গল্প: চাঁদের আলোয় গ্রাফিতির নিচে দেখা রক্তলাল চুলের ওই গথিক মেয়েটি
১.
সেদিন ভোরে হাঁটতে বের হয়েছিলাম। ভোরে ঘুম থেকে হাঁটতে বের হবো- এমন একটা কথা কয়েক বছর ভাবার পর, সেদিনই প্রথম সেটিকে কাজে রূপান্তর করা সম্ভব হয়েছিল। অন্ধকার ভোরে পথে নামার আগে একটু দ্বিধা কাজ করছিল কিন্তু বাসা থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাপটা মুক্ত হাওয়া সব দ্বিধা-দ্বন্দ উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। শীতের শুরুতে যেভাবে বার্চের সব পাতা ঝড়ে যায়।
প্রত্যেকবার শীতের শেষে যখন নতুন পাতা গজায় আশপাশের সব গাছগুলায়- তখন আমার কেন যেন চোখটা ফেটে জল বের হয়ে আসতে চায়। চোখের পাতা টান টান করে রেখে আর বারবার ঝাপটিয়ে সামাল দেয়ার চেষ্টা করি। তাতে করে শেষ রক্ষা যে হয় না, তা না। তবে এক ফোঁটা জলের একটা ধারা ঠিকই চোখ থেকে গাল বেয়ে নেমে যায়, আমি টের পাই।
শীতের শেষে গাছের পাতায় নতুন প্রাণের উপস্থিতি কেন আমাকে কাঁদায় তা ভেবে বের করার চেষ্টা অনেক করেছি। লাভ হয় নি। আমার যেমন ভাল কিছু দেখলে কান্না পায়, তেমনি খারাপ কিছুতেও হাপুস নয়নে কাঁদি। কোথায়, কবে যে পড়েছিলাম কান্না নাকি খুব শক্তিশালী একটা অনুভূতি। যাকে চাপিয়ে রাখা যায় না। আমি তো দেখি এই আপ্তবাক্য পৃথিবীতে খুব কম সংখ্যক মানুষের জন্যই প্রযোজ্য এবং আমি তাদের একজন।
শীতের শেষে গাছে নতুন পাতা আসতে দেখে মনে পড়ে যায়, জীবনে কিছুই চিরস্থায়ী নয়। সুখ-দুখ শুধুই পালাক্রমে আসতে থাকা ঢেউ। কোন কোনটা বড়, কোন কোনটা ছোট। আমার ব্যাপারটা খেয়াল করে দেখেছি; আমার দুঃখের ঢেউগুলো যতো বড়, মানে একেকবার শুরু হতে - গড়ে উঠতে - চূড়ায় পৌঁছাতে - সেখান থেকে নামতে - সবকিছু স্বাভাবিক হতে, যে পরিমাণ সময় নেয়, সুখের কালগুলো পার হতে তার সিকিভাগ সময়ও কখনও নেয় না। জীবনটা বিচিত্র- এ কথা তাই অবাক করে খুব। জীবনটা তো বিচিত্র না। একদম সহজবোধ্য। দুঃখগুলো বড় বড়। সুখগুলো খুব ছোট ছোট। বুঝে ওঠার আগেই উড়ে যায় ফুড়ুৎ করে।
পার্কের ওইদিকে কতগুলো সাইবেরিয়ান চিত্রা হাঁস শীতকাল পাড়ি দেয়ার জন্য এসে জুটেছে। সাইবেরিয়ার তুলনায় কম ঠান্ডা, তাই খুব গা এলিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে লেকের বরফঠান্ডা জলে। ওদের দেখার জন্যই সূর্যের দিকে মুখ করে একটু বসেছিলাম। পাথরের বসার বেঞ্চি ছিল তাতে। পন্দ্রদেশ বেয়ে শিরশিরিয়ে ঠান্ডা মেরুদন্ড বেয়ে মাথায় গিয়ে ঠেকলো। আমি গা করলাম না। শীতের দেশে একটু শীত সহ্য করতেই হয়। লাইপছিশ নামের একটা শহরে একবার আড়াই মাসের জন্য কামলা দিতে গিয়েছিলাম। নভেম্বর, ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডায় রাত তিনটায় বাসে চড়ে কামলা দিতে যেতে হতো। সে তুলনায় এখনকার সূর্যমুখী আসনে বসে একটু শিশিরে প্যান্ট ভেজালে কিছুই যায় আসে না।
লাইপছিশের কথায় মনে পড়ে গেল শহরটা ভর্তি ছিল গ্রাফিতি দিয়ে। একটা ভবনের দেয়াল পাওয়া যাচ্ছিল না ওই আড়াই মাসে, যেটায় কোন না কোন গ্রাফিতি ছিল না। আর গথিক সমাজের অবাধ চলাফেরার পীঠস্থান বলা যায় শহরটাকে। এমনিতে গথিকদের জন্য বিভিন্ন এলাকাতো রয়েছেই, পাশাপাশি ট্রেন বা বাস স্টেশন, পার্ক, হাঁটার এলাকা সর্বত্রই চোখে পড়তো আপাদমস্তক কালো ভারী আলখেল্লায় ঢাকা ফ্যাকাসে শরীরের, সর্বদা রাশভারী আর গম্ভীর ভাবভঙ্গিতে চলাফেরা করা ওই মানুষগুলোকে।
আমি যে এলাকায় উঠেছিলাম, সেটা ছিল তাদেরই অধ্যূষিত একটি এলাকা। এমনকি যে ভবনে থাকতাম, সেখানেও ওদের দখলে ছিল অন্যান্য প্রায় সবগুলো ফ্ল্যাটই। তাই লিফটে দেখা হয়ে যেতো প্রায়ই কারো না কারো সঙ্গে। এমনভাবে তাকাতো বেশিরভাগই, যে নিজেকে মনে হতো অচ্ছ্যূত কোন জীব। যদিও এটা ওদের জন্মগত প্রবৃত্তি। প্রকৃতিই এভাবে মানুষগুলোকে জন্ম দিয়েছে। পৃথিবীর সবকিছুর প্রতিই ওদের যেন একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। তবে ওদেরকে দেখতে আমার খুবই ভাল লাগতো। হা করে ওদের ড্রেস-আপ, গেট-আপ, ভাবভঙ্গি গিলতাম মাথার ভেতরে। নিজেদের বাইরে খুব কমই কথা বলতো কারো সঙ্গে ওরা। সাতে-পাঁচে থাকতো না কারো।
আমি তখন নতুন নতুন জার্মান শিখছি। তার উপরে প্রতিদিন আটঘন্টা কায়িক শ্রমের কাজ করি। রাত তিনটায় শুরু করে বেলা ১২টায় যখন বের হই, তখন অনেক সময়ই বাসায় যেতে ইচ্ছে করে না সরাসরি। তখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি আর মানুষ দেখি।
একদিন ঘুরতে ঘুরতে পথ হারিয়ে একদম শহরের উল্টোপ্রান্তে একটা লেকের পাড়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে। তখন হুট করে কানের মধ্যে গাড়ির হর্ণ কানে আসে। পশ্চিম জার্মানিতে ফাঁকা রাস্তায় গাড়ির হর্ণ কানে আসলে খুব অবাক হয়তো লাগবে না, কিন্তু পূর্ব জার্মানির এমন ঐতিহ্যধারী একটা অঞ্চলে কেউ ফাঁকা রাস্তায় কারণ ছাড়া হর্ণতো দেয়ার কথা না!
ফিরে তাকিয়ে দেখি আমার পেছনে বনেটের ওপর মাথার খুলির স্টিকার লাগানো ফোক্সভাগেন পোলো গাড়ির জানালা থেকে একটা গথিক মাথা বের হয়ে আছে। তার মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন। আমি কাছে এগিয়ে গেলাম।
মানুষের চেহারা বা নাম মনে রাখার ক্ষেত্রে আমি কিংবদন্তীর আদু ভাইকেও পেছনে ফেলেছি বহু আগে। বন্ধুরা আমার কাছে থেকে সঠিক নামে সম্ভাষণের আশা ছেড়েই দিতে চায়। আমি মাঝে মাঝে সঠিক নাম বলে তাদেরকে তাক লাগিয়ে সেই আশাটাকে এখনো কোনমতে জিইয়ে রেখেছি।
বন্ধু জিসেল এর নাম কোনদিন একবারে সঠিক করে বলতে পারি নি। জিসেবেল, জিসাস, জিংক্স, জশুয়া, জিসজিস- সব মুখে আসতো, জিসেল কোনদিন আসতো না। মেয়েটি মেনেই নিয়েছিল, ওর নাম আমি কোনদিন একবারে ঠিক করে বলতে পারবো না। কিন্তু কনভোকেশনের দিন ভরা অডিটোরিয়ামে আমি ওই মঞ্চের মধ্যিখানটায় দাঁড়িয়ে, যেখানে মাথার ওপর থেকে আলো ফেলে আলোকিত করা হয়েছিল শুধু আমার চারপাশটাকে; সেখানটাতে একবারেই ওর নামটা উচ্চারণ করেছিলাম!
সেদিন ও যে কতোটা অবাক হয়েছিল, সেটা আজও মাঝে মাঝে ফোন করে জানায় আমাকে। ও আমার থিসিস লেখার পার্টনার ছিল বিধায় প্রফেসর, সেকেন্ড এক্সামিনার, কো-ওয়ার্কার সকলের নাম নিতে হয়েছিল সেদিন আমাকে। কোন নোট কিংবা কার্ড ছাড়াই স্পীচ দিয়েছিলাম সেদিন। সামান্য শ্যাম্পেন মুখে দেয়া ছাড়া আর কিছু খাইও নি তখনও!
সেদিন জিসেলের নাম ভুলে যাই নি কারণ, একটা ছোট্ট ট্রিক কাজে লাগিয়েছিলাম। সেটা ছিল ওর পুরো নামের দিকে মনোযোগ দেয়া। তাতেই একবারে মনে পড়ে গিয়েছিল ওর সঠিক নামটা। কিন্তু এখন আমার সামনের ফোক্সভাগেন পোলোর জানালা দিয়ে বের করে রাখা ওই মাথাটা কার হতে পারে, সেটা কোন ট্রিক খাটিয়েই বের করতে পারছিলাম না।
অবশ্য বেশিক্ষণ অন্ধকারে থাকতে হয় নি। মেয়েটি জানালো যে, সে আমি যেখানে থাকি, ওই অ্যাপার্টমেন্টেই থাকে। নয়তলায়। আর আমি থাকি আটতলায়। মাঝে মাঝে আমরা নাকি একসাথে লিফটে করে নামি। আমি কিছুই মনে করতে পারলাম না।
আমার মনে হয় সময় চলে যায় ওদের ড্রেস দেখতে দেখতেই। কালো চামড়ার একটা লংকোট তো থাকবেই। কালো উচুঁ বুট, তাতে বাহারী চেন, হ্যাট বা ক্যাপ বা টুপি, তার চারপাশ থেকে উঁকি দেয়া রক্তলাল চুল, ট্যাটু, পিয়ার্সিং- উফ্ আমার ধীরগতির পেন্টিয়াম থ্রি প্রসেসরের মস্তিষ্ক হ্যাং করতে বাধ্য। তার উপর থাকবে কড়া স্মেল। পারফিউমের গন্ধ? হতেও পারে। আমি গন্ধপ্রেমী। আমার সব ধরনের গন্ধই ভাল লাগে।
তবে মেয়েটিকে অন্যদের তুলনায় একটু সাদামাটাই মনে হলো। তেমন ফ্যাকাসে নয় চেহারাটা। ও আমাকে দেখেই বুঝে ফেলেছে ঘটনা। পথটুকু পাড়ি দিতে আমার লিফট লাগবে কিনা জানতে চাইলো। আমি সানন্দে রাজি হলাম।
ওর গাড়িতে উঠে আরো অবাক হলাম। ভেতরে-বাইরে ঝকঝকে তকতকে। এমনিতে যারা একই কোট পরে দিনের পর দিন কাটাতে পারে, তাদেরকে একটু অগোছালোই মনে হয়। শীতের দেশে কোট নিয়ম করে পরতে হয় বলে সবারই অনেকগুলো করে থাকে। কিন্তু গথিকরা সবসময় কালো রংয়ের কোট পরে বলে, আমি বুঝি না একই কোট নাকি ভিন্ন কোট। সেখান থেকে অমন একটা ছোট্ট স্টেরিওটাইপিং চিন্তা এসেছিল মাথায় যে মেয়েটির গাড়ির ভেতরটা অতো গোছালো হয়তো হবে না। ঢুকতেই বাতাসের একটা মিন্ট ফ্রেশ ঝাপটা সেই ভাবনাকে মিলিয়ে দিয়েছিল মহাশূন্যে। মেয়েটি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে খাঁটি জার্মান ভাষায় বলেছিল, আমার নাম মিসিসিপি। তুমি?
আমি বললাম, সিদ্ধার্থ। নাইস টু মিট ইউ।
সেও বললো, লাইকওয়াইজ!
---
(পরের পর্ব আগামীকাল)
মন্তব্য করুন