আমার রাজকন্যার গল্প
আজ ১৪ নভেম্বর।আমার রাজকন্যার বয়স তিন মাস পূর্ণ হলো।সময় কত দ্রুত যায়! এই তো সেদিন ১৪ আগষ্ট,২০১৩ বুধবার দুপুর ২টা ৪০মিনিটে গগনবিদারী চিৎকার করে আমার রাজকন্যা এলো এই কঠিন পৃথিবীতে।এরপর থেকে এই তিন মাস সময় যেন চোখের অলক্ষ্যেই কেটে গেছে।রাতের ঠিক নেই,দিনের ঠিক নেই।রাত-দিন যেন মিলেমিশে একাকার।
রাতে ঘুমানোর আয়োজন করছে সবাই,অথচ আমার রাজকন্যা কেঁদে অস্থির।সারাটা রাত থেমে থেমে কান্না দিয়েই শেষ করেছে প্রথম এক মাস।
দ্বিতীয় মাসে রাজকন্যা একটু বড় হলো।তাই দ্বিতীয় মাসের রাতগুলো সে কাটিয়েছে বিরামহীন কান্নায়।তার কান্নায় পাড়া প্রতিবেশীর ঘুমের বারটা বেজে যেত।আর তাই সকালবেলা রাজকন্যার নানুমনিকে মুখোমুখি হতে হতো একগাদা প্রশ্নের,নাতনী এত কাঁদে কেন?ডাক্তার দেখান।হুজুরের কাছ থেকে তাবিজ আনুন। মনে হয় কারো নজর লেগেছে।এরকম হাবিজাবি আরও অনেক কথা।
তৃতীয় মাসে রাজকন্যা তার দাদাভাইয়ার বাসা থেকে বেড়িয়ে এসে বেশ লক্ষীটি হয়ে গেছে।এখন সে মাঝে মাঝে রাতে জেগে থাকে।তবে আমার রাজকন্যা একা রাত জাগতে পছন্দ করে না বলে ইদানীং তার মার পাশাপাশি তার বাবাকেও রাতটা জেগেই পার করতে হয়।
আমি যখন অফিস থেকে ছয় মাসের ছুটি নিচ্ছিলাম তখন অনেক শুভাকাংখীই বলেছিল,আপা দেখবেন এই ছয় মাস সময় যে কিভাবে চোখের নিমিষে কেটে যাবে আপনি টের ই পাবেন না।আবার অনেকে বলেছে এত ছুটি দিয়ে কি করবেন? বাচ্চা পালতে ছয় মাস লাগে না।দেড় –দু’মাসেই বাচ্চা যথেষ্ট বড় হয়ে যায়।
কেউ কেউ তো ঈর্ষায় কাতর হয়ে বলেছিল ছয় মাস ছুটি সরকারের বাড়াবাড়ি।দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি এধরণের কথাগুলো কোনো ছেলে নয় বরং মেয়েদের কাছ থেকেই শুনতে হয়েছে।
আমার রাজকন্যা,আমার স্বপ্ন-এ আক অন্যরকম অনুভূতি।যেদিন প্রথম আমার শরীরে অন্য একজনের অস্তিত্বের কথা জানতে পারলাম কী অদ্ভুত একটা সুখ ছুঁয়ে গেল।কিন্তু এরপর থেকে যখন তীব্র শারীরিক কষ্টের সময় পার করছিলাম আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করব।যারাই আমার আশেপাশে আমার এই তীব্র শারীরিক কষ্ট দেখেছিল সবাই বলেছে মা হতে কষ্ট আছে,অনেক কষ্ট।কিন্তু তোমার মতো এত ভয়াবহ কষ্ট সবার হয় না।তোমার টা অস্বাভাবিক পর্যায়ের।
মনটা কেমন যেন অজানা শংকায় কেঁপে ওঠে।কোনো সমস্যা নয়তো।ডাক্তার ভরসা দেন।হ্যাঁ,কষ্টটা একটু বেশিই হচ্ছে আপনার,কিন্ত তার মানে এই নয় যে এরকম আর কারো হয় না।এরকম কষ্ট অনেকেরই হয়। তবে সংখ্যায় অনেক কম। ভয়ের কিছু নেই।আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।
দিন যায়,সপ্তাহ যায়,মাস যায়-কষ্ট যেন কিছুতেই কাবু হতে চায় না।দিনের পর দিন কিছু খেতে পারি না।যদি ও বেশ কষ্ট করে কিছু খাই তাৎক্ষনিক বমি হয়ে আরো দুর্বল হয়ে পড়ি।মাথাটা কেমন দুলতে থাকে।চোখ মেলে রাখা দায়।আর ছিল অসহ্য রকম পেটে ব্যথা।এত বেশি ব্যথা হতো যে আপনাতেই কান্না চলে আসতো।
সবাই বলতো তিন মাস পর এই কষ্ট কমে যাবে।কিন্তু তিন মাসই তো আর শেষ হয় না।প্রতিদিন ক্যালেন্ডারে দিন গুনতাম।কেউ যখন জিজ্ঞেস করতো কেমন আছি ,ভাল নেই বলতে বলতে একটা সময় নিজের কাছেই কেমন অস্বস্তি লাগতো।কারণ ততদিনে অন্যরাও যেন কিছুটা হাঁপিয়ে উঠেছে।
অফিস করতে কী অসহ্য কষ্ট হতো।
কতদিন মনে হয়েছে চাকরীটা যদি ছেড়ে দিতে পারতাম!চাকরীটা আমার খুব শখের চাকরী।আবার অনেক কষ্টের ও।অনেকে না চাইতেই নাকি চাকরী –বাকরী পেয়ে যায়।আমাকে বেশ কষ্ট করেই পেতে হয়েছে।কত জায়গায় পরীক্ষা দিয়েছি!!তারপর একদিন কষ্টের প্রতিদান পেলাম।সেই এত কষ্টের চাকরীটাও আর ভাল লাগছিল না।
আমার রাজকন্যা কেঁদে ওঠার আগ পর্যন্ত আমরা জানতাম না আমাদের সন্তান ছেলে নাকি মেয়ে।ডেলিভারীর নির্ধারিত ডেটের আগেই যখন ডাক্তার সিজার করতে বললেন আমার আপনজনেরা সবাই বেশ ভয় পাচ্ছিল।অথচ আমার একটু ভয় ও লাগছিল না।
শারীরিক যন্ত্রণা আমাকে এত বেশি কাবু করে ফেলেছিল আমার আর কোনো ভয় ই হচ্ছিল না।শুধু প্রার্থনা ছিল আমার সন্তান যেন সুস্থ থাকে।সে যেন সুস্থ ভাবে পৃথিবীতে আসে।তার মুখের দিকে তাকিয়ে যেন আমি ভুলে যাই এতদিনের সব কষ্ট।আমাকে অবশ্য আমার প্রিয়জনেরা বলেছিল,যখন নিজের সন্তানের মুখটি দেখবে,তাকে বুকে টেনে নিবে মুহূর্তেই ভুলে যাবে নয় মাসের শারীরিক কষ্ট।
আমার সন্তান যখন চিৎকার দিয়ে তার অস্তিত্বের কথা জানান দিল আমি ডাক্তারকে বললাম,আপা কি?ডাক্তার হেসে জবাব দিলেন,আপনার একটা মেয়ে হয়েছে।
আমি কাউকে বলে বোঝাতে পারব না সেই মুহূর্তের সেই অপার্থিব সুখের কথা।এত খুশি লাগছিল আমার !!আমি খুশিতে কেঁদে ডাক্তারকে বললাম আপা ও ভাল আছে তো।ডাক্তার বললেন,হ্যাঁ,ভাল আছে।আপনি কান্নার শব্দ শোনেন নি?হেলদি বেবী আপনার।
কী সুখ!!!মুহূর্তেই যেন পালটে গেল সব কিছু।সবকিছু এত সুন্দর,এত সুখের মনে হচ্ছিল-আমার রাজকন্যা এসেছে অবশেষে।কত দীর্ঘ পথ পেরিয়ে সে এসেছে।
সিজার অপারেশনের শেষ দিকে হঠাৎ মনে হলো মারা যাচ্ছি।নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।অনেক কষ্টে থেমে থেমে ডাক্তারকে বললাম,আপা আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে,আমি কি মারা যাচ্ছি?পাশে থাকা এনেস্থেসিষ্ট ডাক্তার বললেন,তিন চার মিনিট এরকম কষ্ট হবে।এরপর ঠিক হয়ে যাবে।
আমার মনে হচ্ছিল আমি বোধহয় মারাই যাচ্ছি।তখন আবার আমার মনে হলো রাজকন্যার বাবাতো আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে বাইরে।রাজকন্যার বাবার সুখী সুখী চেহারাটা না দেখেই মরে যাব!!ওমা!আমি তো আমার রাজকন্যার মুখটিও দেখলাম না।
সেই রাজকন্যাকে নিয়েই এখন আমার প্রতিটা মুহুর্ত কাটে অন্যরকম সুখে।যদিও ভয় হচ্ছে আর মাত্র ক’দিন পরেই রাজকন্যাকে রেখে অফিস করতে হবে।আমার মেয়েটা কাঁদবে,অথচ মাকে পাবে না কাছে ভাবতেই মনটা বিষন্ন হয়ে যাচ্ছে।চোখ দুটো ভিজে উঠছে।কর্মজীবী মায়েদের সন্তানরা এভাবেই বেড়ে ওঠে।এটা জানার পরও মনে হচ্ছে এই বঞ্চনা থেকে আমাদের সন্তানদের কোনোভাবেই কি মুক্ত করা যায় না?
আমাদের রাজকন্যা এখন হাসে।মাকে চিনে।বাবাকে চিনে।চেনা মানুষ দেখলে খিল খিল করে হাসে।ও যখন হাসে আমার মনে হয় সারা পৃথিবীটা হেসে উঠে।এই হাসি যেন সারা জীবন থাকে এই প্রার্থনা আমাদের সবার।ভালো থেকো মা,অনেক ভালো.................................।
দারুণ সংবাদ! রাজকন্যার জন্য অসংখ্য অজস্র শুভকামনা। বেড়ে উঠুক বাবা-মায়ের আদরে। মানুষের মতো মানুষ হোক।
অনেকদিন পর আপনাকে দেখলাম ঝর্ণা আপু। অবশ্য বুঝতে পারছি, কেন এই বিরতি। এখন থেকে নিয়মিত রাজকন্যার ছবিসহ আপডেট দিয়েন।
নাম কি রেখেছেন রাজকন্যার?
ধন্যবাদ মীর ভাই।
হ্যাঁ ,অনেক বেশি অসুস্থ ছিলাম বলেই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ব্লগে,ফেসবুকে,এমন কি মোবাইলে ও কারো সাথে তেমন একটা যোগাযোগ করতে পারিনি।
১১ মাস পর এই লেখাটা লিখলাম।
দোয়া করবেন আমার রাজকন্যাকে সামলিয়ে আবার যেন নিয়মিত আপনাদের সাথে থাকতে পারি।
রাজকন্যার নাম জাইফা সারোয়ার স্বপ্ন।
ফেসবুকে দেখলাম, দারুণ দেখতে রাজকন্যা!
দোয়া রইলো!
এটা সব মায়েদেরই হয়। একটা কী জানি মেডিক্যাল টারমও আছে এটার। মন খারাপ করো না, শুরুর দিকে খারাপ লাগলেও .....একদিন সব সহ্য হয়ে যায়
হ্যাঁ তানবীরা'পু আমিও বিশ্বাস করি একদিন সব সহ্য হয়ে যাবে।অন্য বাচ্চাদের মতো আমার রাজকন্যাও নিশ্চয়ই কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিতে শিখবে।
রাজকন্যার জন্যে অনেক অনেক আদর আর ভালোবাসা..
রাজকন্যার পক্ষ থেকে রাজকন্যার মামাদের অনেক ধন্যবাদ ..............................
রাজকন্যা'র জন্য অনেক দোয়া
রাজকন্যার মায়ের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা .......................
সেই রাজকন্যাকে নিয়েই এখন আমার প্রতিটা মুহুর্ত কাটে অন্যরকম সুখে।যদিও ভয় হচ্ছে আর মাত্র
ক’দিন পরেই রাজকন্যাকে রেখে অফিস করতে হবে।আমার মেয়েটা কাঁদবে,অথচ
মাকে পাবে না কাছে ভাবতেই মনটা বিষন্ন হয়ে যাচ্ছে।চোখ দুটো ভিজে উঠছে।
এটা বাস্তবতা। কত কষ্ট বুকে চেপে কাজ করতে হয় এক মাই তা জানে। যাই হোক ভাল থাকুক রাজকন্যা সসুস্থ থাক মানুষ হোক এই কামনা করি।
দোয়া করবেন আপু,আমার রাজকন্যাকে সুস্থভাবে সামলিয়ে যেন অন্য কর্মজীবী মায়েদের মতো আমিও কাজ করতে পারি ।
জানেন, আমারও একটা রাজকন্যা আছে - রিয়াসা। আমি যতক্ষন জেগে থাকি, আমার আশেপাশেই ঘুরঘুর করবে, তারপর অনেকটা জোড় করেই নিয়ে যাবে বিছানায়। বাবার গলা ধরে না ঘুমালে তার ঘুমই হয়না!
আপনার রাজকন্যার জন্য অনেক অনেক দোয়া রইল। ভাল থাকুক রাজকন্যারা।
রাজকন্যা রিয়াসা মামনির জন্য অনেক আদর।
রাজকন্যারা বোধহয় একটু বেশিই বাবা ভক্ত হয়।
আমার ৩ মাস ১০ দিন বয়সী মেয়ে এখনই তার অফিসে যাওয়ার সময় ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে থাকে।আবার রাতে বাবা বাসায় ফিরলে এমন ভাবে হাসবে যে মনে হয় এতক্ষণ বুঝি বাবার অপেক্ষাতেই ছিল।
বাবা-মেয়ের এই ভালোবাসা দেখতে বেশ ভালোই লাগে।
হ্যাঁ ঠিক বলেছেন ভাইয়া,ভাল থকুক আমাদের রাজকন্যারা।
মন্তব্য করুন