গল্প: সম্ভব শুধু প্রাণপনে পোকার ফেস ধরে রাখার চেষ্টা করা
১.
ইয়াহু মেইলের ভক্ত ছিলাম অনেকদিন। সম্ভবত ২০০১-০২ থেকে নিয়ে ১১-১২ পর্যন্ত। তারপর একদিন জিমেইলে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়েছিল, একটা জরুরি দরকারে। এক সন্ধ্যায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ই-মেইল পাঠাতে হয়েছিল, কিন্তু যেকোন কারণেই হোক সে সময় ইয়াহু'র সার্ভার ভীষণ ব্যস্ত ছিল। অনেক চেষ্টা করেও ইয়াহু খুলতে না পেরে, শেষমেষ একটা জিমেইল অ্যাকাউন্ট খুলে মেইলটা পাঠাতে হয়েছিল। পাঠানোর পাঁচ মিনিটের মাথায় উত্তর এসেছিলো- ধন্যবাদ, যথাসময়ে ই-মেইল পাঠানোর জন্য আপনাকে আমাদের পরবর্তী পর্যায়ের যাচাই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভূক্ত করা হলো।
ওটা ছিল একটা চাকুরীর আবেদন প্রক্রিয়া। সফলভাবে সে প্রক্রিয়া শেষ করার পর একটা সংবাদ সংস্থায় বছরখানেকের জন্য কাজ নিয়েছিলাম। ওই জিমেইল অ্যাকাউন্ট খোলার পর আর কখনও পুরোপুরি ইয়াহুতে ফিরে যাওয়া হয় নি। আস্তে আস্তে ইয়াহুর প্রায় সব যোগাযোগকে জিমেইলে স্থানান্তরিত করে সেখানেই থিতু হয়েছি। ছেলেবেলার আবেগ আঁকড়ে ধরে সেই সন্ধ্যায় ইয়াহু খোলার চেষ্টাই যদি শুধু করতে থাকতাম, তাহলে হয়তো জীবনের অনেকগুলো নতুন অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান কখনও অর্জনই করা হতো না।
যাক, আজকের গল্প সেই পুরোনো ইয়াহু মেইলের এক ফোল্ডারে খুঁজে পাওয়া একটা চিঠি নিয়ে। চিঠিটি লিখেছিল সেই মেয়েটি। সে দারুণ চিঠি লিখতে জানতো। ওর লেখা চিঠিগুলো বহুবার বদলে দিয়েছিল আমাদের সম্পর্কের গতিপথ। অনেকবার এমন হয়েছে যে, আমি ওকে চিরকালের জন্য ভুলে যাওয়ার শপথ করে বাড়ি ফিরে গোসল করে, খেয়ে-দেয়ে, মনের সুখে নতুন জীবন যখন উপভোগ করছি এবং মনের ভেতরকার চিনচিনে ভাবটাকে পাত্তা না দেয়ার চেষ্টা করছি; ঠিক তখনই মনিটরের কোনায় ভেসে উঠেছে চিঠির আগমনী বার্তা। অনেকবার এমন হয়েছে চিঠি শেষ করার আগেই ফোন করে বসতে হয়েছে। শপথ আর প্রতিজ্ঞার বাঁধ ভেঙ্গে পাহাড়ি ঢলে ভেসে যেতে হয়েছে।
২.
যারা পাহাড়ি ঢল কখনও দেখেন নি, তাদের পক্ষে ব্যাপারটা বোঝা কঠিন হবে। তাই একটু উদাহরণ দেয়ার চেষ্টা করা যাক। আমি একবার লামা বাজারের খেয়াঘাটে একটা দড়িবাঁধা নৌকায় পায়ের ওপর পা তুলে খুব আয়েশ করে শুয়েছিলাম, ভরপেট ভাত খাওয়ার পর। তখন সময়টা ছিল পড়ন্ত দুপুর। সকাল থেকে টিলায় টিলায় ঘুরেছি পাহাড়ি ফল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। দুপুরে সব নিয়ে ফিরেছি স্থানীয় বাজারে। নিজেই রাস্তার পাশে বসে বিক্রি করেছি প্রায় শ'খানেক টাকার বুনোকুল, বার্মিজ আম, লিচু, কলা, পেঁপে, জামরুল এবং নানা পদের ফল। নিজের হাতে গাছ থেকে পেড়ে আনা কিংবা তলা থেকে কুড়িয়ে নেয়া সেসব ফলের শরীরে কখনও এক ফোঁটা কীটনাশক পড়ে নি। দেখতে হয়তো জিনেটিক্যালি মডিফায়েড ফলের মতো সুদর্শন নয় কিন্তু স্বাদে, গন্ধে অতুলনীয়। তবুও পাহাড়ের কঠিন জীবনে সেই অসামান্য সুন্দরীতমাদের দাম খুবই সামান্য। এক বেলার কঠোর পরিশ্রমে লব্ধ ডালাভরা ফল বড়জোর বিকোয় শ'খানেক টাকায়।
যাহোক বিক্রি-বাটা শেষে বাজারের কোণার বিপ্লব শর্মার দোকানে গিয়ে একেবারে কোণার দিকের টেবিলটায় গিয়ে বসেছিলাম। ওটা আমার সবচেয়ে পছন্দের খাবারের দোকানের সবচেয়ে পছন্দের বসার টেবিল। বিপ্লব এবং তার বউ মিলে চালায় দোকানটা। বিপ্লব ম্যানেজার, বৌদি শেফ। আর দু'জন ক্ষুদে কর্মচারী আছে সার্বক্ষণিক সহযোগিতার জন্য। আমাকে হাত ধুয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসতে দেখে বিপ্লব এগিয়ে এসে জানতে চাইলো, কি দিয়ে ভাত খাবি বল? মাতামুহুরীর মধুপাগলা মাছ আছে। তোর বৌদি বেশি করে মরিচ দিয়ে রান্না করেছে। সঙ্গে কলমি শাক, আলু ভর্তা আর বেগুন ভাজি।
শুনে নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। আমি একটু পেটুক কিনা। তবে এমনিতেও আমার যখনই নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান মনে হয়, তখনই খারাপ লাগতে থাকে। এত খারাপ লাগতে থাকে যে, চোখের পানি ঠেকিয়ে রাখার জন্য কিছু একটা করা লাগে। অনেকদিনের সমস্যা। সমাধানের কোনো উপায় না পেয়ে নিজের মতো ব্যবস্থা বের করে নিয়েছি। পোকার ফেস ধরে বসে থাকি। ভেতরের খবর বাইরের কাউকে বুঝতে দিই না। পোকার ফেস ধরে রাখার কাজে মস্তিষ্ক ও চোখ দুই'ই ব্যস্ত থাকে বলে, চোখের পানির আর বের হওয়ার কথা মনে থাকে না। সেদিন বিপ্লবের কথা শুনে যখন নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছিলো, তখনও পোকার ফেস ধরে বসেছিলাম। বিপ্লব হাসিমুখে বলে গিয়েছিল, দুই মিনিট বয়, আমিও দুপুরে খাই নি, তোর সাথে খাবো, হাত ধুয়ে আসি।
সেই পড়ন্ত দুপুরে ভাত খাওয়া শেষে বন্ধু বিপ্লব আমাকে খেয়াঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিল। আমরা দু'জন দুই কাপ চা আর দুইটি প্রিয় গোল্ড লীফ সিগারেট হাতে নিয়ে মাতামুহুরীর দিকে তাকিয়ে গল্প করছিলাম। বিপ্লব বলছিল, পাহাড়ি ঢল নামতে পারে। লক্ষণ তেমনই মনে হচ্ছে। আমি ওর কথায় পাত্তা দিই নি। পাহাড়িরা প্রায় সবকিছুতেই পাহাড়ি ঢলের লক্ষণ দেখতে পায়।
চা-পান পর্ব শেষে দোকানে ফিরে যাওয়ার আগ মুহূর্তে আবারও দেখা হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিল ছেলেটা। আমি তাতে হাসিমুখে সায় দিয়ে উঠে বসেছিলাম একটা খালি নৌকায়। জানতাম মাঝি নৌকা বেঁধে রেখে খেতে গিয়েছে। খাওয়া শেষ হলেই ফিরে আসবে। ডাকাডাকি করে কিছু যাত্রী জোগাড় করবে। তারপর আমাদের নিয়ে রওনা হবে চম্পাতলীর ঘাটে। সেখান থেকে আমার ডেরার দুরত্ব ছিল মাত্র দুইশ' মিটারের হাঁটাপথ।
সেই পথ হাঁটার সময় আমি দেখতে পাবো পাহাড়ি শিশুদের কোলাহল। টং দোকানের মিশ্র পরিবেশ। হয়তো দুই মাস বয়সী বাচ্চাকে কোলে নিয়ে উদাস মুখে পথের পানে চেয়ে থাকবে কোনো মারমা রমণী। হয়তো অপেক্ষায় থাকবে তার প্রিয়তম মানুষটির ফিরে আসবার। আমি তাদের সবাইকে দেখতে দেখতে এক সময় পৌঁছে যাবো আমার ছোট্ট কুঁড়েঘরে। পুরোনো হয়ে যাওয়া ল্যাপটপটার ডালা উঠিয়ে হয়তো ছড়িয়ে দেবো কোনো মায়াবী সুরের ঝাঁকিজাল। তারপর জাস্ট চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়া। প্রিয় কোলবালিশ (যার নাম দিয়েছিলাম এইচপি) জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়া। সন্ধ্যা গভীর হলে আমার বাড়িওয়ালি প্লেটে ভাত সাজিয়ে নিয়ে আসবে জানি। তার আগ পর্যন্ত কেউ আসবে না আমার কাছে। সময়টুকু হবে শুধুই আমার।
এইসব ভাবতে ভাবতে নৌকার গলুইয়ে শুয়ে আরামে চোখ প্রায় বন্ধ করে ফেলেছিলাম। হঠাৎ যেন মনে হলো, কোনো একটা কিছুর ধাক্কায় আমি নিজের অবস্থান থেকে চার-পাঁচ ফুট শূন্যে উঠে গেছি। ধড়মড় করে উঠে বসতে গিয়ে আবিস্কার করলাম সারা শরীর ভিজে গেছে এবং নৌকারও অর্ধেক ভরে গেছে পানিতে। আর পরের মুহূর্তে টের পেলাম দ্বিতীয় ধাক্কাটা। এইবার প্রায় আট-দশ ফুট উচ্চতার ঢল। ভাগ্যটা ভাল ছিল তাই নৌকাটা ডুবলো না। উল্টালোও না। পাড়ে দাঁড়ানো জনতা ততক্ষণে আতঙ্কে চিৎকার শুরু করে দিয়েছে। কোত্থেক বিপ্লব দৌড়ে এসেছে একটা মোটা দড়ি নিয়ে। সেটা আমার দিকে ছুঁড়ে মারার চেষ্টায় নিজেকে বারবার বিপন্ন করে তুলছিল ছেলেটা। পানির টানে আমি তখন নৌকাসহ মাঝনদীতে। মুহুর্তকাল আগে যে নদীতে ছিল হাঁটুপানি, সেটা তখন তিনতলা দালানের সমান গভীরতা ধারণ করেছে। একের পর এক ঢল আসছে। আর নৌকাটাকে পাড়ের সাথে বেঁধে রাখা প্রায় ছিন্নভিন্ন দড়িটা ছিঁড়ে আমাকে নিয়ে সাগরের পথে পা বাড়াতে চাচ্ছে। আমি শক্ত করে নৌকার ছই ধরে দাঁড়িয়ে পাড়ের মানুষ দেখছি। প্রত্যেকবার দূরের বাঁক পার হয়ে ধেয়ে আসা পানির স্রোত দেখি আর ভাবি, এইবারই শেষ। হয় দড়ি ছিঁড়বে কিংবা নৌকা উল্টে যাবে। যেটাই ঘটুক, আমার সলিল সমাধি নিশ্চিত।
এটাই পাহাড়ি ঢল। বর্ণনায় তো আর সব আসে না, তাও যতোটুকু এসেছে তাকে ধরেন আশি বা একশ' দিয়ে গুণ করলে যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিখানি সৃষ্টি হয়, সেটাকে বলা যায় পাহাড়ি ঢলে ভেসে যাবার অনুভূতি।
৩.
সেই মেয়েটির চিঠিগুলোতে থাকতো অমন অসংখ্য পাহাড়ি ঢল। আমি পড়তে পড়তে বুঝতে পারতাম- সামনের অনুচ্ছেদে আসতে যাচ্ছে আরও একটা বিশাল স্রোত। এইবার ভেসে যাবো নিশ্চিত।
যখনই মনে হতো, আমার পক্ষে আর সেই স্রোতের সামনে দাঁড়ানো সম্ভব না, তখনই জাস্ট ফোনটা তুলে, ওর নাম্বারটা ডায়াল করে ফেলতাম। একবার ওর সাথে কথা বলে ফেলতে পারলেই, পৃথিবীটাকে আবার শান্ত, নিবিড়, আর মায়াঘেরা মনে হতো। বেঁচে থাকাটা যে আসলেই কতোখানি অসামান্য, সেটা আরও একবার অনুভূতিতে ধরা পড়তো। আরও একবার আমার মনে, ওর হাতে হাত রেখে রিকশায় পুরো ঢাকা শহরটা ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে জন্ম নিতো।
পুরোনো ইয়াহু ফোল্ডারে পাওয়া চিঠিটা আজ বহু বছর পর আরও একবার সেই পাহাড়ি ঢলে ভেসে যাবার অনুভূতি ফিরিয়ে এনেছে। কোনো পোকার ফেসই পারছে না আজ আর সফল হতে। চিঠির শেষ লাইনগুলোর কথা প্রবল বেগে নিউরণ থেকে নিউরণে ছুটে বেড়াচ্ছে- "তুমি যখন এই চিঠি পড়বে তখন হয়তো খুব বিরক্ত হবে আমার ওপর কিন্তু রাগ করতে পারবে না। কারণ তখন আমি থাকবো অনেক অনেক দূরে। একদম ধরাছোঁয়ার বাইরে। ওই তারায় ভরা আকাশে।"
আমি বিরক্ত হচ্ছি না একদমই, জানো? এখন আর ফোনে তোমার নাম্বার ডায়াল করে পৃথিবীটা শান্ত করে ফেলার কোন উপায় নেই। এখন সম্ভব কেবল একদিন নৌকার দড়ি ছিঁড়বে, সে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা। প্রাণপনে পোকার ফেস ধরে রাখার চেষ্টা করা।
---





উফ, অসাধারণ !!
এরকম ক্ষাণিকটা অভিজ্ঞতা আমারও আছে, পাহাড়ে।
তবে সেটা লিখে বুঝানো আমার কম্মো নয়।
সবাই কি আর মীর ?
ভালোবাসা।
হাহাহা, ধন্যবাদ মেসবাহ ভাই। ভাল থাকবেন। শুভেচ্ছা
ভাই এইসব ল্যাখেন ক্যান !
হাহাহ, ক্যান লিখলে কি হয়?
মন্তব্য করুন