পুরোনো গল্প
বেশ কিছুদিন ধরেই লিখতে বসবো বসবো ভাবছি কিন্তু বসা আর হচ্ছে না। প্রচণ্ড গতিময় একটা জীবন কাটছে। যেখানে একটি কাজের কথা ভেবে সাথে সাথে করে না ফেলতে পারলে পরে আবারও কাজটা করার সুযোগ খুব সহজে পাওয়া যায় না। ভাবলাম আজকের বিকেলে একটু উদাস উদাস ভাব আসছে। বসা যাক তাহলে লেখাটা নিয়ে।
ইউরোপে করোনা মহামারীর কালোছায়া আস্তে আস্তে কাটতে শুরু করেছে। আজকাল মাঝে মাঝে সেই মার্চ-এপ্রিলের সময়টার কথা ভাবি। প্রতিদিন বাড়ছে সংক্রমণ, বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। মানুষের কা্ছে কার্যত কোনো সঠিক তথ্য নেই। সবাই অনুমানের ভিত্তিতে যে যেভাবে পারছে বেচেঁ থাকার লড়াই করছে। সেই সময়টার তুলনায় এখন সবই অনেক অন্যরকম।
জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্ট অঞ্চলের অর্থনীতি কার্যত যে কয়টি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে পর্যটন তার অন্যতম। এ অঞ্চলের বিভিন্ন শহরে মানুষের চলাফেরা দেখে মনে হবে না- পৃথিবীতে করোনা মহামারী এখনও চলছে। বাংলাদেশ, ব্রাজিল, মেক্সিকোর মতো অনেক দেশেই সংক্রমণের হার এখনও ঊর্ধ্বমুখী।
তবে একটা কথা ঠিক যে, জার্মানিতে সরকার কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশন সম্পর্কিত যে কয়টি নিয়ম ও নীতি প্রবর্তন করেছিল, মানুষ তা মেনেছে মনে-প্রাণে। অত্যুৎসাহী জনতা শুধুমাত্র অন্যরা বাসায় থাকছে কিনা দেখার জন্য কিংবা কোয়ারেন্টাইন কেমন হচ্ছে ব্যাপারটা বোঝার জন্য রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ভিড় বাড়ায় নি।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আর ওষুধের দোকান ছাড়া অন্যান্য দোকানও বন্ধ ছিল দিনের পর দিন। বাস, ট্রেন সবই চলেছে ভীষণ সীমিত পরিসরে, একদম যতটুকু না হলেই নয় শুধু ততটুকুই। মানুষ অফিস-আদালত বাসায় নিয়ে গেছে। যাদের দিনমজুরির ভিত্তিতে কাজ করে পেট চালাতে হয়, তাদেরকে সরকারের বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
এখানে অবশ্য একটা বিষয় খুব লক্ষণীয়। সরকারি বরাদ্দের টাকা কিন্তু খুব বেশি ছিল না। শুধুমাত্র এখানকার স্থানীয় নেতা-নেত্রীরা সেখান থেকে চুরি করে কিছু সরিয়ে রাখে নি বলে, যার সত্যিই ওই টাকাটা দরকার ছিল সে-ই পেয়েছে। চুরির অভ্যাসটা ছাড়তে পারলে, কাড়াকাড়ি করে নেয়ার মানসিকতা দুরে ঠেলে সবাই মিলে বাঁচবো বলে পরিকল্পনা আটঁতে পারলে পৃথিবীর যেকোন গরীব দেশে সেই সব পরিকল্পনা-ই বাস্তবায়ন করা সম্ভব, যেগুলো অসম্ভব বলে চিন্তা করে আসা হয়েছে এতদিন। বস্তুত মানুষের মাথায় ওগুলোকে অসম্ভব বলে চিহ্নিত করে রাখতে পারলে আখেরে চোরদেরই লাভ। তাদের চুরির পথে কোনো বাঁধা থাকে না। চোরেরা সবাই মিলে যদি কষে একটি পরিকল্পনা এটেঁ মাঠে নামে তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়?
কোথাও না। তাই তো আমাদের দেশে একদিকে সাধারণ মানুষ লাখে লাখে সংক্রমিত হয়, বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, অন্যদিকে কেউ কেউ হেলিকপ্টারে চড়ে চিকিৎসা নিতে বিদেশ যায়।
যাই হোক, এইসব পুরোনো গল্প। নতুন করে বলার কিছু নেই।
সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজরকে পথের মধ্যে গুলি করে মেরে ফেলার ঘটনা নিয়ে দেশে বেশ তোলপাড় হচ্ছে। এই প্রথম এ ধরনের ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশের ভ্যানে ওঠাতে দেখা যাচ্ছে। আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম পুলিশ হতে পারলে সাত খুন মাফ। জীবনে সব অপরাধের সাজা একটাই। ক্লোজ করে ব্যারাকে পাঠানো। এখন দেখলাম না তা নয়। বরং টেকনাফের মহাপ্রতাপশালী সেই ওসি এবং তার চেলা চামুন্ডাদের তো আসলেই জেলে পোরা হলো গো।
সমস্যা হয়েছে সেই নিহত মেজরের সঙ্গে যারা ছিলেন তাদের। বিশেষ করে সঙ্গে থাকা একজন নারীকে ভুগতে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। তা সেটি তো হবেই। যে দেশে এ ঘটনাটা ঘটেছে, সে দেশের সিংহভাগ মানুষ আজও বিশ্বাস করে নারীর মুক্তি বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। তাদের জন্ম হয়েছে পারলে ঘরের চার দেয়ালের মধ্যেই বন্দি হয়ে থাকার জন্য। সেখানে তো ভুক্তভোগী শুধু যে নিজেকে ঘরের চার দেয়ালের বন্দিত্ব থেকে মুক্তিই করেছেন তা নয়, আবার মুক্ত মনে তিনি নিজের একটি হাফপ্যান্ট পরিহিত (যথেষ্ট রুচিশীল পোশাক যদিও) ছবি অনলাইনে বিচরণের সুযোগ দিয়েছেন। তা তিনি এটি করতেই পারেন। তবে যেখানে বসে কাজটি করছেন, সেখানে না আছে তার পাশে দাঁড়ানোর মতো সমাজ, না আছে রাষ্ট্র, না আছে কোনো সুপারহিরো। কি হবে? যা হওয়ার তাই হচ্ছে। মানুষজন 'ব্লগ দিয়ে ইন্টারনেট চালিয়ে' চারিদিক গরম করে তুলছে। আরেকদল সেই গরমে 'গেল গেল' বলে হাওয়া দিচ্ছে। বিচার শুরুর আগেই বিচারে কি হবে, কি হবে না- অনুমান করে তারা সবাইকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।
এ কাঠগড়া আবার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের কাঠগড়া। বাজারে আসা নতুন কাঠগড়া। সবে ১৬-১৭ বছর হল এ কাঠগড়া তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে এ কাঠগড়ার বহুল ব্যাবহারও বেশিদিনের নয়। মেরে-কেটে ১০ বছর হতে পারে। তার আগে কিন্তু দেশে ইন্টারনেটও অতো সুলভ ছিল না, স্মার্টফোনও অতো কমমূল্যে পাওয়া যেতো না।
তা যা হোক। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর ভাল-মন্দ দুই দিকই রয়েছে। ওই নিয়ে কথা বলতে বসলে রামায়ণ হয়ে যাবে। আর কথাগুলোও তো নতুন কিছু নয়। জানি আমরা সবাই-ই। অন্তত আমার এই লেখা যার যার কাছে পৌঁছুচ্ছে তারা তো জানেন অবশ্যই।
তবে আমার একটা প্রশ্ন বিজ্ঞ সমাজের কাছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকে যে আমরা এত গুরুত্ব দিই, এই মাধ্যম কি আমাদের খুব ভাল কোনকিছু অর্জনের সুযোগ আসলেই করে দিতে পেরেছে? এই যে মানুষ এখন উল্লিখিত মেজরটির হত্যার বিচারের দাবি থেকে সরে- তার সঙ্গের একজন নারীর পোশাক নিয়ে মেতেছে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে এসবের বহুল চর্চা না থাকলে কি আজ মানুষের দৃষ্টি ওই হত্যাকাণ্ডের দিকেই বেশি থাকতো না?
এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজছি কিছুদিন ধরে। আমি বলছি না দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমরটারে রুখতে। কিন্তু দরজা দিয়ে কি প্রবেশ করবে আর কি প্রবেশ করবে না- সেটি নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা যে আমাদের নেই এটিও তো ভুল না।
তাহলে?
আমাদের কি চীনের মতো এই দরজাটা বন্ধ করে দিয়েই দেখতে হবে কি হয়?
---
মন্তব্য করুন