বইমেলা ২০১৪: টুকটাক অভিজ্ঞতার খসড়া-২
নয়. বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষার্থীজীবন সমাপ্তির পর প্রতিদিনের বইমেলায় কারণে-আকারণে ঘুরঘুর করে ক্লান্ত হয়ে পড়ার ব্যক্তিগত রেওয়াজটা একেবারেই পাল্টেগেছে। সে অনেকদিন আগে। বইমেলায় এ অনিয়মিত উপস্থিতির অন্যতম কারণ কর্মকাবিননামার দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান কঠিন শাসন। তার সাথে অতিনগরায়নের ফল-ট্রাফিকজ্যামবন্দী এ নাগরিক শহর। এ নগরজীবনে বিকেল পাঁচটা নাগাদ চুক্তিভিত্তিক শ্রমঢেলে, গুলশান থেকে বাংলা একাডেমি চত্বর কিংবা এবারের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান-এ পৌছানো, তাও আবার মেলার সরকারি বাতি বন্ধকরে দেয়ার শেষসীমা- রাত আটটা-সাড়ে আটটার আগেই, মোটাদাগে অসম্ভব। অতএব শুক্র-শনি- এ দু’দিনই ভরসা। কিন্তু মাঝেমাঝে সে সম্ভাবনাও বেহাত হয়ে যায় দুর্লঙ্ঘনীয় সংসারী-জীবনের দাপুটে কর্তব্যে। ব্যতিক্রম ছিল গতবছর। সংসারকাবিন আর কর্মকাবিন, কোনটাই আটকাতে পারে নি। বরং সংসার জীবনের নিত্যপ্রতিপক্ষ-কন্যা-স্ত্রী মিলে ঘুরঘুর করেছি। প্রায় প্রতিদিন। তবে বইমেলায় নয়; শাহবাগ-এ। পরিবার-পরিজন, বন্ধু-সহপাঠি মিলে এক নতুন বাংলাদেশকে পর্যবেক্ষণ করেছি। আর সেকারণে গত বছর, মেলার খুব কাছে থেকেও মেলায় যাওয়া হয়নি বললেই চলে।
এসব বিবেচনায় এবারের বইমেলা আমার জন্য খুবই ব্যতিক্রম। প্রথম সাতদিনের মধ্যে পাঁচদিনই আমি বইমেলায়। একদম স্বশরিরে। এ রীতিমত অবিশ্বাস্য। বইদেখা, মানুষদেখা, বইকেনা, আড্ডাদেয়া, সবই চলছে। এ অভুতপূর্ব সুযোগটাও আবার কর্মসূত্রীয়। বিচারব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট একটি গবেষণা কাজের সাথে যতসামান্য যুক্ত থাকার সুবাদে প্রায় প্রতিদিনই যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে আমার এখন নিয়মিত উঠাবসা করতে হচ্ছে, তথ্যপ্রাপ্তির প্রত্যাশায় অনুনয়-বিনয়, দেনদরবার করছি, তার প্রায় সবগুলোই মেলার কাছাকাছি। অতএব কাজ শেষে সোজা মেলার দিকে ছুটে চলা। শুধু নিজে একা নই; সাথে যে সহকর্মী থাকেন, তাকেও ফুসলিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। তার পকেটও খালি হচ্ছে। তার জন্যও- বই কিনে দেওলিয়া না হওয়ার- সম্ভাবনা তৈরিতে অবদান রাখছি। অনুভূতিটা মন্দ না। আগেও বলেছি, বইমেলা শুধু বইয়ের মেলা নয়; আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সামাজিকায়নের মেলা। অনেক দিন ধরে না দেখা বন্ধু-আপনজনের সহসা দেখা হওয়ার মেলা। আজ সেরকমই হুট করে দেখা হয়ে গেল মোহন এর। কর্মসূত্রে এক সময় সে আমার রুমমেট ছিল। আমরা একসাথে কাজ করেছি, অনেক দিন। সেসময় সহকর্মী-বন্ধু মোহন এর সাথে উন্নয়ন, রাজনীতি বিবিধ বিষয়ে বিস্তর আলাপ হত। তর্ক হত। তারপর একসময় সে চাকরিটা ছেড়ে দেয়; একসময় আমিও। নিয়মিত যোগাযোগ থেকে দীর্ঘ-বিরতির যোগাযোগ, এক সময় যোগাযোগটা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে কেবল ফেইসবুকেই। আজ বইমেলার সুবাদেই আবার মোহন এর সাথে দেখা, অনেক অনেক দিন পর। আমরা কিছুক্ষণের জন্য হলেও ফিরে পাই সে পুরনো দিনগুলোকে। বইমেলার সুবাদেই। মনের অজান্তেই একটা বাড়তি কৃতজ্ঞতা তৈরি হয় বইমেলার প্রতি। বইমেলা যে সামাজিক মেলবন্ধনের একটি কার্যকর পাটাতনও বটে, সেটা আরো একবার প্রমাণিত হল।
দশ.
মূলমেলা এবার একাডেমি চত্বরের বাইরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রথম দু’দিন ঘুরে এসে বেশ কিছু ভাললাগার কথা বলেছিলাম। সাথে দু’একটি সীমাবদ্ধতার কথাও। পঞ্চম দিন গিয়ে ভাললাগলো এ জন্য যে, আগের চোখেপড়া সীমাবদ্ধতাগুলো ইতোমধ্যে কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। যেমন, প্রথম দু’দিন বেশির ভাগ স্টল-এ নম্বর ছিল না; নম্বরগুলো লাগতে শুরু করেছে। মেলার প্রবেশ পথেই স্টলগুলোর নম্বর-নামসহ একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। তবে এ বোর্ডটি আরেকটু বড় হলে আরও দৃশ্যমান হতো। তাতে মেলায় আগত দর্শকদের সুবিধা হতো। তবে এবার মেলার এখন পর্যন্ত বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, অন্তত আমার চোখে, মেলাকে দু’ভাগে ভাগ করে ফেলা। কর্তৃপক্ষ নিশ্চই বিস্তৃত পরিসর এর কথা ভেবেই দ্বি-খন্ডনের কাজটি করেছেন। এবং এটা সত্যযে, তাতে বেশি জায়গা পাওয়াও গেছে। কিন্তু বিস্তৃত পরিসরের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আগত দর্শকদের জন্য প্রতিটি স্টল স্বচ্ছন্দে ঘুরে দেখার সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে দেয়া এবং তা জারি রাখা। মেলা দ্বিখন্ডিত হয়ে পড়ায় সেটা কিছুটা হলেও বিঘ্নিত হয়েছে। এ- পাশ শেষ করে ও-পাশে যাওয়া, অথবা ও-পাশ শেষ করে এ-পাশে আসাটা অনেকের জন্যেই হয়ে উঠছে না। আবার যারা খোজখবর না নিয়ে, হুট করে মেলায় হাজির হচ্ছেন, তাদের কিছুটা দ্বিধান্বিত হতে দেখেছি, ঠিক কোন ভাগ থেকে শুরু করবেন, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে। এবং সিদ্ধান্তটা তারা নিজনিজ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিতে পারছেন বলেও মনে হয়নি। আমরা মনে হয় লিটলম্যাগ চত্বরসহ পুরো মেলাটিকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ধারণ করা যেত। মেলার ভেতরে হাটার রাস্তা আরো প্রশস্ত রাখা যেত। আগামীতে নিশ্চই আয়োজকবর্গ বিষয়গুলো নিয়ে আন্তরিকভাবে ভাববেন। বিবেচনা করবেন। সে প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। তবে ছোটখাট অনুযোগগুলো বাদদিলে, আমি বলবো, এবার মেলার পরিসর নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমি বেশ খুশি। এবারের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলা একাডেমি নিশ্চই আমাদের খুশীর মাত্রা বাড়িয়ে দিতে সক্রিয় হবে। আগামী বছর। আগামী দিনগুলোতে। এ মেলাকে ঘিরে অনেক অনেক স্বপ্নের সাথে আমরা এ স্বপ্নটাও দেখে যেতে চাই।
তৃতীয় কিস্তিতে আমার পকেট খালি করে দেয়ার জন্য যেসব লেখককে দায়ি করা যায়, তাদের নাম, বই সহ একটি তালিকা দিয়ে রাখি।
১. তনুজা ভট্রাচার্য্য: ধ্যানে ও যাপনে (কবিতার বই), অ্যাডর্ন পাবলিকেশন
২. জাহানার ইমাম- মূলধারায় চলেছি: গণআদালতের দিনলিপি, গদ্যপদ্য/চারুলিপি প্রকাশন
৩. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী- রাষ্ট্র ও সমাজের মাঝখানে (প্রবন্ধ সংকলন), পার্ল পাবলিকেন্স
৪. অজয় দাশগুপ্ত- একাত্তুরের ৭১ (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা), আগামী প্রকাশনী
৫. রাশিদা আখতার খানম- নারীবাদ ও দার্শনিক প্রেক্ষাপট, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ
৬. এস খলিলুল্লাহ- জানা ও শেখার কথা (বিজ্ঞানের বই, কন্যার জন্য বন্ধু মোহন উপহার দিয়েছে), সাহিত্য প্রকাশ
৭. মৌলি আজাদ- হুমায়ুন আজাদ-আমার বাবা, আগামী প্রকাশনী
২ আর তিন নাম্বার বইটা আমিও কেনার আশায় আছি!
লেখা ভালো লাগলো ভাইয়া, আরো মেলায় যান ও আরো সময় পান লেখার!
বই দু’টি কিনে পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখে ফেলুন। পড়ার আগ্রহ থাকলো।
পোস্টগুলো পড়ছেন দেখে অনুপ্রাণিত।
শুভেচ্ছা।
মেলায় না গিয়েও অনেক কিছু জানলাম। অনবদ্য লেখার জন্য ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ পড়বার জন্য এবং মন্তব্যের জন্য।
ধন্যবাদ আপা
ভাল থাকবেন
সুন্দর লেখার জন্যবাদ ।
আমার ব্লগ এ স্বাগতম
আপনাকে ও ধন্যবাদ
মন্তব্য করুন