খুঁজে নেবো
কেন একদিনও ভুলে থাকা যায় না? কেন অন্য কারও কথা ভাবলে শুধু সেই অন্য জনের কথাই ভাবতে থাকা যায় না? কেন মাঝামাঝি কোনো একটা জায়গায় গিয়ে হারিয়ে যাই প্রতিবার, সেই সব সন্ধ্যার, কোনো একটায়।
যখন ৪০ ডিগ্রীর একেকটা দিন শেষে আমরা দু'জন অফিস থেকে বের হয়ে একসাথে ক্যাম্পাসে ফিরতাম। গরমে সারাদিন যে পরিমাণ অশান্তি মনে জমা হতো, সেগুলো সব ধুয়ে যেতো তোমার স্পর্শে। তুমি বসে থাকতে আমার কাঁধে হাত দিয়ে। একবার কাওরান বাজারে বাংলাভিশন অফিসের সামনে কি নিয়ে যেন একটা ঝগড়া হয়ে যাবার পর থেকে তুমি সাইকেলে অনেকদিন দু'দিকে পা দিয়ে বসতে না।
সেরকম কোনো একটা সময়ে, আমরা দু'জন সাতটা-সাড়ে সাতটার দিকে ঘন্টায় ৭৫ কিমির আশপাশে ছুটছিলাম। আমাদের কপ্টারে চড়ে। ধানমন্ডি ২৭ নং রোড দিয়ে বের হয়ে প্রথমে পড়লাম লালমাটিয়ার জ্যামে। ৫ মিনিটের যাত্রাবিরতি। আমরা গল্প করছিলাম কল্পনাদি'কে নিয়ে। তোমার নতুন বস্। তুমি যাচ্ছিলে নতুন বসের কাছে নিজেকে উপস্থাপন করার পর্বের ভেতর দিয়ে। তাই তোমার অনেক প্রশ্ন ছিল। সেসব নিয়ে কথা বলতে বলতে তোমাকে অনেকখানিই রেগে যেতে হচ্ছিল। আর তখনই জ্যামটা ছেড়ে দেয়ায় আমাকেও হাতের ক্লাচটা টেনে ধরতে হয়েছিল।
তখন এক পশলা দিকহারা ঝড়ো বাতাস কালবৈশাখী পাখির ডানা থেকে ঝরে পড়া পালকের মতো শহরটার মধ্যে দিয়ে অনিশ্চিতভাবে বয়ে যাচ্ছিল। আমরা বাতাসটাকে পেয়েছিলাম মানিক মিয়া এভিনিউয়ের মাঝামাঝিতে, সংসদ ভবনের ঠিক সামনে। তখন চারদিকে কেবল আঁধারটা নামতে শুরু করেছে। রাস্তার বাতিগুলো জ্বললেও সবগুলো গাড়ির হেডলাইট জ্বলে নি। বাতাসটা আমাদের দু'জনকেই খানিকটা টালমাটাল করে দিয়েছিল। তবে শুধু মনেই সম্ভবত।
ফার্মগেটের জ্যামটা আসলে শুরু হয় কাওরান বাজার থেকে। ঠেলেঠুলে ওভারব্রীজ পার করে হাত-পা ছেড়ে দিতে হলো। কোথা থেকে যেন বিরিয়ানী আর চিকেন গ্রীলের গন্ধের একটা মিশ্রণ ভেসে আসছিল। সেটা নাকে যেতেই দু'জনের একসাথে মনে পড়ে গেল অনেকক্ষণ কিছু খাওয়া হয় নি। তুমি খেয়েছিলে সেই দুপুরে। অফিসের কলিগের সাথে। খেতে যাওয়ার জন্য তোমাকে রাস্তা পার হতে হয়েছিল। রাস্তা, যেখানে চড়ে বেড়ায় অসুস্থ ধরনের দেখতে কিছু যানবাহন। আর আমার জানা ছিল তুমি রাস্তা পার হতে জানো না। তোমাকে নিয়ে শাহবাগ মোড় পার হতে আমার সবসময় এক্সাইটেড লাগতো। কারণ সে সময়গুলো ছিল মাল্টিটাস্কিংয়ের। একই সাথে তোমার হাত ধরে রাখা, তোমার কর্মকাণ্ডের কারণে সৃষ্ট হাসিগুলো চেপে রাখা এবং রাস্তার দিকেও খেয়াল রাখা। আর তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে হলে মাঝে মাঝে ঝুঁকি নেয়ার হিসাবটাও মাথায় রাখা।
দুপুরের খাবারের ব্যাপারে আমরা শুধু আইটেম আর স্বাদ সংক্রান্ত কথা বলেই আলোচনা থামাতে পারতাম না। খেতে যাওয়ার পথে কোথায় কি হয়েছে, খেতে বের হওয়ার সময় কিভাবে সবাই মিলে বের হওয়া হয়েছে; এইসব নিয়ে কথা বলতে গিয়েও, অনেক সময় মূল আলোচনা থেকে অসীম দুরত্বে পাড়ি দেয়া হয়ে যেতো। হয়তো আর ফেরাই হতো না, সেই পুরোনো কথায়।
একটা সময় প্রতিদিন স্বাভাবিক নিয়মে সূর্য উঠতো, কিন্তু আমরা দেখতে পেতাম না। আমরা দেখতাম শুধু আমাদের। একটা সময় অনন্ত আনন্দ ফুল হয়ে ফুটে থাকতো, কিন্তু আমরা সেদিকে যেতাম না। আমরা যেতাম শুধু আমাদের দিকে। উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে জাহাজ বন্দরে ভিড়তো, মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়তো দেখার জন্য, সেই ভিড়ে আমরা ছুটে বেড়াতাম নিজেদের খুঁজে পাওয়ার আশায়। একটা সময় সাত রং গুছিয়ে সূর্যিমামা অস্ত যেতো; রঙের ছটা সোনালী আগুন হয়ে বিছিয়ে থাকতো তার চলে যাওয়ার পথে, আমরা সেদিকে তাকাতাম না। আমরা তাকিয়ে থাকতাম শুধু আমাদের দিকে। একটা সময় আমরা আমাদের ধমনীতে আর শিরায়; রক্তের কণিকা হয়ে ঘুরতাম, একসাথে, হাত ধরাধরি করে। একটা সময় আমরা প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে, প্রতিটি ঘটনার মধ্য দিয়ে; শিশুর মতো অপরিসীম আগ্রহে নিজেদের আবিস্কার করতাম। একটা সময় আমরা আমাদেরকে জড়িয়ে ধরবার অপেক্ষায় অধীর হয়ে থাকতাম। একটা সময় কোনো এক মহাজাগতিক বুদবুদের কৌটা থেকে একটা ছোট্ট প্রাণ বের হয়ে পড়েছিল, সে খুঁজে পেয়েছিল ঠিক তারই মতো বাড়ি পালানো আরেকটা ছোট্ট প্রাণকে। তারা দু'জন খুব অল্প সময়ের জন্য কাছাকাছি ছিল।
তারপর তাদেরকে লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ দূরে সরে যেতে হয়েছিল। একটা গভীর বেদনার সুর তাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অনেককাল ধরে বেজে চলছে। এটা বাজতেই থাকবে। কেননা প্রাণের কোনো মৃত্যু নেই। বির্বতনের যে পর্যায়টাতে এখন আমি আছি, এখানে থাকতে পারার জন্য নিজেকে একপ্রকার সুখীই ভাবি। এর চেয়ে ভাল অবস্থাতেও থাকা যেতো, যেমন আজ থেকে যদি পঞ্চাশ বছর পরেও জন্মাতাম, তাহলেও অনেক নতুন নতুন আবিস্কার জীবনে প্রত্যক্ষভাবে দেখার বা ব্যবহারের উপায় খুঁজে বের করতে পারতাম। হয়তো টাইম মেশিনে চড়ে ফিরে যেতে পারতাম আবারও আমাদের দু'জনের সেইসব দিনগুলোয়। হয়তো, তবে এ সময়টাও মন্দ না।
অন্তত এখন আমরা জানি যে, আমরা সবাই একেকটা নক্ষত্রচূর্ণ। অনুমান করতে পারি যে, আমাদের আসলে বিলুপ্তি হবে না। মৃত্যুর পর কণায় কণায় বিভক্ত হয়ে ধূলায় মিশে যাওয়ার মাধ্যমে আবার প্রকৃতিতেই ফিরে যাবো। আমার ডিএনএ রয়ে যাবে কোনো এক ক্ষুদ্র প্রাণীকোষের ভেতরে। কিংবা এস্টেরয়েড হয়ে মহাশূন্যে ভাসমান অবস্থায় হয়তো বা। অনেক মিলিয়ন বছর পর আমি হয়তো আবারও ফিরে আসবো বিবর্তনের চেনা পথটুকু ধরে কিংবা নতুন কোনো অচেনা পথ পাড়ি দিয়ে, এবং অতি অবশ্যই ফিরে আসবে তুমিও। এবং আমি জানি তুমি নিশ্চিত, আমি আর তুমি খুঁজে নেবো আমাদের আবারও।
তার আগ পর্যন্ত উত্তরের পুরোনো দেবতাদের কৃপায় ভাল থেকো।
---
প্রথম প্যারাটাই যথেষ্ঠ ছিল, পুরাই ধ্বংসাত্মক!
হাহাহ ধন্যবাদ বাউন্ডুলে (:
মন্তব্য করুন