সাগরের হাতছানি অ্যাড্রিয়াটিকে
সাগর পাড়ে বসে রোদ পোহানো আমার প্রিয় একটি কাজ। সৈকতের মধ্যে নিরিবিলি একটা জায়গা খুঁজে বের করে, সাগরের ঢেউয়ের সুরে মস্তিষ্কের চিন্তারাজির তালটি মিলিয়ে একবার চোখ মুদে বসে পড়তে পারলেই হলো। ভাল হয় হালকা pH সম্পন্ন কোনো সানব্লক মেখে নিয়ে বসলে। পৃথিবীর সর্বত্রই সূর্যের আলোর অতিবেগুনী রশ্মি সমানমাত্রায় ক্ষতিকর। শুধু মেলানিনের পরিমাণের ভিন্নতার কারণে কারোটা বোঝা যায়, কারোটা বোঝা যায় না।
প্রিয় হলেও সাগর পাড়ে বসে রোদ পোহানোর সুযোগ যে জীবনে অসংখ্যবার পেয়েছি, তা কিন্তু নয়। হাতে গোণা কয়েকবার কক্সবাজার যাওয়া (যার একাধিকই ছিল অন্য কাজে গিয়ে সময় করে একটু সাগরের পাড় থেকে ঢু দিয়ে আসা) বাদ দিলে আর বলার মতো প্রায় কিছুই থাকে না। ২০১৭ সালের ক্রিসমাসের ছুটিতে গিয়েছিলাম ইতালির সাগরপাড়ের ছোট্ট শহর ট্রিয়াস্টে-তে। সেটার কথা বলা যেতে পারে।
অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের পাড়ের সে শহরের সবচেয়ে বড় গৌরব তাদের কফি, যার নাম- ইলি। ইউরোপের প্রায় সব দেশের ছোট-বড় সুপার মার্কেটের কফির সারিতে ইলি'র পণ্য দেখা যায়। তাদের চেইন শপের কফিও খারাপ হয় না।
যাহোক, কফির শহরে যাওয়া হবে মানে যে প্রচুর কফিও পান করা হবে- সেটা বুঝেছিলাম আগেই। ছোট্ট শহর হলেও দেখার মতো জায়গার অভাব ছিল না সেখানে। রোমানদের তৈরি প্রাচীন অ্যাম্ফিথিয়েটারের ধ্বংসাবশেষ, দুই হাজার বছরেরও পুরোনো একটি জনপদ, কংক্রীটের বাঁধাই দেয়া সুদীর্ঘ সাগরের পাড়- কি নেই দেখার!
ব্যালেনচিয়াগা আর শ্যানেল ফাইভের মতো বড় বড় সব ব্র্যান্ডের শো-রুমই সেখানে রয়েছে ভ্রমণ-কেনাকাটায় যারা আসক্ত তাদের জন্য। ইতালিতে বসে সেখানকার লোকাল পিৎজার স্বাদ নেয়ার কথা যারা ভেবে রেখেছেন, তাদের জন্য রয়েছে অসংখ্য স্ট্রিটফুডের দোকান। ওদের একেকটা পিৎজার সাইজ দেখলে ভিমড়ি খেতে হয়, কিন্তু দাম একদম পাড়া-মহল্লার পরোটার হোটেলের মতো সুলভ!
মূলত স্থানীয় অধিবাসীরা জীবনের প্রয়োজনে যতটুকু লাগে, ততটুকু উপার্জনের নীতিতে চালান দোকানগুলো। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষেরা কাজ করেন সেসব দোকানে। কাজ করেন ইতালিয়ান স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও। আমার একজনের সাথে কথা হয়েছিল, সে নেক্সট সামারে দক্ষিণ আমেরিকায় ব্যাকপ্যাকিং-এ যাবে বলে টাকা জমাচ্ছিল।
ট্রিয়াস্টে শহরটা যারা ভিড় ভালবাসেন না কিন্তু ঘুরতে ভালবাসেন, তাদের জন্য আদর্শ। ওদিকে আবার ইতালির বরিশাল বলে খ্যাত 'ভেনিস'-ও ট্রিয়াস্টে থেকে কাছেই! সাগরপথে ইঞ্জিনচালিত যেকোন নৌযানে চড়ে সহজেই সেখানে চলে যাওয়া যায়। ট্রিয়াস্টে থেকে অনেকরকম নৌযান সারাদিন ভেনিস ও আশপাশের উদ্দেশ্যে ছাড়তেই থাকে। বিলাসবহুল ইয়ট থেকে শুরু করে মাছ ধরার নৌকা- সবকিছুতেই ভাড়ার বিনিময়ে চড়া সম্ভব।
ট্রিয়াস্টে যে দু'টি কারণে আমার স্মৃতিতে অমলিন হয়ে আছে সেগুলোর একটি মজার, আরেকটি ভয়ংকর। ভয়ংকরটি আগে বলে নিয়ে, মজার কারণটি দিয়ে লেখাটা শেষ করার ইচ্ছা আছে।
ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটেছিল ওই রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটারটার পাশেই। ছোট্ট শহরটা এত নিরিবিলি যে রাস্তায় ট্যূরিস্ট ছাড়া স্থানীয় অধিবাসীদের দেখা মেলাই ভার। এর মধ্যেই এক খর দুপুরে শহরের অলি-গলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চোখের সামনে অ্যাম্ফিথিয়েটারটা আবিস্কার করে ফেলি। অনেকক্ষণ ধরে গুগল ম্যাপে দেখাচ্ছিল আশপাশে দেখার মতো ভাল একটা কিছু আছে। কিন্তু কি সেটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ জীর্ণ-শীর্ণ ভগ্নদশার একটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি গ্যালারিমতো মানুষের বসার জায়গা দেখেই বুঝলাম, এটাই সেই নাট্যমঞ্চ। দুই হাজার বছর আগে ওই গ্যালারিতেই মানুষজন এসে বসতো, আর কুশীলবেরা সামনের মঞ্চে অভিনয়কলার প্রদর্শনী করতো।
দেখতে দেখতে ক্রমেই ভাললাগায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিলাম। পুরোনো মডেলের বলে হাতের সেমি-ডিএসএলআর দিয়ে ছবি ভাল ওঠে না, তাও যতোরকম ম্যানুয়াল সেটিংস্ অপটিমাইজ করার অপশন আছে- করে নিয়েছি এরই মধ্যে।
ছবি তোলার মোহে খেয়াল করি নি, আমি প্রায় চলে গিয়েছি অ্যাম্ফিথিয়েটারের পেছনে, মঞ্চসহ পুরো গ্যালারির কিছু শট নেবো এই আশায়। এরই মধ্যে আবার আরেক হাতে মোবাইলে নিচ থেকে উপরের দিকে প্যানারোমা নিচ্ছি আশপাশের বড় বড় গাছের।
হঠা্ৎ কথা নেই, বার্তা নেই পায়ের নিচে সামান্য 'পিছলা-খাওয়ার' মতো অনুভূতি টের পেলাম। নিচে তাকিয়ে দেখি, যা ভেবেছি তাই! কোনো এক হতভাগা ভবঘুরে দিনে-দুপুরে খোলা আকাশের নিচে অপকর্মটি করে রেখে গিয়েছিল। আর আমি আরেক হতভাগা সেই অপকর্মের ওপরেই গিয়ে উপবৃত হয়েছি!
সেই জুতা আমি অ্যাডিয়াট্রিকের পাড়ে বসে আধাঘন্টা ধরে ধুয়েছিলাম। তাও গন্ধ যায় নি। ট্যূরিস্টরা পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বড় বড় চোখে তাকিয়ে দেখে গিয়েছিল, ছেলেটা করে কি! কিছুতেই কিছু হয় নি। সেদিন মাঝে মাঝে তো মনে হচ্ছিল যে গন্ধটা জুতায় না, গন্ধটা আমার মাথায়। ইন্সটাগ্রামের সেই 'মিম'টার মতো। পৃথিবীর কোথাও কেউ কিছু বলছে না। শুধু আমার মাথায় ঘুরছে, 'তোর জুতায় ওই জিনিস'!
যাহোক ভয়ংকর এই কারণটি চাইলেও কখনো ভোলা সম্ভব নয়। তাই উল্লেখ করলাম। ভোলা সম্ভব নয়, শুদ্ধ বাতাসের ওই শহরটিতে প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠবার কথাও।
ওখানে ঘুম থেকে জেগে উঠলেই যে কথাটি মনে হয়, সেটা হচ্ছে- এখন একটা কফি লাগবে। আগেই বলেছি, শহরের মূল আকর্ষণ কফি। ইলি কফি যদিও বিখ্যাত হয়ে গেছে, তবে সেখানে আছে আরও অনেক রকম স্থানীয় কফির ব্যবসা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সেই ব্যবসা শত শত বছর ধরে চলে আসছে। ইলি-ই বরং তুলনামূলক তরুণ অন্যগুলোর তুলনায়। শত বছরের পুরোনো অবকাঠামোগুলো তারা এখনও ব্যবহার করে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পেরেছে বলে তারা এখনও টিকে আছে।
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে, প্রথম কাজটিই ছিল একটা সাগরমুখো কফির দোকান খুঁজে বের করা। তারপর দোকানের বাইরে পেতে রাখা চেয়ার-টেবিলে বসে একটা কফি, কখনও একাধিক কফি, আর একটা খ্রসাঁন্ট (Croissant) দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারা। সাগরের পরিশুদ্ধ বাতাস, ঢেউয়ের সুরেলা গর্জন, দিগন্তবিস্তৃত নীল জলের রাশি আর অদ্ভুত স্বাদের খ্রসাঁন্ট আর কফি। একটা সেই রকম স্টার্ট-অফ-দি-ডে যাকে বলে আরকি!
সেবার মাত্র তিন দিনে শহরটাকে মন দিয়ে ফেলেছিলাম আমি। কখনো সুযোগ হলে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আর একবার সেখানে যেতে চাই। অ্যাড্রিয়াটিকের পাড়ে বসে সবাই মিলে এক কাপ কফি আর এক চিলতে আড্ডা দিতে চাই।
কোনো একদিন, আবার কেউ একজন হারিয়ে যাওয়ার আগেই করতে চাই।
---
মন্তব্য করুন