ইউজার লগইন

বন্ধ্যাকাল ও আমি

প্রতিদিন ডিউটি থেকে আসি রাজ্যের যতো বিষাদ-ক্লান্তি নিয়া । প্রতিদিনই ভাবি দেবো কালই চাকরি ছেড়ে ! সেই কাক-সকালে বেরোই আর ফিরি মোরগ-সন্ধ্যায় । শালা গুল্লি মারি কলেজ মাস্টারির ...দিলাম কালই রিজাইন ! না হয় না , চাইলেই পারি না । আসা-যাওয়ায় টানা চার ঘন্টা ডিউটি আর ক্লাশ করার পর আর শরীরে কুলোয় না । এই টানাপোড়নের মাঝে যে টুকু হৃদয়ে পুলক জাগায়ে যায় তা হলো মেঘালয় পাহাড় ! প্রতিদিন এই মেঘালয়-ই কী আমাকে এই দীর্ঘভ্রমণে নিয়ে যায় ? হয়তো ! তাই যদি নাই হবে তবে কেনো মেঘালয়ের পেজাপেজা মেঘের উড়াউড়ি দেখেদেখে ক্যাম্নে যে কলেজ বারান্দায় পৌঁছে যাই টেরও পাই না । মেঘালয়ের শাদা মেঘের দল উড়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই কোনো বিরাম নাই । হয়তো টুক করে দেখা গেলো কোনো পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লেগে উড়ে যাচ্ছে নয়তো অভিমানে বৃষ্টি হয়ে ঝরে যাচ্ছে । প্রায় দু'ঘন্টার ভ্রমণে এই মেঘালয় আমাকে দেড় ঘন্টা মোহিত করে রাখে । এই মোহিতাবস্থা আমাকে কলেজ পর্যন্ত-ক্লাশ পর্যন্ত মোহাবিষ্ট করে রাখে । মেঘালয় আজো তার বুকে মেঘ-ঘন ঘোর মেঘকে বুকে নিয়ে চলে , বুকের ভিতর তখন কে যেনো বাদাম টেনে দেয় । হয়তো চিনচিনে ব্যাথাও হয় , মোহাচ্ছন্ন থাকি হয়তো সে ব্যাথা বুঝতে পারি নে ।

তখন কতো কিছু মনে পড়ে ... তবে বেশি মনে পড়ে শক্তি চাটুজ্জ্যো'র ঐ কবিতা , অবনী বাড়ি আছো ? কৈ আর কারো মুখ তো মনে পড়ে না ? নাকি পড়ে , বুঝতে পারি না ? এই-ই রোজকার চিত্র । মাঝে লাঞ্চ । এই সময়টা একটু এই অঞ্চলের মানুষদের খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করি , করতে পারি কী ? তো প্রতিদিন ই একটা লোককে দেখি যে কিনা এই ছোট বাজারে ঘুরেঘুরে নানা ভঙ্গিমায় ভিক্ষে করে বেড়ায় । পান খাওয়া লালচে কালো মতো করে দাঁত , আর পানরস থুতনি পর্যন্ত যাওয়ার জন্য ইতিউতি করছে । আমাকে-আমাদেরকে ভালোই চেনে । খেয়াল করলাম সে আমাদের কাছে সপ্তাহে একদিন পরপর মোট তিনদিন ভিক্ষে চায় । তবে দুটো পিচ্ছি পরদিনই ভিক্ষে থেকে খাবার পর্যন্ত চায় । কখনো কখনো হাত-পা এমনকি প্যান্টও খামছে ধরে । আবার যখন ফেরার প্রস্থুতি নিয়ে আসি তখনো ঐ দু'টো ধাওয়া করে ।

বাস থেকে নামি রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে । কিন্তু শহরে এসে চাইলেও হুটহাট বাসায় ফিরতে পারি না । বন্ধু-বান্ধব , চা-সিগারেট আড্ডাবাজী করতে করতে এগারো নয়তো বারো । কখনো রেস্টুরেন্টে না হয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে । এর মাঝে যে জিনিষটা চরম বিরক্ত করে তা হলো ... প্লিজ গিভ মি ওয়ান পাউন্ড ! এখন এই বাক্য শুনলেই বুঝি কে সে । চমকাই না । কিন্তু এর মাঝে যে একের পর এক হাত পাততেই থাকে তার সময়সীমা পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর । মধ্য বয়সী থেকে থুত্থুরে বুড়াবুড়ি পর্যন্ত আছে এই ভিক্ষের মিছিলে । হঠাৎ একদিন হয়তোবা দেখলাম এই চেনা মুখের মধ্যে একজন নাই । কিন্তু নতুন মুখ অনেক । এরা প্রায় ভাবলেশহীন । চেহারা নির্বিকার । হয়তো পেশাটাকে ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারে নাই কিংবা মানাতে পারে নি হয়তোবা সে এই রকমই ভাবলেশহীন ! কিন্তু খেয়াল করলাম যারা নাই মানে নিত্যদিনের ভিক্ষা করতে যাদের দেখি তাদের বেশির ভাগই নাই হচ্ছে বুড়োবুড়ি । এদেরও প্রশ্ন করি তাদের লগের বুড়ো কিংবা বুড়ি কই ? খটখটে গলায় উত্তর আসে মইরা গ্যাছে গা কিংবা বাড়ি চইলা গ্যাছে গা অথবা জানি না । এতোদিনের সুখ-দুঃখের সাথী আর সে কিনা ট্যাঁটা গলায় বলে মইরা গেছে গা ! একটুও দুঃখবোধ নাই ? কি জানি হয়তো আছে , হতো নাই । কিংবা সেও হয়তো বুঝে নিয়েছে এইভাবে তো তারও একদিন নাই হইয়া যাইতে হইবে , তাই হয়তো এটা ওদের কাছে স্বাভাবিক ।

তখন খুব খারাপ লাগে , বিষণ্ণ-ভারাক্রান্ত হয়ে যায় মন । আহা ... সেদিন ঐ বুড়োটাকে কেনো ২০টা টাকা দিলাম না ! ভাত খাইতেই তো চাইছিলো ... সেদিন কি পকেট খালি ছিলো নাকি ফাঁকা । এই ভাবতে ভাবতে ঐ কুঁজো একদম মাথাটা নুয়ে পড়া , পেটের কাছে লেগে থাকা মুখ কি ভালো করে দেখেছি ? মনে পড়ে না কেনো ? আবছা , অস্পষ্ট পড়ে ... শাদা ধবধবে দাঁড়ি কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ । এইতো এইতো মনে পড়ছে , দেখতে পাচ্ছি চাচামিয়াকে । চাচা ডাকতাম কী ! মনে পড়ছে না ... মরে গেছে বলেই কী 'চাচা' সম্বোধন করছি ? মৃত মানুষ , চাচা ডাকলেই কী আর না ডাকলেই কী ? জীবিতের সম্মান নাই ... মৃতেরে মরিচা ধরা হ্রদয়ে নিয়া বসাই ! এই ভাবি হয়তো কিংবা ভাবিও না , বোধ-অবোধ নাবোধের দোলাচলের ফাঁফরে হাসফাঁস করে মন ।

'বাবা আল্লার অস্থে আমারে ভিক্ষা দিবায় নি!' তাকাই । দেখি লোকটাকে । চোখ বড়বড়ো হয়ে যায় , এ তো সেই বুড়া ! মরে নাই ! সেই লোকটাই তো , হ্যা সেই বুড়োটাই । পকেট হাতড়ে বেড়াই হয়তো ... পেছন থেকে কে যেনো বুড়োকে নানা বলে সম্বোধন করে এর হাত ধরে আছে । ঐ বুড়োর তো তিনকালে কেউ ছিলো না । আর এর হাতে লাঠি নাই । এ সে না অন্য কেউ , অন্যজন । আসলেই কী সে অন্য কেউ , নাকি ঐ বুড়ো-ই সে ? সব বদলায় এরা বদলায় না । নাকি এরা স্থির , নিথর-নিশ্চল ? শহরের রাতারাতি গাড়িবাড়ি হচ্ছে , রাস্থা-ঘাট কি পরিবর্তন হচ্ছে না ! সব হচ্ছে । কিন্তু এদের দৃশ্য স্থির-অচল সাদাকালো রাংতায় মোড়ানো । এরা কি জানে এরা কবে থেকে ভিক্ষুক ? জানে না । এই শহর কিংবা আমার কলেজের বাজারের আশেপাশের ভিক্ষুক কি এক না বহু ? নাকি বহু-ই এককে এক জায়গায় আটকে রেখেছে , কোনটা ? মাথা ভারী হয়ে উঠে ... তন্দ্রাচ্ছনের মতো কখোন জানি নিজের অজান্তেই পা বাড়াই বাসার উদ্দেশ্যে নিজেই জানি না ।

পোস্টটি ১৭ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


আপনি অনেক ভাল লেখেন,
তবে লেখাটা মন খারাপ করে দিল।

আপনি কি সিলেট থাকেন?
আপনার কলেজের নাম কি?

মনির হোসাইন's picture


পাম দিয়েন না রাসেলভাই Glasses তবে মন খারাপ করে দেয়ার জন্য আমি কিন্তু দায়ী না ! Wink

আনন্দবাবু's picture


উদাস হয়ে গেলাম।

মনির হোসাইন's picture


Smile

জেবীন's picture


সেই ছোট্টকালে স্কুলে যাবার সময় দেখতাম সক্কালবেলাতে এক অন্ধ মহিলাকে একটা লোক বাসস্ট্যান্ডের কাছে বসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আবার দূপুর গড়িয়ে বাড়ি ফেরার সময়ও দেখতাম তপ্ত রোদের মাঝে সে বসেই আছে। স্কুল-কলেজ-ইউনি পার করলাম একসময় গা সওয়াই হয়ে গেছিলো, জানতাম মহিলা ওখানেই থাকবেন, তবে আশ্চর্যের কথা মহিলার যেন কোন পরিবর্তন দেখতাম না। বছর দুয়েক আগে তার বসার জায়গাটার কাছেই বড় এপার্টমেন্ট আর দোকানপাট গড়ে উঠায়, মহিলা অন্য কোথায় যেন চলে গেলেন। কতবারই বা ভিক্ষা দিয়েছি তাকে, খুব হাতেগোনাই। কিন্তু যখন থেকে দেখতে পাই না, ঠিকই খুজি আর ভাবি দেখতে পেলে কিছু টাকা দিবোই!

আপ্নের লেখাটা বিষন্ন করে দেয় খুব।

মনির হোসাইন's picture


হ্যাঁ . . . এই জায়গা কিন্তু ফাঁকা থাকে না , কেউ না কেউ এসে তা পূরণ করে নেয় !

আমি কিন্তু বিষণ্ণ করতে চাই নি Sad

তানবীরা's picture


কিছু বলার নেই Sad

মনির হোসাইন's picture


Sad

লীনা দিলরুবা's picture


লেখাটা বিষণ্ন করে দিলো।

১০

মনির হোসাইন's picture


লীনাপা , আমি কিন্তু তা করতে চাই নি. . . Sad

১১

মীর's picture


আমাদের মহল্লায় স্বামী-স্ত্রী ভিক্ষুক আছে। তারা একসঙ্গেই কাজ করে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর।

১২

মনির হোসাইন's picture


এদের কথা বলুন শুনি... Smile

১৩

মীর's picture


আরে কি বলেন! আপনের মতো সুন্দর করে লিখতে পারবো না, নাইলে তো লিখতামই।

১৪

মনির হোসাইন's picture


পাম দিয়েন না , মীরদা Tongue আপ্নের লেখার হাত কিরকম তা এই 'আমার বন্ধু'র ব্লগার সব্বাই জানে Smile লিখেন...

১৫

রায়েহাত শুভ's picture


বিষণ্ণ একটা লেখা...

১৬

মনির হোসাইন's picture


Sad

১৭

জ্যোতি's picture


লেখাটা কালই পড়েছিলাম। মন খারাপ করা সুন্দর একটি লেখা। নিয়মিত লিখেন।

১৮

মনির হোসাইন's picture


আমি কিন্তু এই লেখাটাকে এতোটা বিষণ্ণ করে তুলতে চাই নি ! হয়ে গেছে কেমন করে নিজেই জানি না। দেখি লিখতে পারি কি না Smile

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

মনির হোসাইন's picture

নিজের সম্পর্কে

কিছুই বলার নেই !