‘বৈকুণ্ঠের উইল’-‘র শতবছর পূর্তির আগে একটি পাঠপ্রতিক্রিয়া
আর মাত্র দু’বছর পরেই ‘বৈকুন্ঠের উইল’ শতবর্ষী হবে। বলা বাহুল্য, এটা শরৎচন্দ্রের লেখা উপন্যাস। প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৬ সালে। একটি উপন্যাস, একটি লেখা, শতবছর ধরে টিকে আছে, একটি জাতির সাহিত্যের, ভাষার ইতিহাসে। বইটি এখনও প্রকাশকরা প্রকাশ করে, ক্রেতারা কিনে, পাঠকরা পড়ে, এবং ধারণা করা যায়, আরও অনেক অনেক দিন ধরে, নতুন নতুন পাঠকরা পড়তে থাকবে। উপন্যাসটি। উপন্যাসের চরিত্রগুলি নিয়ে ভাববে, যেমন এ মুহূর্তে আমি ভাবছি। উপন্যাসের চরিত্ররা বেঁচে আছে, বেঁচে থাকবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। একজন লেখক এবং তাঁর উপন্যাসের স্বার্থকতা বিচার্যের আর কি অন্যকোন সূচকের দরকার পড়ে? সম্ভবত না। সাহিত্যের শৈল্পিক ব্যাকরণ নিয়ে যারা ভাবেন, সমালোচনা সাহিত্য যাঁদের বিচরণক্ষেত্র, তাঁদের জন্য বিষয়টি হয়তো আলাদা। একটি উপন্যাস শতবছর টিকে আছে। এ-টিকে থাকার ঘটনা-ই একটা বিশাল বিশ্ময়। অন্তত আমার মতো যারা সাহিত্যের নগন্যপাঠক, তাঁদের কাছে।
‘বৎসর পাঁচ-ছয় পূর্বে বাবুগঞ্জের বৈকুণ্ঠ মজুমদারের মুদির দোকান যখন অনেক প্রকার ঝড়ঝাপটা সহ্য করিয়াও টিকিয়া গেল, তখন অনেকেই বিশ্ময় প্রকাশ করিল’।
লেখক যেমন এ-রকম গণবিশ্ময়ের বর্ণনা দিয়ে উপন্যাসটি শুরু করেছেন ঠিক আমি নিজেও উপন্যাসটি একশ’ বছর টিকে থাকার ঘটনায় একটা বিশ্ময় নিয়েই পড়তে শুরু করি। উপন্যাসিক হিসেবে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধানব্যক্তিত্ব শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর শক্তি আঁচ করার চেষ্টা করি। এবং মনে মনে এ-রকম একটা অনুসিদ্ধান্ত টানতে বাধ্য হই যে, একজন লেখক, তাঁর সৃষ্টি-শতবছর ধরে টিকে আছে, এটাই তাঁর বড় শক্তি। সাহিত্যের শৈল্পিক ব্যাকরণের বিবেচনা পরে।
বলতে দ্বিধা নেই, ‘বৈকুণ্ঠের উইল’ আহামরি কোন উপন্যাস নয়। অন্তত কাহিনীর দিক থেকে। খুবই সাদামাটা গল্প। প্রায় একশ’ বছর আগের গ্রাম-বাংলার আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় লেখা। কিন্তু গল্পটা এ-যুগেও অপরিচিত নয়। একটি দরিদ্র পরিবারের অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, ক্ষুদেব্যবসার বদৌলতে আর্থনীতিক-সামাজিক উত্তরণ, পরিবারের পুঞ্জিভূত সম্পদ এর মালিকানা, ভাগাভাগি নিয়ে সৎমা, ভাইদের মধ্যে সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্ধ, নানা কুটচাল, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল, এবং শেষপর্যন্ত যাবতীয় দ্বন্ধের অবসান-উত্তর দু’ভাইয়ের মিলন। মোটাদাগে এটাই কাহিনী। স্পষ্টতই উপন্যাসটি বিয়োগান্তক নয়; মিলনাত্বক। মূলধারার বাংলা চলচ্চিত্র দেখার অভ্যাস যাদের আছে, তারা নিশ্চয় এ-রকম বা কাছাকাছি কাহিনীর অসংখ্য ছবি উপভোগ করেছেন। কিন্তু এ সাদামাটা কাহিনীর সাথে পরিচিত হতে হতে পাঠক পরিচিত হবেন সেকালের গ্রামীণ দারিদ্র্য, প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধ, নারী-পুরুষ সম্পর্ক, এ-বিষয়গুলির সাথে।
উপন্যাসটিতে আমরা বৈকুণ্ঠের লেখাপড়ার বিষয়ে কিছু জানতে পারি না। কিন্তু এটা জেনে যাই যে, বৈকুণ্ঠ দরিদ্র, সৎ এবং পরিশ্রমী। সে তার সততা, নিষ্ঠা এবং পরিশ্রম দিয়ে দারিদ্র্যকে জয় করে। তার দোকানটি শুধু পরিবারের টিকে থাকার অবলম্বন হয়ে উঠে না, এটি বৈকুণ্ঠের পরিবারের সামাজিক মর্যাদাও তৈরি করে। অর্থনৈতিক সক্ষমতা আনে। ফলে বৈকুণ্ঠের পক্ষে তার মেধাবী ছোট ছেলেটিকে কলকাতায় উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো সম্ভব হয়। সমাজতাত্ত্বিকদিক থেকে এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো গ্রাম ও শহরের মধ্যে সুযোগ-সুবিধাগত বঞ্চনার দিকটি। টাকা থাকলেও গ্রামে উচ্চশিক্ষার সুযোগ নেই। তার জন্য শহরে যাওয়ার দরকার পড়ে। এ-শহর পক্ষপাত সেকালে যেমন সত্য ছিল, আজও সেটি সত্য। সেকালে গ্রামগুলো যেমন প্রান্তিক ছিল, আজও প্রান্তিকই রয়ে গেছে। পার্থক্যটা হয়তো মাত্রাগত।
বৈকুণ্ঠের ছোট ছেলে বিনোদ। এ চরিত্রটির মধ্যদিয়ে আমরা এও জেনে যাই যে, উচ্চশিক্ষা ব্যক্তির সামাজিক গতিশীলতা তৈরি করে। স্বাধীনতাও দেয়। এ গতিশীলতা ও স্বাধীনতা ব্যক্তির মধ্যে আবার সামাজিক বিচ্যুতিও তৈরি করে। এ ধারণা শরৎচন্দ্রের কালেও প্রচলিত ছিল। আমরা দেখতে পাই, বৈকুণ্ঠের মেধাবী ছেলে বিনোদ কলকাতায় পড়তে যায়। কিন্তু সে শুধু পড়ালেখা করে না। নিষিদ্ধ পল্লীতেও যায়। মদ খায়। তাকে নিয়ে এ ধরনের গল্প-আলাপ পরিবারে, সমাজের মানুষজনদের মধ্যে চলে। গ্রাম ও পরিবারের সদস্য, এমনকি খোদ তার মায়ের মধ্যেও একটি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়। আর পাঠক হিসেবে আমরা সেকালের নাগরিক উপ-সংস্কৃতির একটা পরিচয়ও পেয়ে যাই।
আবার সম্পদ শুধু সামাজিক-অর্থনৈতিক গতিশীলতা ও মর্যাদা তৈরি করে না। সম্পদ ব্যক্তির মধ্যে একটা মনোজগতও তৈরি করে। সে মনোজগতটা সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বান্ধিক হয়ে ওঠে। সম্পদপ্রাপ্তি বা দখলে রাখার লোভ ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং বিচ্ছিন্নতাবোধেরও জন্ম দেয়। উপন্যাসের কাহিনী বিন্যাসে আমরা বৈকুণ্ঠের বড়ছেলে গোকুলের মধ্যে এ-রকম একটি মনস্তত্ত্ব তৈরি হতে দেখি। যেটি তৈরিতে আবার তার স্ত্রী, শশুর পরিবার এবং সুযোগসন্ধানী প্রতিবেশিরা ভূমিকা রাখে। এ সময় গোকুল তার মা, এবং ভাইয়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সম্পদকেন্দ্রিক পারিবারিক দ্বন্ধ ও পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা গ্রামবাংলার আর্থ-সামাজিক জীবনের একটি চিরায়ত অনুষঙ্গ। শরৎচন্দ্র সে চিরায়ত অনুষঙ্গটা চিত্রিত করেছেন খুব সুচারুভাবে।
এখন একটু দেখা যাক ‘বৈকুণ্ঠের উইল’-এর নারীরা কেমন? এক কথায় সবাই প্রচন্ড দুর্বল। ক্ষমতার দিক থেকে, সিদ্ধান্তগ্রহণের দিক থেকে। সামাজিক গতিশীলতার দিক থেকেও। কারণ সেকালের নারীদের সবল হওয়ার মতো আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা ছিল না। উপন্যাসটির প্রধান নারী চরিত্র বৈকুণ্ঠের স্ত্রী। সামাজিক প্রত্যাশা হচ্ছে নারী হবে স্নেহশীলা, মমতাময়ী। বৈকুণ্ঠের স্ত্রীও তাই। আবার নারী শুধু স্নেহশীলা হয় না, কুটনামীতেও সিদ্ধহস্ত-এটাও নারী সম্পর্কে প্রচলিত একটি সামাজিক প্রতিরূপ। বৈকুণ্ঠের উইল-এ আমরা নারীর এ সামাজিক প্রতিরূপেরও দেখা পাই। শরৎ চন্দ্রের কল্যানে। উপন্যাসে পুরুষ চরিত্রের বিপরীতে নারীদের অল্পবিস্তর যে ক্ষমতা চর্চা দেখতে পাই, সেটি তাদের নিজস্ব ক্ষমতা নয়; পুরুষচরিত্রের সাথে সম্পর্কিত। যাকে বলা যায় স্যাটেলাইট ক্ষমতা সম্পর্ক, যেখানে নারীরা নিজের আলোয় নয়, অন্যের আলোয় মানে পুরুষ চরিত্রদ্বারা তারা ক্ষমতায়িত। কিন্তু সেটি সাময়িক। প্রকৃত অর্থে তারা সবাই ক্ষমতাহীন। অর্থাৎ নারীর প্রতিষ্ঠিত সামাজিক প্রতিরূপই পুননির্মিত হয়েছে উপন্যাসটিতে। তবে একটা বিনির্মাণের প্রচেষ্টাও চোখে পড়ে। সেটি গতানুগতিক পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাকাঠামোর ভেতরে থেকেই। বৈকুণ্ঠের স্ত্রী গোকুলের সৎ মা। আর সৎ মা সম্পর্কে প্রচলিত সামাজিক ধারণা হচ্ছে তারা অন্যপক্ষের সন্তানের প্রতি সদয় আচরণ করেন না। বরং নিপীড়ন-নির্যাতনের নানা প্রকরণ প্রয়োগ করেন অথবা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা বৈকুণ্ঠের স্ত্রীকে ব্যতিক্রম হিসেবে দেখতে পাই। তবে ব্যতিক্রম উপস্থাপন নারীর প্রচলিত সামাজিক ইমেজকে ভাঙ্গে না। শরৎচন্দ্রের নারীরা স্নেহশীলা-মমতাময়ী প্রতিরূপের ভেতরেই আটকে থাকে।
দ্বন্ধ সামাজিক জীবনেরই অনুষঙ্গ। তবু সামাজিক মানুষ দ্বন্ধটাকে নয়; দ্বন্ধের অবসানই প্রাধান্য দেয়। ধারণা করা যায়, শরৎ চন্দ্রের সময়ে গল্প-উপন্যাসে পাঠক পারিবারিক দ্বন্ধে বিয়োগান্তক নয়, শেষ পর্যন্ত মিলনাত্বক পরিণতিই কামনা করতেন। ‘বৈকুণ্ঠের উইল’-এ বৈকুণ্ঠের দু’ ছেলে গোকুল আর বিনোদ এর মধ্যে আমরা শেষপর্যন্ত মিলনই প্রত্যক্ষ করি।
উপন্যাসটির শতবছর পূর্তির প্রাক্কালে বাংলাসাহিত্যের এ মহান সৃষ্টিশীল মানুষটির প্রতি, শরৎচন্দ্রের প্রতি বিনীত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
ক্লাস নাইনে পড়ে ছিলাম। সেই পড়ার স্মৃতি মনে পড়লো এই রিভিউ পড়ে। আপনার লেখা পড়তে সব সময়ই ভালো লাগে!
আপনাকে পাঠক হিসেবে পেয়ে সবসময় অনুপ্রাণিত হই। বলাবাহুল, আপনার লেখাও পড়ি। মনোযোগের সাথে। উপভোগও করি।
শুভেচ্ছা।
এই বইটা পড়েছিলাম কিন্তু কাহিনী ভুলে গিয়েছি। আপনার লেখা পড়ে আবার মনে পড়লো। থ্যাঙ্ক ইউ।
ধন্যবাদ পড়ে মন্তব্য করার জন্য।
শুভেচ্ছা। ভাল থাকবেন।
শরৎচন্দ্র , রবি, বনকিম সবার উপন্যাসে মেয়েদের সুনদরী, কেশবতী আর রাননায় পারদরশী, পতিজনে ভকতি হওয়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই। অবশ্য যা দেখেছেন তাই লিখেছেন হয়তো
লেখকের দায়িত্বতো শুধু বর্তমানকে দেখা নয়। তার বিনির্মমিাণও। ভবিষ্যতের জন্য। সে জায়গাটা যখন জেন্ডার পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখি, নারী-পুরুষের সামাজিক, রাজনৈতিক সম্পর্ককাঠামোর দিক থেকে, তখন ওপরের সবার প্রতি অভিযোগ তোলার একটা শক্ত জায়গা আমি দেখতে পাই। তাঁরা তাঁদের কালের এবং বর্তমানকালেরও ‘অগ্রসরচিন্তার’ মানুষ হওয়া সত্বেও, তাদের সে প্রগতিশীলতায় নারী-পুরুষের কাঠামোগত সম্পর্কের সমতার উপাদানগুলো গুরুত্ব পায়নি। বরং পুরুষতন্ত্র নির্মিত নারীর প্রতিরূপগুলোই নির্মিত ও পুননির্মিত হয়েছে।
আমাদের মেয়ে তো রবীন্দ্রনা্থের ‘বীরপুরুষ’ কবিতা প্রথম পড়েই প্রথমদিন প্রশ্ন তুলেছিল-রবীন্দ্রনাথ কি কোন বীরনারী দেখে নি, যে তার মাকে নিয়ে একই ভাবনা ভাবতে পারে!
..................................................
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা। ভাল থাকবেন।
মন্তব্য করুন