নাটিকা: বাউল রাজার আগমনী
দৃশ্য ১: (রাজপ্রাসাদে রাজার নিজের কক্ষ। রাজা সকালে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় সেবায়েতের সাথে বসে কফি পান করছেন। তার পরনে শেরওয়ানী তবে পাগড়ি নেই। এখনও প্রাত:কর্ম সম্পাদন হয় নি।)
সেবায়েত:
জাঁহাপনা, বলুন আপনার মনের অভিপ্রায়। ব্যক্ত করুন আপনার মন কি চায়।
রাজা:
আমার মনে লক্ষ অভিপ্রায় প্রতিমূহুর্তে আলোকচ্ছটার মতো ঝলকাচ্ছে আর খসা তারার মতো হারিয়ে যাচ্ছে। এই যে এইমাত্রই একটি তারা খসে পড়লো আলেক শহরের ভাবনাটা নিয়ে। আলেক শহর এক কাল্পনিক শহর, যেটাকে আমরা মনের ভেতর সাজাই। সেখানে সৃষ্টিকর্তা তার সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে থাকেন। সেই শহরের দেখা পাওয়ার একমাত্র উপায় ভাবের সাধনায় মন দেয়া। কই সেই ভাবনাটা তো বেশি দূর এগুলো না, পড়ে গেল মাঝপথে। এমন লক্ষ ভাবনা এবং সেগুলোকে অনুসন্ধানের অভিপ্রায় প্রতি মূহুর্তে মনে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে সেবায়েত। কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা তোমাকে বলবো?
দৃশ্য ২: (রাজার নিজের কক্ষ। একই বারান্দা। তবে এবার সন্ধ্যার আলোয়। রাজা দিনের কার্য সম্পাদন করে ঘরে ফিরেছেন। এখনও রাজকীয় পোশাক পরিত্যাগ করেন নি। মাথায় মুক্তাখচিত পাগড়ি শোভা পাচ্ছে। একটু পর রাণী আসবেন। তার আগে কিছুক্ষণের জন্য নিজের সাথে নিরিবিলিতে কাটাচ্ছেন। সেবায়েত একটি ওয়াইনের বোতল খুলছে রাজার জন্য। সেবায়েতের পরনে জমকালো সান্ধ্যকালীন পোশাক।)
সেবায়েত:
জাঁহাপনা, বলুন তো আপনার আজকের রাজকর্মের ব্যস্ত দিনটি কেমন ছিল? কতগুলো সিদ্ধান্ত নিতে পারার সক্ষমতায় আপনি আনন্দিত হয়েছেন?
রাজা:
রাজদায়িত্ব পালনের আনন্দ সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতায় নয় সেবায়েত। সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা দেখায়। গত বছর রাষ্ট্রীয় বাউল সংঘের বার্ষিক বরাদ্দ সহস্র শতাংশ বর্ধনের আদেশ জারির পূর্বে আমাকে বেশ লড়তে হয়েছিল আমাদের অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে। বুড়ো কোনভাবেই বরাদ্দ বাড়াতে রাজি হচ্ছিল না। সেবার শেষ পর্যন্ত লড়ে বরাদ্দটা আদায় করে আনার জন্যই না এবার দেশে বাউল গানের এক জোয়ার এসে পড়েছে। রাজ্যে রাজ্যে আজ এ অঞ্চলের বাউলিয়ানার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে। এটা আজ দূরালাপনমন্ত্রীর রিপোর্ট মারফত জানতে পেরেছি। এটা জেনে আজ বড় আনন্দ হয়েছে জানো।
দৃশ্য ৩, শেষ দৃশ্য: (ওয়াইনের গ্লাস হাতে রাজার দিকে এগিয়ে যায় সেবায়েত। গ্লাসটি দিয়ে নিজের লাইনটি বলে সে)
সেবায়েত:
জাঁহাপনা, এই তো আনন্দ। রাজ্যের সকলের মূল কর্তব্য রাজ্যের কল্যাণে কাজ করা। আপনার রাজ্যের প্রতিটি প্রজাই সেই কর্তব্য প্রাণে ধারণ করে বাঁচেন। তাদের নেতৃত্ব প্রদানের জন্য রয়েছে আপনার প্রজ্ঞা জাঁহাপনা। এ রাজ্যের উন্নতি হবেই।
রাজা:
এই যে সেবায়েত, তুমি আবার ইমোশনাল হয়ে গেলে। রাজকাজ একটি নোবেল কাজ। আমি এ কাজে নিজেকে নিযুক্ত করতে পেরেছি, আমার দ্বারা রাজ্যের একটা পারপাস সার্ভ হচ্ছে তাই আমার স্বার্থকতা বুঝলে।
সেবায়েত:
তা জানি মহারাজ। আপনি প্রগলভতা সমর্থক নন। আমিও নই। তারপরও সত্যর মুখে মাঝে মাঝে মুঠ আলগা হয়ে যায়। অপরাধ নেবেন না। বাউল সংঘের অবদান সম্পর্কে আরও বলুন। তাদের খ্যাতি বেড়েছে, তা তো বুঝলাম। তবে আমার আগ্রহ তারা সমাজের জন্য কি আনতে পারছে সেদিকেই বেশি।
রাজা:
তা আর বলছি কি? আমি নিজে আজ মহাকবি সামসুল হক চিশতীর একটি গানের কথায় মুগ্ধ হয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম এক মুহূর্তের জন্য।
সেবায়েত:
কোন কথা মহারাজ?
রাজা:
কথাটা ছিল- দুই আন্ডার হয় এক মত, দুই মুরগীর হয় এক সুরত। আসলেই কি কথাটা ঠিক নয়? মুরগীর চেহারার ওপর ডিমদের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা যদি থাকতো আর ডিমেরা সবাই মিলে যদি মুরগীদের চেহারা একই রকম হবে এভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখতো তাহলেই কেবল এই হাইপোথিসিসের সত্যতা থাকা সম্ভব। এবং যদি আমরা পৃথিবীর মুরগীদের দিকে তাকাই তারা সবাই জাতভেদে দেখতে একই রকম। কোন প্রাণিবিদ্যায় ডিগ্রি নেই, গবেষণার অভিজ্ঞতা নেই, শুধুমাত্র গানের সাধনা করে একজন সিদ্ধির সেই পর্যায়ের মোক্ষে পৌঁছে গেছে যে বিশ্বব্রক্ষ্হাণ্ডের বড় বড় পারমুটেশন-কম্বিনেশনের মিল খুঁজে বের করে দিচ্ছে- এই ক্ষমতাকে আমি শ্রদ্ধা করি জানো? এঁদের মতো সাধনা করতে জানা লোকেরা আমাদের রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদগুলোর একটি। এঁদের দ্বারা আমরা শত-শত এমনকি হাজার বছর পরেও উপকৃত হবো।
সেবায়েত:
তা অবশ্য ঠিক বলেছেন আপনি। বাউল গানের প্রতি টান আর আকর্ষণ এক শ্রেণীর মানুষের কাছে বিশ্ব:সম্প্রসারণের শেষ দিন পর্যন্ত থাকবে।
রাজা:
সেটাই ছিল আমার লক্ষ্য জনাব। যুদ্ধ-বিগ্রহ, লোভের পিছু নেয়া আর শত্রুতা উপার্জনে আমরা জেনে বা না-জেনে কত লক্ষ লক্ষ রৌপ্যমুদ্রা খরচ করছি। তাতে বুড়ো অর্থমন্ত্রীর কোনো ভ্রুকুটি নেই। যতো বরাদ্দের টান সইতে হয় আমার রাজ্য পরিচালনার আপন ইচ্ছের নৌকাগুলোকে। এবার সে সবেরও একটা হিল্লে হলো, হ্যাঁ? কি বলো?
(রাজা সহাস্যে সেবায়েতের পিঠে একটি হাত রেখে বেরিয়ে যাবেন কক্ষটি থেকে। পেছন থেকে ক্যামেরা জুম আউট করে সাদায় মিলিয়ে যাবে।)
---
মন্তব্য করুন