বন্ধু-বান্ধব, হিপ হপ আর দি লাস্ট জেডাই ট্রেলারে মোড়ানো পহেলা বৈশাখ
দেশের বাইরে থাকার সুবিধা-অসুবিধা দুটোই আছে। কোনটা বেশি আর কোনটা কম, সে বিষয়ে সিদ্ধান্তমূলক কিছু বলা সম্ভব না। একেকজনের কাছে বিষয়টা একেক রকম হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আমার কাছে যেমন পহেলা বৈশাখের দিনে উৎসব আর আনন্দ-অায়োজনের মধ্যে না থাকতে পারাটা অনেক বড় একটা ইস্যু। ঈদ, কুরবানী কিংবা ভালবাসা দিবস, পহেলা ফাল্গুনের চাইতেও পহেলা বৈশাখটাকে মিস্ করি বেশি। একবার ১৩ এপ্রিল রাত ১১টা-১২টার দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, চারুকলার ফুটপাথ, মিলন চত্বর, টিএসসি, ডাস ইত্যাদি এলাকায় বন্ধুদেরকে নিয়ে হেঁটে দেখিয়েছিলাম ঠিক একদিনের ব্যবধানে কি অবস্থা হতে যাচ্ছে পুরো এলাকাটির। চব্বিশ ঘন্টা পর আবার হেঁটে নিজের অনুমান কতোটা সত্য তা দেখতে গিয়েছিলাম। মিলে গিয়েছিল সেন্ট-পারসেন্ট সবকিছু। পহেলা বৈশাখের দিন কয়টার আগে ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়লে হুজ্জত কম, কোথাকার লাঞ্চ সেদিনের জন্য আদর্শ কিংবা ক্যাম্পাস থেকে বের হতে হলে কখন কোথা দিয়ে বের হওয়াটা সবচেয়ে নিরাপদ ইত্যাদি বিষয়ে আমার বাতলে দেয়া উপায়গুলো প্রায়শই সবচেয়ে উপকারী হিসেবে প্রতীয়মান হতো। আমিও সব মিলিয়ে দিনটাকে উপভোগ করতাম। কেননা এই একটা দিনকে সত্যিকার অর্থেই বুঝতে ও অনুভব করতে পারতাম আমি।
মজার বিষয় হচ্ছে, এ ব্যাপারটা বুঝতে আমাকে পরিস্থিতির বাইরে এসে দেখতে হয়েছে। দেশে থাকলে আমিও হয়তো নিরাপত্তা ইস্যুতে এত ব্যস্ত থাকতাম যে, আশেপাশে আর কি হচ্ছে সেটা ভেবে দেখার সময় পেতাম না। তারপরও আমার কুল-ইন্সটিঙ্কট ( ) হয়তো সবকিছু ঠিকই সামাল দিয়ে দিতো, আমি তার কানাকড়িটিও বুঝতাম না।
আসলেই আমি কখনও নিজেকে কিংবা অন্যদেরকে পুরোপুরি বুঝতে পারি নি। জীবনটা মূলত কেটেছেই এভাবে। বোঝার চেষ্টাটাই করি নি, কেননা ভ্রান্তভাবে জানতাম এই বোঝার চেষ্টা করাটা বৃথা। অজস্র ভ্রান্ত ধারণা কিভাবে যে মাথাটায় ঢুকে সবকিছু ভর্তি করে রেখেছিল সে ব্যপারে আমার কোনো ধারণা নেই। এমনকি আমার ছেলেবেলাতে এমন কোনো বড় দুর্ঘটনাও নেই, যা আমাকে ভুল পথে পরিচালিত করার কথা। তারপরও দীর্ঘদিন আমি হেঁটেছি অন্ধকারের পথে। কেন, কে জানে!
আজকাল যখন অনেক কিছু করি অন্যদেরকে বোঝার জন্য, তখন মনে হয় এই কাজগুলো যথাসময়ে করার প্রয়োজনটা কতো বেশি ছিল! অথচ সে সময় আমি যে আসলে কি ভাবতাম আর কি করতাম, ভাবলে এখন সময়গুলোকে অযথা নষ্ট হতে দিয়েছি বলে মনে হয়। যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর "জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা" বলে এখানে বিরতি নিয়ে আবার ভাবার নির্দেশ দিয়েছেন, তারপরও মাঝে মাঝে নিজের ওপর রাগ হয়। আমাকে যেভাবে পৃথিবীর প্রতিটি ছোট-বড় শিক্ষা উচ্চমূল্যে কিনতে হয়েছে, তেমন যে অনেককেই করতে হয় নি; তা স্বচক্ষে দেখেছি। আমার জন্য 'দেখে শেখা'-র অওসাম অপশনটা বন্ধ ছিল চিরকাল। যে শিক্ষাগুলো আমার জন্য জরুরি ছিল এবং এখনও আছে, তার প্রতিটিই আমাকে ঠেকে ঠেকে শিখতে হয়েছে। সময়, শ্রম, ক্ষেত্রবিশেষে তরতাজা রক্তের বিনিময়ে বহুমূল্য জ্ঞানের সাধনা করেছি আমি।
এর পেছনে কি কারণ থাকতে পারে? ছেলেবেলায় আমার ওরিয়েন্টেশনটা যাদের সাথে হয়েছিল তারা আমাকে পছন্দ করতো ভীষণ। খুব মনে আছে সবার সাথে আমার একটা সুস্থ সুন্দর সম্পর্ক ছিল। তারা সবসময় আমাকে আগলে রাখতো সবকিছু থেকে, কেননা তারা ভাবতো আমি বোকা। আমি কোনোকিছু সামলাতে পারবো না। তাই আমাকে সবসময় চোখে চোখে রাখতে হবে। পুকুরে সাঁতার কাটতে যেতে দেয়া যাবে না। মাঠে ছেলেদের সাথে দৌড়াতে যেতে দেয়া যাবে না। কিছুই আসলে করতে দেয়া যাবে না। চোখের সামনে বেঁধে রাখতে হবে। কারণ আমি ভীষণ বোকা, আমার মাথায় কিছু নেই।
ফলে আমি বেড়েও উঠেছি ওই ধারণাটা নিয়েই যে আমি বোকা। যে সমাধানটা আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না, কেবল আমিই দেখতে পাচ্ছি; সেটা যতো কার্যকর ও সহজ সমাধানই হোক না কেন, আমি সেটার পক্ষে লড়াই করার আত্মবিশ্বাস পেতাম না। এইভাবে আমার গড়ে ওঠা। কিন্তু চিরকালতো সেটা চলতে পারে না। কারণ আমার ভেতরটাও জানে, কোনটা সঠিক আর শুদ্ধ, অন্তত আমার জন্য।
তাই একটা সময় থেকে শুরু হলো দ্বন্দ। ভেতরের সাথে বাইরের, এবং একইসাথে নিজের সাথে অন্য সবার। এবং আমি বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করলাম সবার থেকে। নিজের একটা পৃথিবী গড়ে ওঠা শুরু করলো ধীর গতিতে। এক সময় আমি খেয়াল করে দেখলাম আমার কল্পনার পৃথিবীটা, আমাদের সবার বাস্তব পৃথিবীটারই একটা রেপ্লিকা। সেটাও আমাদের বাস্তব সব সমস্যাতেই ভর্তি। পার্থক্য শুধু এই যে, কাল্পনিক পৃথিবীর সব সমস্যা আমি সমাধান করে ফেলতে পারি কেননা সেখানে অন্য কেউ এসে 'তুমি বোকা' বলে আমাকে জীবনের শুরুতেই দমিয়ে দিয়ে যায় নি।
ধীরে ধীরে নিজের সমাধানগুলো যখন বাস্তবে প্রয়োগ করতে শুরু করলাম, তখন অনেক সংকট দেখা দিলো। বেশিরভাগই সেসব সমাধানে আস্থা রাখতে অস্বীকৃতি জানালো। অল্প কিছু মানুষ যারা আস্থা রেখেছিল, তাদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখা দেয়া শুরু হলো। সব মিলিয়ে পুরোই একটা আমজনতাটাইপ মানুষ হয়ে গেলাম আর কি। একদম আর দশটা মানুষের মতোন।
এখন প্রায়ই মনে হয়, যদি চিরকাল নেপোলিয়ন ডায়নামাইটের মতো উইয়ার্ডো হয়ে থেকে যেতে পারতাম, কিংবা সবসময় অন্য সবকিছুকে নিজের চেয়ে বেশি প্রায়োরিটি না দিয়ে একটা শক্তধাঁচের পার্সোনালিটি গড়ে তুলতাম; তাহলে হয়তো সবকিছু ভিন্নরকম হতো। যদিও আমি নিশ্চিত নই, সেই ভিন্নতা আমি কতোটুকু পছন্দ করতাম। পহেলা বৈশাখে ঢাকায় পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে থাকতে না পারার খারাপ লাগা একসময় মিটে যায় যখন বিকাল থেকে নানান দেশের নানা সংস্কৃতির ছেলেপিলে আমার রুমে ভিড় করা শুরু করে।
আমার রুমটা ক্যাম্পাসে বিশেষ পরিচিত কেননা, মানুষ জানে যদি তাদের যাওয়ার মতো আর কোনো জায়গা না থাকে, তারা যেকোন সময় আমার রুমে এসে নক করে দেখতে পারে। এখানে সবসময় কিছু না কিছু হচ্ছে। যেমন গতকাল পহেলা বৈশাখের কথাই ধরা যাক। বছরের প্রথম দিন ভাল-মন্দ কিছু রান্না করা দরকার ভেবে বিকালের দিকে রান্নাঘরে গিয়ে মুরগি আর ভাত চড়িয়েছিলাম। আমি যখনই রান্না করি, তখন একটু বেশি করে করি; যাতে পরের বেলাতেই আবার রান্না না করতে হয়।
যাহোক, রান্না শেষ হওয়ার আগেই আমরা হয়ে গেলাম চারজন। চারজনের জন্য যথেষ্ট খাবারই ছিল। খাদ্যগ্রহণ শেষ করে বসে ছিলাম। গান-টান শুনছিলাম। ইদানীং শুধু হিপহপ জনরার গান শুনি।
ফার্স্ট থিং আহা, ওয়েক আপ আউট এ ড্রিম আহা
গ্র্যাব এ লাইটার আহা, সামথিং আই ক্যান স্টীম আহা
বং রিপ আহা/ মেক শিউর ইটস্ ক্লীন আহা
স্মোক স্যাশ আহা, নিহা হোয়াট ইউ মীন আহা...
যাহোক, র্যাপ নিয়ে কথা বলতে গেলে এই পোস্ট বড় হতে হতে উপন্যাসের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে। ওইটা সম্প্রতি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় একটা কিছু হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। প্রতিমুহূর্তে র্যাপ শুনছি।
লেদার অন লেদার নিগা, দ্যাটস্ র
টেক দ্যাট ওজি কুশ, পুট ইট ইন এ র
বিচ সো ব্যাড হ্যাড টু হিট ইট র
আস্ক মি হাউ আ'ম লিভিং ম্যান, আ'ম লিভিং র
র কিংবা কাছাকাছি একটা জীবনযাপনের জন্য যতোটা প্রতিভাধর হওয়ার দরকার ছিল, ততোটা কি আমি আসলেই তা নিয়ে সন্দেহ আছে। চেষ্টা করছি সন্দেহ থেকে বের হয়ে জাস্ট একটা ব্লাইন্ড ট্রাই দেয়ার। ফেক ইট টিল ইউ মেক ইট- সট্র্যাটেজীতে এগোনো যায়। কিংবা আরও অনেক কিছু করা যায়। যাহোক আমাদের বসে থাকাকালীন সময়ের মধ্যেই অনেক বন্ধু-বান্ধব আসলো-গেলো। ওদেরকে বাংলা নিউজপোর্টাল আর আমার ফেসবুক ফীড থেকে বাংলা নববর্ষটা কেমন দেখায় সেটার ব্যাপারে একটা মোটা দাগের ধারণা দেয়ার চেষ্টা করলাম। এই করতে করতে এক সময় মনে পড়লো, এই জীবনটাকেই তো আমি নিজের জন্য বেছে নিয়েছি। অতীতের প্রতিটি কর্মকান্ড আমাকে ধীরে ধীরে এখানে নিয়ে এসেছে। এবং একটা ভবিষ্যতে দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যদিও এখন দেখতে পারছি না ভবিষ্যতে কি অপেক্ষা করে আছে কিন্তু রাস্তাটা পরিস্কার। শুধু ধৈর্য ধরে হাঁটতে হবে। ১৪২৪ বাংলা সনে আমার প্রথম ও একমাত্র রেজোল্যূশন হচ্ছে, ওই অপেক্ষমান রাস্তাটা ধরে হেঁটে যাওয়া। আর কিছু না।
আর সকলের জন্য ভালবাসা ও শুভেচ্ছাতো রইলোই। লুকাসফিল্ম ও ডিজনীর কাছ থেকে এই নববর্ষের সবচেয়ে বড় উপহারটি পেয়েছি। স্টার ওয়ার্স দি লাস্ট জেডাই সিনেমার ব্র্যান্ড নিউ ট্রেলার। মূলত ওইটা দেখেই এই লেখাটা শুরু করেছিলাম। ইচ্ছে ছিল লেখার মাধ্যমে ট্রেলারটার একটা কাঁটাছেড়া করা। যাহোক, অনেক দেরি হয়ে গেছে। শুধু এতটুকু বলতে পারি, ট্রেলার দেখে মনে হয়েছে লাস্ট জেডাই অর্থ আসলে লাস্ট জেডাই না। নতুন এক জেডাই অর্ডারের শুরুর ঘোষণা। স্টার রেবেলস্-এর বেন্ডুর মতো কিছু একটা। যারা মূলত ডার্ক সাইড আর লাইট সাইডের মধ্যে ব্যলেন্স নিশ্চিত করে।
স্টার ওয়ার্স নিয়ে গল্প হবে আরেকদিন। আজ এ পর্যন্তই। টা টা।
---
মন্তব্য করুন