টক-ঝাল-মিষ্টি ছেলেবেলা - ঝাল পর্ব
ছেলেবেলার জীবনটা আমাদের বড় অন্যরকম ছিল। যা আজকালকার শিশুদের যাপন করতে হয় না। যদিও শিশুদের ঠিক কি জীবন আজকাল আমাদের দেশে যাপন করতে হয়, তা নিয়েও আমার তেমন সুনির্দিষ্ট ধারণা নেই। তারপরও বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন আর ইন্টারনেটে পাওয়া তথ্য থেকে মনে হয়েছে, আমাদের সময়ের সেই টক-ঝাল-মিষ্টি শিশুকাল আজকালকার বাচ্চাদের নসিবে কমই জোটে।
আমাদের সময় শহুরে ডানপিটে বাচ্চাদের মাছ ধরা, সে মাছ বৈয়ামে ভরে রাখার একটা ব্যাপার ছিল। কত যে স্কুল শেষে চট্টগ্রাম শহরের সিডিএ ৪ নং রোডের শেষ প্রান্তে অবস্থিত চিকন একটা খালের আশপাশে এভাবে মাছ ধরেছি ইয়ত্তা নেই। স্কুল শেষে সরাসরি বাসায় চলে আসার আদেশ ছিল। কিন্তু জীবনে তেমন কোন আদেশই আমি শিরে ধারণ করতে পারি নি। কেউ আদেশ দিলেই তাকে প্রতিপক্ষ মনে হতো। কেননা পছন্দসই কোন কাজের আদেশ তো কেউ দিতো না। আমাদের সময় ৫০ বা ১০০ টাকার মান অনেক বেশিই ছিল। কেউ কখনো ওরকম কোন একটা নোট হাতে ধরিয়ে আদেশ দিতো না যে, এই যে ১০০ টাকা, ইচ্ছেমতো খরচ করো। কিংবা আমাদের সময় ছেলেপিলেদের খেলার জন্য খোলা মাঠের খুব একটা কমতি ছিল না। কিন্তু কেউ কখনো দরজা খুলে ধরে আদেশ দিতো না, যাও যতক্ষণ খুশি খেলাধূলা করে এসো। এমন কোন পছন্দের আদেশই জুটতো না কপালে। জুটতো যত্তোসব "ফালতু" আদেশ!
দু'চারটা নমুনা দেবো? স্কুলের অন্যতম আদেশ চুল বড় রাখা যাবে না। আইস্ সালা! আমার চুল আমি কি রাখবো আমার ব্যাপার না? নাকি? নাকি আমার চুলের দৈর্ঘ্যের জন্য স্কুলশিক্ষককে ইঞ্চিপ্রতি অতিরিক্ত খাজনা দিতে হতো রাজাবাহাদুরের কাছে? কিছুই না। ফালতু একটা যুক্তিও দেয়া হতো, ওইতে নাকি "ডিসিপ্লিন" শেখে মানুষ!!!
হ বাংলাদেশ নিয়মানুবর্তিতার সূচকে এক নম্বর দেশ না দুনিয়াতে? শান্তির সূচকেও তো এক নম্বর, তাই না? প্লাস এরকম যত ভাল ভাল মিটার আছে, সবগুলাতেই বাংলাদেশের টাংকি ভরপুর। ঠিক কি না? বিশ্বের সব দেশের তরুণ, যুবক আর কর্মঠ মানুষেরা আমাদের দেশে এসে ভবিষ্যত গড়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে না একদম?
আসলে তা না। আসলে আমরা ভেতরে-বাইরে স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, পরশ্রীকাতর, সুবিধাভোগী একটা জাতি। যার নিজের ধান্দা ছাড়া আর কোনকিছুই নেই। ইদানীংকার মহাক্রেজ হচ্ছে ধর্মব্যবসা, যার পেছনেও শুধুই ধান্দাবাজি। ছয়-পাঁচজন মনে হয় ভাল মানুষ আছে, বাকি সব ধান্দাবাজ। সেরেফ ধান্দাবাজ।
তাই আদেশ অমান্য করে স্কুল শেষে যাওয়া ছাড়া আর কখনোই ভাল সুযোগ ছিল না হাতে হাতে মাছ ধরতে যাওয়ার। সেবার তেমনি এক মাছ ধরার উদ্দেশ্যে বের হওয়া দুপুরে একটা মজার ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। আমাদের সঙ্গে গিয়েছে মাছ ধরতে এমন একটা ছেলের এক পাটি স্যান্ডেল কাদায় হারিয়ে গিয়েছিল। বেচারা জানতো, তার বাসায় ওই এক পাটি স্যান্ডেলের জন্য অন্তত দুই পাটি খড়ম ঘাড়ে আর মাথায় ভাঙ্গা হবে। তাই ভয়ে জবুথবুই ছিল ছেলেটি। আমরা অনেক খুঁজলাম। কিন্তু পেলাম না তার এক পাটি স্যান্ডেল। শেষে সন্ধ্যা প্রায় হয়ে যায় দেখে, ভয়ে কাতর হয়ে থাকা ছেলেটাকে জোর করেই বাসায় পৌঁছে দিয়ে যার যার বাসায় চলে গেলাম।
সেদিন মধ্যরাতে আমাদের এলাকা ওই ছেলের মায়ের আহাজারি আর বাপের হম্বিতম্বিতে মুখর হয়ে উঠলো। তাও আবার সব আমার বাসার সামনে। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে বাইরে এসে জানতে পারলাম, ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না সন্ধ্যা থেকে।
ছেলের বাপের দাবি, আমাকে জেলে দিতে হবে। কেন দিতে হবে সেটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করছে না। আমার জন্মদাতা, জন্মদাত্রীরাও বিনাবাক্য ব্যায়ে মেনেই নিলেন যে আমাকে জেলে দিতে হবে। যদিও কেন সেটা তখনও কেউ জানে না।
শেষমেষ কাহিনী বের হলো। ছেলেকে তো আমি বাসায় পৌঁছায় দিয়েই এসেছিলাম। তারপর তার বীরপুঙ্গব বাপ একপাটি স্যান্ডেলের জন্য দুই পাটি খড়ম আসলেই ওর মাথায় ভেঙ্গেছিল। ভেঙ্গে বের করে দিয়েছিল বাসা থেকে। বলে দিয়েছিল, যেখান থেকে পারিস স্যান্ডেল খুঁজে নিয়ে আয়। ছেলে তখন থেকে লাপাত্তা।
আর এই কারণে নাকি জেলে দিতে হবে আমাকে!!!
আজকাল এরকম কোন ঘটনা ঘটে না চোখের সামনে কিংবা আশপাশে। কিংবা আমার সাথে। ওইদিনের ওই পাষণ্ড বাপকে নিজের হাতে স্যান্ডেল পেটা করার অপূর্ণ খায়েশটাও একসাথে মিটিয়ে নিতে পারতাম, তেমন কিছু দেখতে পেলে।
তো যা বলছিলাম, আজকালকার শিশুদের অনেক কিছুই সহ্য করতে হয় না আমাদের কালের মতো করে। এতে ভাল হচ্ছে না মন্দ হচ্ছে তার বিচারের ভার আপনাদের হাতেই তোলা থাক। আমি শুধু বলি, দিন দিন আমাদের দেশের সবরকম অবস্থা খারাপ হচ্ছে। তাই আগেও খুব ভাল কিছু যে হয়েছে, তা না। আর এখনও খুব ভাল কিছু যে হচ্ছে, তাও না। কি করে হবে?
আমার মনে হয় কখনোই হবে না। আপনারা বরং সবাই বিভিন্ন দেশের এম্বেসিগুলোর সামনে লাইন দেন। নিজে ভাল থাকতে পারলে, অন্যদের অন্তত একটু হলেও শান্তিতে রাখা যায়। এইটুকু মন্দের ভাল জীবন যাপন করতে পারা ছাড়া এই দেশের আমজনতার আর কিছু করা সম্ভব বলে মনে হয় না। যারা আমজনতা নন, কাঁঠালজনতা- তাদের কথা আলাদা।
কারণ কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল। তেমনি কাঁঠালজনতাও আমাদের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ জনতা। আপনি যদি তাদের দলের হয়ে থাকেন, তো এই দেশ আপনার জন্য স্বর্গ। বাইরে গিয়ে এই আপনিই হয়তো হাতে গ্লাভস পরে বাচ্চাদের হাগুমাখা কমোড পরিস্কার করবেন। মাঝে মাঝে দু-চার টুকরা বেবি-পু আপনার গ্লাভসের ভেতর ঢুকে গেলেও রা করবেন না। কিন্তু এই দেশের গরীবের গলায় সামান্য কারণে পা তুলে দিতে আপনি দ্বিধা করবেন না। জানি আমি। তাই বলছি, আপনাকে এম্বেসিগুলোর সামনে গিয়ে লাইন দিতে হবে না।
মন্তব্য করুন