স্বাধীনতার কবি শামসুর রাহমান স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি ।
"স্বাধীনতা তুমি
রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান ।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুলের ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দুলানো
মহান পুরুষ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা ।"
এই অসাধারণ কবিতার স্রষ্টা কবি শামসুর রাহমান । তিনি আজতক বাংলাদেশের প্রধানতম কবিদের একজন । বাঙলা সাহিত্যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের পরই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি কবিতা লেখার দাবিদার শামসুর রাহমান । কবি শামসুর রাহমান একটি বিশিষ্ট ধারার ভেতর সাহিত্য চর্চা করেছেন ; এবং সেই ধারা তাঁর মৌলিক অবদানে সমৃদ্ধ হয়েছে । তিনি তার নিজস্ব কাব্যভাষা তৈরি করে নিয়েছিলেন । এই জনপদের শহর , প্রকৃতি , ইতিহাস সর্বোপরি মনে-প্রাণে বাঙলা-বাঙালির কথা বারবার তাঁর কবিতায় ফুঁটে উঠেছে ।
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শুরুতে তিনি যখন কাব্যচর্চা শুরু করেন তখন বাঙলা সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর নানা ধরণের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন-নিষ্পেষণ চলছিল । বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে খণ্ডিতকরণ , ভাষার বিকৃতিসাধন , রবীন্দ্রনাথ তথা গোটা রবীন্দ্র সাহিত্যকে বর্জন করা থেকে নজরুল সাহিত্যকে সংশোধন , এমনকি বাঙলা বর্ণমালা বদলে ফেলার কদর্য তৎপরতা চলছিল । যেমন - 'সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি , সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি ।' "অগত্য" নাম্নী পত্রিকায় 'তমুদ্দনি বাঙলা ভাষায়' এই কবিতার ভার্সন ছাপা হল এইভাবে ... "ফজরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি , হররোজ আমি যেন আচ্ছা হয়ে চলি ।" বাঙালিরা তখন তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে এর প্রতিবাদ এবং সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গরে তোলে । আর এই সাংস্কৃতিক - সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সাহসী বীর , সংগ্রামী-সারথি ছিলেন আমাদের শেরপা শামসুর রাহমান ।
বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবে , অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নিপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি হবে এ স্বপ্ন একদিন বাস্তবে হয়েছে । বিপ্লব হয়েছে দেশ স্বাধীন-মুক্ত হয়েছে । শামসুর রাহমানের কবিতায়ও সেই অগ্রগমনের সংবাদ আছে । '৭১-এ তিনি অস্ত্র ধরেন নি সত্য , কিন্তু বন্দী ছিলেন দেশের লক্ষ-কোটি মানুষের সঙ্গে ; তখনো তিনি কবিতা লিখেছেন , জানতেন এই বন্দীদশা চূড়ান্ত নয় । '৭১ পরবর্তী অন্য সবার সঙ্গে তিনিও মুক্ত হয়েছেন । কেবল মুক্তিযুদ্ধই নয় ; '৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সৈনিকদের নিয়ে লিখেছেন - 'দুখিনী বর্ণমালা' , 'আসাদের শার্ট' কবিতাগুলো ছিল গণমানুষের হাতে হাতে উত্তোলিত পতাকা ।
বাঙলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি শামসুর রাহমান । কেবল সংখ্যার বিচারে নয় , তাঁর কাব্যকুশলতা বাঙলা সাহিত্যকে নতুন ঢঙে , নতুন মাত্রায় , স্বদেশ-স্বাদেশীকতায় উন্নীত করেছে । এ সময়ের আরেক প্রধান কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যথার্থ বলেছেন - "তাঁর সব রচনা বিশ্ব সাহিত্যের অন্তর্গত , তাঁর পা সব সময় গাঁথা থেকেছে স্বদেশের মাটিতে ।"
নির্জনতার, নিঃসঙ্গতার নির্ণীত বলয়ে থেকে শামসুর রাহমান তার নিজস্ব ধারা সৃষ্টি করে গেছেন । যা বাঙলা-বাঙালির স্বাধীনতাকে চূড়ান্ত পরযায়ে নিয়ে যায় । যা তাঁর কবিতায় স্পষ্ট ফুঁটে উঠেছে -
"তোমাকে পাওয়ার জন্য , হে স্বাধীনতা ,
তোমাকে পাওয়ার জন্য আর কতকাল ভাসতে হবে রক্ত গঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহ ?
তুমি আসবে বলে , হে স্বাধীনতা , সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো ,
সিঁথির সিদুর মুছে গেল হরিদাসীর ।
তুমি আসবে বলে , হে স্বাধীনতা ,
শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এল -
দানবের মত চিৎকার করতে করতে ।"
এ যেন বুক তাঁর স্বাধীনতার ; হৃদয় তাঁর বাংলাদেশের । আজ এই প্রয়াণ দিবসে তাঁকে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি ।
আজ এই প্রয়াণ দিবসে তাঁকে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি
কবিকে শ্রদ্ধা
গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায় ।
প্রয়াণ দিবসে কবিকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
মন্তব্য করুন