্ধুরা ভেজ-উইচ বলে ডাকে।
বির্টে অনেকবার ওর প্রাইভেট পার্টিগুলোতে আমাকে ইনভাইটও করেছে। যদিও কখনো যাই নি। তবে প্রত্যেকবারই পার্টির পরদিন ওকে কোনো একটা শক্ত অজুহাত দেখাতে হয়েছে। এমনি এমনি সে কোনদিন ছাড় দেয় নি। ওর সঙ্গে আমার জগতের অনেক বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে। যার মধ্যে গ্রীসের অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব এবং ইংল্যান্ডের ইউরোস্কেপটিক মনোভাবের মতো শুকনো, রস-কষহীন বিষয় যেমন আছে, তেমনি বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড সংক্রান্ত আগ্রহোদ্দীপক বিষয়গুলোও আছে। বির্টে যখন বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে আমাকে মাস তিনেক আগে ওর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ব্রেক-আপের ঘটনা বলছিল, তখন আমি চোখে একটা সহানুভূতির দৃষ্টি ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, মনে আছে।
নিকোলাস, ভিনসেন্ট, ইনাসহ আমার আর যে কয়টা বন্ধু আছে, ওরা মাঝে মাঝেই জিজ্ঞেস করে, "কেন আমি বির্টের কোনো দাওয়াতে যাই না এবং কেন ওকে আমাদের বিয়ার-পং পার্টি, আইরিশ পাবে গিয়ে ফুটবল খেলা দেখা, দল বেঁধে জ্যাজ কনসার্ট দেখতে যাওয়া কিংবা এরফুর্টের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বিয়ার পানের মতো ইন্টারেস্টিং ইভেন্টগুলোতে ইনভাইট করি না"? "কেন আমি ওর আরও একটু বেশি কাছে যাই না"?
রবার্ট আবার এককাঠি বেশি সরেস। ফস করে জিজ্ঞেস করে বসে, "কেন আমি বির্টের মতো চমৎকার একটা মেয়ের কাছে এখনও আমার জার্মান ভার্জিনিটি বিসর্জন দিচ্ছি না?" যদিও সে আমার এই বিষয়টা সম্পর্কে কিছুই জানে না।
ওদের প্রশ্নের জবাবে আমার সাধারণত হাসি ছাড়া আর কিছু দেয়া হয় না। মাঝে মাঝে কৌতুক করি। তারপর বিকেলের দিকে ঘড়ির কাঁটা গড়াতে শুরু করে। ৯টা থেকে ১টা পর্যন্ত টানা এসপিএসএস করে আমাদের বেশিরভাগই অর্ধমৃত অবস্থায় পৌঁছে যাই। মধ্যে মাত্র ১৫ মিনিটের একটা ব্রেক দেয়া হয়। সে সময়টায় আমি নিচে নেমে কফি আর বিড়ি ধ্বংস করি। এই দেশে কড়া লিকারের দুধ-চিনি কম চা পাওয়া যায় না।
ক্লাস শেষ করে বেশিরভাগ দিন ছুট লাগাই মেনসার (ক্যাফেটেরিয়া) দিকে।
ছেলেপিলের সঙ্গে বসে রাজ্যের সব "আনপ্রোডাক্টিভ" ব্যাপারে আলাপ করতে করতে লাঞ্চ সারতে খারাপ লাগে না। দেড়টার সময় আবার ছুট। এইবার টানা দুইটা থিওরি কোর্স। লেকচার শুনতে শুনতে ঘুমায় পড়লে চলবে না। তাহলে টিচার বেজার মুখ করে জিজ্ঞেস করবে, আমি কি এতই বোরিং যে, তুমি ঘুমিয়ে পড়লে মাই ডিয়ার?
টিচারকে কেমনে বোঝাই, দোষ উনার না। ভরদুপুরে মেরিল স্ট্রিপও যদি এইরকম লেকচার দেয়া শুরু করে, কয়েকজন অবশ্যই ঘুমায় পড়বে। বিশেষ করে, তার ঠিক আগে আগেই যদি পুরোমাত্রায় উদরপূর্তি করা হয়ে থাকে।
৩.
দিনের এ দু'টি ক্লাস যতক্ষণে পুরোপুরি শেষ হয়, ততক্ষণে আমিও মনে মনে নিঃশেষ হয়ে আসি। অনেক দূরে টিমটিম করে জ্বলতে থাকে একটা অদেখা হারিকেন। হয়তো কোনো দুরপাল্লার মাঝি প্রিয় যমুনার বুকে নৌকা বাইতে থাকে। আমি দেখতে দেখতে ভাবি, তোমাকে নিয়ে একবারও যমুনা দেখতে যাওয়া হয় নি। কত মানুষ আমার সঙ্গে যমুনা পাড়ের ঘাটগুলোতে ঘুরতে গিয়েছে, অথচ তোমার সঙ্গে প্রিয় নদী দেখতে যাওয়ার সুযোগ পাই নি আমি!
মীর্স কেভের পথে হাঁটতে হাঁটতে এক পর্যায়ে সকালের বিকল নিউরণেরা পুরোদমে সচল হয়ে ওঠে। সন্ধ্যার মায়াঘেরা ঝাপসা আঁধারে আমার মনে পড়ে যায়, শেষ রাতটিতেও তুমি আমার ভেতরে গুটিশুটি হয়ে ঢুকে পড়েছিলে এবং ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগের সেকেন্ডে বলেছিলে, "আই লাভ ইউ"।
জানতাম না, সেটাই শেষবারের মতো তোমার কাছ থেকে শোনা 'আই লাভ ইউ' হবে। জানলে অবশ্যই আরও কয়েকবার কথাটা জানতে চাইতাম।
ভিনসেন্ট, এন্ডার, মিলোদেরকে কখনও বলা হয় নি, আমি আজকাল কারো প্রতিই মন থেকে টান অনুভব করি না। তাই সন্তপর্ণে সবার থেকে দূরে থাকি। শুধু শুধু তো মানুষের সঙ্গে জড়ায়ে কোনো লাভ নেই, তাই না?
---
মীর রাকীব-উন-নবী
ইলমিনাউ, জুন ৬, ২০১৫ ইং
সুন্দর স্যান্ডউইচ বানানো শিখলেন, এসপিএসএস শিখতাছেন, আরো কত কি শিখবেন, জানবেন। তাই দিনশেষে বিরহে না থেকে নতুন নতুন অনেককিছুই শিখতে থাকেন
জ্যোতি আপু, কাকে বললেন কথাগুলা? গল্পের ছেলেটাকে?
হ। কারে আর কমু! আপনারে কই নাই!!!!
আচ্ছা, দেখি ছেলেটাকে পাওয়া যায় কিনা। পাইলে আপনের মেসেজ পৌঁছায় দিবো
সকাল সকাল মেয়োনীজ .।.।.।.।। এহ
ডর্মিটরির জীবন আসলে এমনই আপু
ওই একটা 'আই লাভ ইউ' দিয়ে কতোদিন বেঁচে থাকা যায়, বলো?
কথা সৈত্য জনাব
জনাব
শেষ করার যেন খুব তাড়া ছিল! গল্প শুরু করে বলছে ত বলছেই হুট করে মনে হলো দেই শেষ করে তাই এম্নে আচমকা হ্যাচঁকা টানে ব্রেক কষলেন!!
লেখাটা বড় হয়ে যাচ্ছিলো অনেক। তাই ঝটপট ভূমিকা শেষ করে আসল পয়েন্টে চলে এসেছিলাম
মন্তব্য করুন