এক জামরুল-রঙা বিকেলের গল্প
তুমি নাকি করতে চেয়েছো
ছোট্ট একটা সর্বনাশ?
জানো নিশ্চই, এই আমারই দেহের ভেতর
মৃত আত্মা করছে বাস।
মনিটরের কোণার ক্যালেন্ডারটায় একটা দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন এসে পড়েছে। বড় কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই একটা বছর পার করে আসলাম। ব্যক্তি পর্যায়ের অ্যাচিভমেন্ট। পৃথিবীর সবাই যদি কোনো দুর্ঘটনা ছাড়া একটা বছর পার করতে পারে, তাহলে সব অ্যাচিভমেন্ট জোড়া লাগিয়ে একটা শান্তির মহাকাব্য রচনা করা যাবে। অলীক স্বপ্ন। কিন্তু দেখতে সমস্যা কোথায়? জন লেননও তো অলীক স্বপ্ন দেখতো। আর চিৎকার করে বেড়াতো, ইউ মে সে আ'ম এ ড্রিমার।
লাইপছিশের সময়টা পার করে আসার পর এখন অবশ্য একটু খারাপ লাগছে। তবে অন্যদের মতো বেশি খারাপ লাগছে না। টোসিনকে কাল রাতে দেখেছি মুষড়ে থাকতে। বলছিল এখন আর সোমবার গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে কাজে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে হবে না, আই অ্যাম অলরেডি মিসিং দ্যাট। বললাম, যখন ঘুম থেকে উঠতে হতো রাত তিনটায় প্রতিদিন, তখন তো মনে হতো না তুমি কাজটা এত পছন্দ করো। সে ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, ঠিক। যখন তুমি একটা সময়ের মধ্যে থাকো তখন তুমি বোঝো না কি ফেলে যাচ্ছ। তারপর যখন সময়টা চলে যায় তখন খুব মন পোড়ায়।
কথাটা হয়তো সত্যি। আমার ক্ষেত্রে যদিও একটু ব্যতিক্রম। আমাকে কোনো কিছুই খুব একটা স্পর্শ করে না। নতুন জিরাফ মাঝে মাঝে খুব চেষ্টা চালায় কষ্ট দেবার। শেষমেষ নিজেই কষ্ট পেয়ে ক্ষ্যান্ত হয়। ক'দিন ধরে ওর মাথায় ভুত চেপেছে বিয়ে করার। বললাম, আরও পাঁচ বছর যদি প্রেম করতে পারো, তাহলে ভেবে দেখবো। শুনে সে কি রাগ!
আমি বুঝি না- মেয়েগুলোকে সত্যি কথা বললে রেগে যায় কেন? এর আগে একজনকে বলেছিলাম পাঁচ বছর পর বিয়ে করার কথা। সে কোনমতেই রাজি হয় নি। তাকে তখনই বিয়ে করতে হবে। শেষে আমিই খানিকটা দ্বিধা-দ্বন্দ নিয়ে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। ফলাফল- শূন্য। একটা বছরও একসাথে থাকা গেল না। অথচ আমি প্রথম থেকেই জানতাম। সেজন্য ওকে পাঁচ বছর অপেক্ষাও করতে বলেছিলাম।
মাঝে মাঝে ভেতরে ডার্ক সাইডের হাতছানি টের পাই। কেমন একটা ইভিল-ইভিল ফীল হয়। কিন্তু ডার্ক সাইডকে বেশি কাছে আসতে দিই না। সেদিন জিরাফটাকে বলছিলাম, তোমাকে ইদানীং সেক্সের সময় শুধু ভাল লাগে। শুনে চিৎকার দিয়ে উঠেছে, হু-য়া-দ্দা-ফাক ইউ'ভ জাস্ট সেইড? তাড়াতাড়ি সামলে নিলাম, না না কিছু বলি নি। তুমি তোমার কাজ করো। দ্যাখো কোনো ফাঁকে এককাপ কফি বানিয়ে দিতে পারো কিনা আমাকে। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। আবিস্কার করলাম ততক্ষণে আমি ওর হাতের নাগালে। লম্বাতো আমার চেয়ে একটু, মুহূর্তের মধ্যে বড় বড় পা ফেলে ধরে ফেলে।
তারপর খেলাম এক রাম-কেচকি। চার হাতে-পায়ে। যখন প্রায় দমবন্ধ হয়ে আসার জোগাড়, তখন বললাম- আই ওয়াজ কিডিং। তারপরে ছাড়লো। তবে ছাড়লে হবে কি? গটগট করে হেঁটে বের হয়ে গেল চোখের সামনে দিয়ে আর বলে গেল, নো সেক্স ফর ইউ এনিমোর। হায় রাম! বিষয়টা কচ্ছপকে পানিতে ফেলে শাস্তি দেবার মতো হয়ে গেল না? প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েছিলাম পেছন থেকে। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, ইউ হ্যাভ নো রিসপেক্ট ফর এনিবডি। দেখতে পেলাম ওর চোখের কোণে কিছু সংখ্যক ঝা চকচকে হীরকখন্ড জমেছে। তাই দেখে আমাকেও বের হতে হলো ওর পেছনে খানিক দৌঁড়ানোর জন্য।
ড্যামিট! কেন ফস করে ওই কথাটা বলতে গেলাম? হুদাই! মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চেপেছিল। ডার্ক সাইড! একবার ধরা দিলে সারা জীবন ওই সাইডেই থেকে যেতে হবে। শীট্! এখন ওর মন ভাল করি কিভাবে? ভাবতে ভাবতে কাছাকাছি গিয়ে বললাম- অ্যাই শোনো, তুমি যাচ্ছো যাও। নো প্রবলেম। কিন্তু তোমার চোখের কোণার হীরের টুকরোগুলো দিয়ে যাও। ওগুলো তো আমি বের করে এনেছি। আমার। তাই না?
মনে পড়ে গেল, যখন ক্লাউড সিটিতে ক্যাপ্টেন হান সোলো, প্রিন্সেস লায়া, আরটু, চুবাকা, থ্রিপিও-রা নেমেছিল মিলেনিয়াম ফ্যালকনের হাইপারডাইভ সেন্সর ঝালাই করতে, তখন ল্যান্ডো কাল্রিজিয়ান প্রিন্সেস লায়ার ওপর হালকা চান্স নিচ্ছিল, ফ্লার্টিং আরকি; হান সোলোর কিন্তু বেশিক্ষণ সেটা সহ্য হয় নি। 'হয়েছে হয়েছে ইউ ওল্ড স্মুদি' বলে দু'জনের মাঝখানে সে ঠিকই ঢুকে পড়েছিল।
আর মেয়েটাও এত নাইভ! আমার কথা শুনে চোখ মুছতে মুছতে আবার জিজ্ঞেস করে, তুমি সত্যিই বলছো আমার অশ্রুগুলো একেকটা হীরকখন্ড? তখন ব্যালেন্স ফিরিয়ে আনার জন্য বলতেই হলো, ও, ও, ডোন্ট গেট ককি। টিয়ার্স ফ্রম অল দি ডাম্ব বিউটিফুলস্ অফ দি ওয়ার্ল্ড আর পিসেস অফ ডায়মন্ড আই গেস্। বলতে ভয় হচ্ছিল না, কারণ জানতাম ততক্ষণে ওর রাগ পানি হয়ে গেছে।
রাস্তার মাঝখানে মানুষ-জনের কোনো তোয়াক্কা না করে চুমু দেয়ার অভ্যাসটা এখনও রপ্ত করতে পারি নি। ওই পরিস্থিতিতে আমি সবসময় অন্য কিছু ভাবার চেষ্টা করি। সেদিনও যখন ও 'ইউ গেস্ মাই অ্যাস্' বলে দুই হাতে আমার মুখটা টেনে নিয়ে ঠোঁটগুলোকে টুপটাপ নিজের ঠোঁটের ভেতর পুড়ে ফেললো, তখন আমি ভাবছিলাম- আসলে প্রথম কথাটায় ভুল ছিল। ছাড়া পেয়ে সেটাই বললাম সবার আগে। শোনো, আগের কথাটা ফিরিয়ে নিচ্ছি, তোমাকে শুধু সেক্সের সময় না; আরও ভাল লাগে যখন তুমি এইসব করো। কিন্তু রাস্তা-ঘাটে এসব করাটা একটু কমালে হয় না? দেখি আবার চোখ কটমট করে তাকানো শুরু করেছে ততক্ষণে।
আমি অবশ্য ওর নীল ও অসমান দুই চোখের মণিতে তাকিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম গোলকধাঁধাঁয়। মনে পড়ে গিয়েছিল, লং এগো ইন এ গ্যালাক্সি ফার ফার ওয়ে ঠিক এভাবেই একজন চোখ কটমট করে তাকিয়েছিল আমার দিকে। দিগন্তের আকাশটা তখন পাকা জামরুলের মতো লাল হয়ে ছিল। আমার স্মৃতিতে সেই ছবি এমনভাবে বসে গেছে যে, এখন যখনই কোনো কটমটে চোখের দিকে তাকাতে হয়, তখনই একবার আমাকে মনের টাইম-মেশিনে চড়ে অতীত থেকে ঘুরে আসতে হয়। একবার সেই প্রিয় চোখ দু'টোকে দেখে আসতে হয়।
হালকা ঝাকুনিতে বাস্তবে ফিরেছিলাম। জিরাফ জানতে চাচ্ছিল কোথায় খেতে যাওয়া যায়। মনে পড়ে গেল, আগের দিন বড় রাস্তার মোড়ের মঙ্গোলিয়ান দোকানটার দিকে ট্রামে বসা অবস্থায় চোখ পড়েছিল। ওখাকার ট্র্যাডিশনাল বুফে-তে ভূড়িভোজ করা যায় মাত্র ১৫ ইউরোয়। সেদিকেই হাঁটা দিলাম। সঙ্গী হাত ধরতে চাইলে, ঠান্ডা লাগছে বলে পকেটে হাত ঢুকিয়ে রাখলাম। পরে সে বাহু ধরে পাশে পাশে হাঁটতে থাকলো।
আর আমি ভাবছিলাম অতীতের কথা। আসলে যতোই মনিটরের কোণার ক্যালেন্ডারে দীর্ঘস্থায় পরিবর্তন আসুক না কেন, সব অতীতকে কিন্তু পেছনে ফেলে আসা যায় না। তবে স্মৃতিদের সাথে লড়াই চালিয়ে যাবার জন্য যে হেল্প দরকার, সেটা চাইলে জোগাড় করা যায়। একেকজনকে একেক জায়গা থেকে সেই হেল্প খুঁজে নিতে হয়। আমি বেশিরভাগ লড়াইয়ের জন্য শক্তির খোঁজে মাস্টার ইয়োডার কাছে যাই। ট্রেইন ইয়োরসেল্ফ টু লেট গো এভরিথিং ইউ ফিয়ার টু লুজ। মাস্টার ইয়োডার অমর বাণী।
জিরাফ অবশ্য কথাটা শুনলেই রেগে কাই হয়ে যায়। মানে কি? তোমার আর আমাকে ভাল লাগছে না? যেতে চাইলে নিজে যাও। আমাকে কেন বলছো?- যতক্ষণ না একটা পেল্লায় সাইজের ক্যাডবেরী চকলেটের বার কিংবা ওর প্রিয় ফ্লেভারের আইসক্রীম কিনে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছি, ততক্ষণ এই টাইপের স্টুপিড প্রশ্ন করে যেতেই থাকে। মনে হয় না ওকে কোনোদিন বোঝাতে পারবো যে, একদিন সময় আসবে যখন সত্যি চলে যেতে হবে। চলে যেতে খুব একটা কষ্টও হবে না। হয়তো হালকা খারাপ লাগবে, যেমনটা লাগছিল লাইপছিশে দু'মাস থেকে ফিরে আসবার সময়। তবে সেটা বড় কোনো কিছু তো না-ই, এমনকি মাঝারি কোনো কিছুও না। সেই সময়টাতে ওরও যেন খারাপ না লাগে, তাই মাস্টার ইয়োডার বুলি শোনাই। মেয়েটা বোঝে না।
---
মন্তব্য করুন