খেয়াঘাটে হারানো ডিঙি
১.
জীবনে যে কাজগুলো করা হয় নি এখনো, তার অন্যতম হচ্ছে উত্তরে গিয়ে রাতের আকাশে অরোরা দেখা। উত্তরে বলতে নরওয়ে কিংবা সুইডেনের দিকে। ওখানে গিয়ে পাহাড়ের ঢালে কোন একটা নির্জন কুটিরে বসে, বিটলবণ মেশানো দুই কাপ লেবু চা হাতে গভীর রাতে আকাশে রং-বেরংয়ের আলোর নাচন দেখতে পারলে ভাল লাগতো।
পাহাড়ের ঢালে অনেক নির্জন কুটির দেখেছি আমি। চারপাশে দীর্ঘ অঞ্চলজুড়ে সবুজ পাহাড় আর মাঝখানে ছোট্ট একটা কুটির। সুইডেন বা নরওয়ে দুটোই শীতের দেশ। বছরের নয় মাসই লেগে থাকে ঠান্ডা। আর ঠান্ডা বলতে এমন যে, তিন পরত মোটা কাপড়ে সারা শরীর আগাপাশতলা ঠিক ঠিক মতো না মুড়াতে পারলে, ঘরের বাইরে বের হওয়া যায় না। তবে তিন মাস ওদের ওদিকেও হালকা গরম পড়ে। ইদানীং তো বেশিই পড়ছে। বিশেষ করে করোনার আগে সবখানেই গরম তুলনামূলক বেড়ে গিয়েছিল। যেটা এখন একটু স্বাভাবিক হয়েছে। বাংলাদেশেও শীতকালে আগের মতো শীত পড়ে না ঠিকই, কিন্তু এখন একটু আধটু টের পাওয়া যায়। সারা পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায়, মাঝখানে তো সেটাও পাওয়া যাচ্ছিল না।
যাহোক শীত এড়িয়ে গরমের সময় ক্যাম্পিংয়ের বোঁচকা নিয়ে ওইদিকটায় ঘুরতে গেলে মন্দ হয় না মোটেই। শুধু নির্জন কুটিরটা বের করতে হবে খুঁজে। না পেলেও ক্ষতি নেই। ওইজন্যই তো ক্যাম্পিংয়ের বোঁচকা নিয়ে বের হওয়া। দরকার পড়লে যেন তাঁবু খাটিয়ে তাতে জাজিম পেড়ে শোয়ার জায়গা হয় অনন্ত একটা স্লিপীং ব্যাগের ভেতরে। আর তাঁবুর বাইরে বসার জন্য একটা চেয়ার এবং জ্বালানোর জন্য একটু আগুন চাই শুধু আমি। সেই আগুনে পানি গরম করে আমরা দুই কাপ লেবু চা খাবো।
জার্মানিতেও এমন জায়গা কম নেই যদিও। বায়ার্নের দিকে, বাভারিয়া প্রদেশের ভেতরে এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে গেলে মনে হয়, ছবির মতো ক্যালেন্ডার টাঙিয়ে রাখা চারিদিকে। একটু পর পর সেই ক্যালেন্ডারের পাতা পাল্টে যায় আর নতুন নতুন দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে আসে। এই নীল লেকের পাশ থেকে উঠে যাওয়া সবুজ পাহাড়ের দৃশ্য পুরো চোখ জুড়ে নিয়ে বসলো তো, তারপরের মুহূর্তেই পথের দুই পাশ থেকে দৃষ্টিসীমা চেপে ধরতে এগিয়ে ঘন সবুজ বনানী আসলো! পাইন আর ওকের সারি এত বেশি গায়ে গায়ে লেগে এগিয়ে আসতে শুরু করে যে, একা একা ওই পথে গভীর রাতে কখনো কারো যেতে হলে নিশ্চিতভাবেই গা ছমছম করবে।
কিন্তু সেই দৃশ্যও বেশিক্ষণ চোখের সামনে টিকবে না। একটু পরেই দুই পাশে ভেসে উঠবে গ্রামের ছবি। উত্তর ইউরোপের কঠিন ঠান্ডার সঙ্গে লড়াই করে করে ওই এলাকার মানুষ নিজেদের একটা আলাদা চালচলন দাঁড় করিয়েছে। ওদের বাড়িঘর, গ্রামের রাস্তা, চাষের মাঠ, উইন্ডমিলগুলো দেখলে বোঝা যায়। আমার সবচেয়ে ভাল লাগে রংগুলো দেখতে। মাঠের, পথের, গাছের পাতার, বাড়ির চালার, পানির। গাঢ় ঝকঝকে হয়ে ফুটে থাকে বাড়ির ছাদের টালির লালচে মেরুন রং, গাছের পাতার উজ্জল সবুজ রং, গমের মাঠের হলুদ, আকাশের নীল- যেন অপূর্ব এক রংয়ের খেলা। সে খেলা দেখার জন্য ওই জায়গাগুলোতে যেতে হয় শুধু। আর কিছু করতে হয় না। তারপর শুধু চুপচাপ বসে সেই খেলা দেখে যাওয়া।
২.
রংয়ের খেলার ভেতর আরেকবার পড়ে গিয়েছিলাম বার্লিনে। তখন আমি মনে-প্রাণে এক অবুঝ যুবক। ইলমিনাউ স্কুলে একটা ছাত্র সংগঠনে ভলান্টিয়ার বা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করি। সেই সংগঠনের আয়োজনে আমরা ২০১৪ ব্যাচের মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন সায়েন্সের সব সহপাঠীকে নিয়ে শিক্ষাসফরে গিয়েছিলাম। সেবারের বার্লিন ভ্রমনের স্মৃতি মস্তিষ্কে আজও অমলিন। রংয়ের খেলার ভেতর পড়ে যাওয়ার সময়টা ছিল সেই সফরের অন্যতম ঘটনা।
আমরা যে হোস্টেলটায় উঠেছিলাম সেটা মূলত ব্যাকপ্যাকার আর শিক্ষার্থীদেরই জায়গা। দু'টো দিন চুটিয়ে ঘুরেছি পূর্ব আর পশ্চিম বার্লিনের অলিগলিতে। গুগল ম্যাপের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় তখন। তার আগে জিনিসটাকে বেশি বিশ্বাস করতাম না আমি। ২০১৫ সালের শুরুর দিকের কথা বলছি সেটা। তখন আমার মতো অনেকেই গুগল ম্যাপে কিংবা প্রযুক্তিতে অতো বিশ্বাস করতো না।
ফেরার দিন রাতে আমরা কয়েক বন্ধু মিলে বার্লিনের নাইট লাইফ দেখতে বের হয়েছিলাম। খুঁজে পেতে বের হলো, ট্রেজার নামের একটা ক্লাব আছে কাছেপিঠে। বেশ বড়। অনেকগুলো ফ্লোর। প্রতিটা ফ্লোরে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের মিউজিক। বেশ নামকরা ক্লাব। কিন্তু প্রচুর ভীড়। মানুষকে দুই তিন ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে তারপর ঢুকতে হচ্ছে।
সেই রাতে আমাদেরকেও লম্বা লাইন দিতে হয়েছিল। বৃষ্টির মধ্যে সেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই আমাদের দলের সদস্য সংখ্যা নেমে এসেছিল অর্ধেকে। তিন ঘন্টার বেশি লাইনে দাঁড়িয়ে তারপর ঢুকতে পেরেছিলাম ওই ক্লাবে।
আহামরি কিছু না। চারতলা একটা ভবন। বাহির থেকে দেখলে মনে হবে গার্মেন্টস্ বুঝি। কিন্তু ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙ্গবে ভুল। ভেতরে ঢোকার রাস্তাটাই একটা গুহার মতোন। কংক্রীট, সিমেন্ট, ঝকঝকে টাইলস সব সরে গিয়ে এসে পড়েছে পাথর আর মাটি। লন্ঠন জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে দেয়ালে। সেই আলোয় পথ দেখে এসে পৌঁছালাম জ্যাকেট রাখার লাইনে। জ্যাকেট রাখলে একটা টোকেন দেয়। সেই টোকেন দেখিয়ে পরে জ্যাকেট ফেরত নিতে হয়। প্রথম ফ্লোরটা ছিল হিপ-হপ মিউজিকের। কানে এসে ঢুকলো, কানিয়ের গান। Run away fast as you can...
গানটা শুনতেই মন ভাল হয়ে গেল। শুরুতেই সাবধানবাণী অগ্রাহ্য করে জীবনে যতো কাজ করেছি, তার তালিকা তৈরি করতে বসলে অন্তত এক দিস্তা কাগজ লাগবে। সেই তালিকায় আরেকটা কাজ নাহয় যোগই হলো। সবচেয়ে স্বচ্ছ যে বিয়ারটা ওদের সংগ্রহে ছিল, মগে ঢালার পর যেটার ভেতর দিয়ে অপরপাশে কি হচ্ছে পরিস্কার দেখা যায়, সেটা নিয়ে দেখতে গেলাম দ্বিতীয় তলায় কি হয়।
দ্বিতীয় তলাটা দারুণ ছিল! জ্যামাইকান র্যাগে গানের সুরের তালে ভরে ছিল চারপাশ। পুরো ফ্লোরে মঁ মঁ করছিল টেট্রা-হাইড্রো-ক্যানাবিনলের সুবাস। কানে ভেসে আসলো জুলিয়ান মার্লের গলা,
Looking for a belly full,
got kids to feed
Grow some marijuana,
to fulfill the need...
জ্যামাইকার মতো ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ঘেট্টো এলাকাগুলোর মানুষের জীবনের স্বাভাবিক গল্প এসব গানের মধ্য দিয়ে উঠে আসে দুনিয়াবাসীর সামনে। তাদের কষ্ট, সুখ, বেদনা, পাওয়া, না-পাওয়ার গল্প দিয়ে সাজানো গানের এই জনরাকে আমি কেন অতো পছন্দ করি, ঠিক জানি না। কিন্তু গানগুলো শুনলে কখনোই মনোযোগ না দিয়ে পারি না।
দ্বিতীয় তলায় এত বেশি জমে গিয়েছিলাম যে তৃতীয় তলায় যাওয়ার কথা মনেই ছিল না। আর সেই সুযোগেই সিরিয়ান বালক উসামা জুনি এসে ফুট কাটা শুরু করে দিলো। ঢেঁকি নাকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে। আমি শুনে হাসলাম। ঢেঁকি তো সারাজীবন ধান ভাঙলোই স্বর্গে যাবার লোভে। স্বর্গে গিয়ে তার ধান ভাঙা ফুরাবে, সে চোখ দু'টো বন্ধ করে একটু শরীরটাকে জুড়াবে। তাহলে স্বর্গে গেলে কেন আবার ধান ভাঙবে?
আমার প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ কড়া চোখে তাকিয়ে থেকে উসামা বললো, "তোমার কথার অর্থ খুঁজতে গেলে মাথাটা খারাপ হয় আরো বেশি। সুতরাং বাদ সব। চলো এই ফ্লোরে কি আছে দেখি"। আমরা ঢুকে দেখলাম, ওটায় মেলা বসেছে স্কুল-কলেজগামী ছেলেমেয়েদের। টেইলর সুইফট, সিয়া, জায়ন, শাকিরা, বিয়ন্সে, এড শিরান সব চলছে পুরোদমে একটার পর একটা। ডিজে পুরো ফ্লোরে ছড়িয়ে দিয়েছে পপ মিউজিকে অনন্য সুর। ডান্স ফ্লোরে মানুষ মাতাল হয়ে গিয়েছে পুরা।
হুট করে বিট ড্রপের মতো সব চুপচাপ হয়ে গেল এক সময়। নৃত্যরতরাও থেমে গেল মুহূর্তে। আমি বোধহয় কোন একটা ভাবনায় ডুবে ছিলাম। সেখান থেকে উঠে আশপাশে চোখ বুলালাম। তার পরের মুহূর্তেই বেজে উঠলো এড শিরানের গলা,
I found a love for me
Oh, darling, just dive right in and follow my lead...
আমরা ক্লাবে ঢোকার পর কোনদিক দিয়ে যে এর মধ্যেই দু'ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে কারো খবর ছিল না। উসামা আর আরেক বন্ধুকে নিয়ে যখন পপ মিউজিকের ফ্লোর থেকে ঢুকলাম শেষ ফ্লোরটাতে, সেই সময়টায় হুট করে রংবেরংয়ের খেলার ভেতরে পড়ে যাই আমরা সবাই।
টেকনো মিউজিকের ফ্লোর ছিল সেটা। সঙ্গে লেজার শো। সাদা ধোঁয়া থেকে থেকে ঢেকে দিচ্ছিলো আমাদের সবার চারিদিক। এক হাতের ভেতরেই মানুষ নাচানাচি করছে, কিন্তু চোখে কিচ্ছু দেখা যায় না। ফ্লোরে চলছে ভীষণ কড়া টেকনো মিউজিক। এই ফ্লোরটা সবার উপরে কারণ নিচে থেকে মানুষ একটু একটু করে পূর্ণ হতে হতে এই ফ্লোরটায় আসে। এখানে সেই পূর্ণ হওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এখানে এসে ঢোকার সাথে সাথেই সবারই মনের আগল পুরোপুরি কিংবা প্রায়-পুরোপুরি খুলে যায়।
জীবনের সব যন্ত্রণা ভুলে কিছুটা সময় শুধুই উপভোগ করতে এসেছে এরা। তবে যন্ত্রণা ভুলে গেলেও, কর্তব্য ভোলে নি কেউ। কারো সঙ্গে কারো তাই লড়াই চলছে না কোথাও। কারণ সামান্য এই ভেন্টিলেশনের পরে তো বাইরে সেই যন্ত্রণার জীবনই অপেক্ষমান সবার জন্য। কথাটা সম্ভবত সবারই জানা।
আমি বারের একপাশে টুলে বসে একটা লং-আইল্যান্ড-আইস-টি পান করলাম আর যান্ত্রিক সুরের বিটের জাদুর জালে নিজেকে বাঁধনহীনভাবে ভেসে বেড়াতে দিলাম। আশপাশে কি হচ্ছিল না হচ্ছিল কিছুই চোখ পড়ছিল না। দেখছিলাম শুধু লাল, নীল, বেগুনি, আসমানী, সবুজ, হলুক, কমলা, শাদা এবং আরও নানান রংয়ের চোখ ধাঁধানো খেলা।
ট্রেজার থেকে বের হতে হতে সেদিন ভোর হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত টিকেছিলাম উসামা, আমি আর একটা বন্ধু। অন্যরা সব আগেভাগেই হোস্টেলে ফিরে গিয়েছিল। ভোরের আলোয় বের হয়ে দেখি সারারাতের বৃষ্টিতে প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা হয়েছে রাস্তায়। শিরশিরে বাতাস আর পায়ের নিচে কাঁদামাটি নিয়েই হোস্টেলে ফিরলাম তিনজন। বাঙ্কারে শুয়ে চোখ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশ করলাম ঘুমের রাজ্যে।
৩.
ঘুরে বেড়ানোর কথাই মাথায় আসে বেশি যদি ভাবতে বসি, জীবনে আজ অবধি কি কি করা হয় নি কিংবা কি কি করবো জীবনে আর। ঘুরে বেড়ানোর জীবনই যদি হয় একটা আমার, আক্ষেপ নেই। খেয়াঘাট থেকে হারিয়ে যাওয়া একটা ডিঙি নৌকা মনে হয় নিজেকে। পথ হারিয়ে কোন নদী পেরিয়ে যে কোন সাগরে সে পথ হারিয়েছে, তা কি কেউ বলতে পারে?
---
মন্তব্য করুন