একজন অভিজিৎ, হুমায়ুন আজাদ অথবা লালসবুজের বাংলাদেশ
এক. দুর্বৃত্তরা হুমায়ুন আজাদের ওপর আক্রমন করেছিল ২৭ ফেব্রুয়ারি। অভিজিৎ রায় এর ওপর ২৬ ফেব্রুয়ারি। তারিখের হিসেবে হুমায়ুন আজাদের একদিন আগে। আর সময়ের ব্যাপ্তির হিসেবে অভিজিৎ এর ওপর হুমায়ুন আজাদের এগার বছর পর। বাকি দৃশ্যপট এক-অভিন্ন। হুমায়ুন আজাদও সেদিন ফিরছিলেন তাঁর প্রিয় বইমেলা থেকে। পায়ে হেটে। তাঁর প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়-প্রাঙ্গন হয়ে আপন গৃহে, পরিবারের কাছে। অভিজিৎও ফিরছিলেন সে একই বইমেলা থেকে। প্রিয় জীবনসঙ্গীকে নিয়ে। প্রথমজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। দ্বিতীয়জন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক না হলেও বাবা-শিক্ষাবিদ অজয় রায়ের চাকরির সুবাদে বড় হয়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনেই। এ প্রাঙ্গনের আলো-বাতাস-ধুলিকণা গায়ে মেখেই। এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন দু’জনেরই প্রিয় ছিল- এটা সংশয়হীনভাবেই বলা যায়। যে প্রাঙ্গনে দীর্ঘজীবন কেটেছে দু’জনের সে প্রিয় প্রাঙ্গনকে বিবেচনাযোগ্য-অনিরাপদ ভাবারও হয়তো কোন কারণ ছিল না। সে অভয়েই হয়তো দু’জনেই ফিরছিলেন নিশ্চিন্ত হয়ে। আর আক্রান্তও হলেন প্রায় কাছাকাছি জায়গায়। ঠিক একই রকমভাবে। আক্রমণ করলো পেছন থেকে। মাথায়। যাতে মৃত্যুটা নিশ্চিত হয়। হুমায়ুন আজাদ নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরেও এসেছিলেন। অল্প কয়েকদিনের জন্য। এসে লিখেছিলেন 'আমার নতুন জন্ম' বইটি। কিন্তু তাঁর নতুনজন্মটা দীর্ঘ জীবন পেতে পারে নি। আর অভিজিৎ রায় আক্রান্ত হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আক্রমনের ধরন, সময়, ব্যবহৃত হাতিয়ার এতখানি সাদৃশ্যপূর্ণ যে, হামলাকারী খুনীরা একই গোত্রের, একই দলের, একই মতাদর্শের, একই রকম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত- এ রকম সিদ্ধান্ত টানার জন্য অপরাধবিজ্ঞানী হওয়ার দরকার পড়ে না। হুমায়ুন আজাদ থেকে অভিজিৎ রায়, মাঝখানে এগার বছর। দিনের হিসেবে চারহাজার পনের দিন। ঘন্টা-মিনিট- সেকেন্ডের হিসেবে গাণিতিক সংখ্যাটা আরও বড় হবে। বিবর্তনের নিয়মে এ দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজ এগিয়ে যাবার কথা। কিন্তু কতখানি এগুলো ’বুদ্ধির মুক্তি ও মুক্তির বুদ্ধি’র জন্য, অথবা ¯্রফে বিরুদ্ধমতের প্রতি গ্রহিষ্ণু না হোক, অন্তত সহিষ্ণু থাকার জন্য, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য, মতের বিপরীতে মত, লেখার বিপরীতে লেখা দিয়ে যুক্তি খন্ডাবার জন্য? অভিজিৎ রায়ের নির্মম হত্যাকান্ড সহ নিকট অতীতের ঘটনাপঞ্জি বলে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশ এগোয় নি, বরং ইতিহাসের বিপ্রতীপ পথেই হাটছে। যে পথের শেষসীমায় দাঁড়িয়ে আছে এক সীমাহীন অন্ধকার।
দুই.
অভিজিৎ রায়কে আমি কখনো চোখে দেখি নি। তাঁকে খুববেশি চিনতাম অন্তর্জালে-ব্লগ পরিসরে, সেকথাও বলা যায় না। যতটুকু মনে পড়ে, তাঁর দু’একটি বই উল্টেপাল্টে দেখেছি, গত ও এবারের বইমেলায়, কিন্তু ঠিক পড়া অর্থে পড়া হয় নি। যদিও মুক্তমনা ব্লগটির নাম জানা ছিল, কিন্তু এ ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অভিজিৎ- সেটাও ছিল অজানা। এ না জানাটা ছিল হয়তো নিতান্তই কাকতালীয়, অথবা অন্তর্জাল-ব্লগপরিসরে আমার অনিয়মিত উপস্থিতিই তার কারণ। সজিব-জীবন্ত মানুষটির সাথে দেখা হল না। দেখা হবেও না আর কোন দিন। কিন্তু দেখা হলো মানুষটির রক্তের সাথে। বইমেলার শেষদিন শনিবার সকালে শাহবাগ হয়ে বইমেলার দিকে যাবার পথে থেমে যেতে হল রাজু ভাস্কর্যের কিছুটা আগে। অদূরে পড়ে আছে পুলিশের ক্রাইমসিন লেখা হলুদ রঙের ফিতা। সেঁতসেঁতে একটা জায়গা। রক্তের হালকা দাগ তখনও চোখে পড়ার মতো। কয়েকটা মাছি হালকা লেগে থাকা রক্তের ওপর ওড়াওড়ি করছে। তারপাশে পড়ে আছে কয়েকটি হলুদ গাদা ফুল। আশপাশের বাকী সবকিছুই স্বাভাবিক; প্রতিদিনকার মতো নাগরিক সচলতায় অগ্রসরমান। দোকানিরা রোজকার মতো কেনাবেচায় ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। পথচারিরা পাশ দিয়েই হেটে যাচ্ছে। যেন কিছুই হয়নি এখানে। যে মানুষটি বৃহস্পতিবার রাতেও বইমেলায় প্রানবন্ত ছিল, পাঠকদের অটোগ্রাফ দিয়েছেন, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়েছেন সে মানুষটির প্রায় মুছে যাওয়া রক্তের ওপর ওড়াওড়ি করছে মাছি। মানুষটির লাশ পড়ে আছে হিমঘরে। আর তাঁর খুনীরা এখনও অদৃশ্য-অধরা। এর চেয়ে অসভ্য-অশ্লীল দৃশ্য আর কী হতে পারে আমার জানা নেই।
তিন.
অভিজিৎ থাকতেন আমেরিকায়। বাংলাদেশে না এলে কী হতো তাঁর? কিছুই না। বরং বেঁচে যেতেন প্রাণে। লিখতে পারতেন আরও অনেক দিন। আড্ডায়, আলোচনায় সহচর্যে প্রানবন্ত করে তুলতে পারতেন বন্ধুদের, প্রিয়জনদের। তারপরও অভিজিত এসেছিলেন বাংলাদেশে। না এলে যে প্রাণটা পড়ে থাকতো। তার বেড়ে ওঠার প্রাঙ্গনে। প্রিয় স্বদেশে। একুশের বইমেলায়। আর সে প্রাণের টানেইতো দেশে আসা। বইমেলায় যাওয়া-আসা। যে মেলায় এতএত বইয়ের সমাহার, শতসহ¯্র মলাটের নিচে বৈচিত্রময় মত আর পথের সম্মীলন, যে মেলা হয়ে উঠেছে বাঙালি ও বাংলাদেশের সংস্কৃতির অনুষঙ্গে, যে মেলার জন্য বাঙালি অপেক্ষা করে সারাবছর, যে মেলায় যেতে পারা শিশুদের জন্য একটা টানটান উত্তেজনার বিষয়, যে মেলাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বই ও প্রকাশনার অর্থনীতি, যে মেলায় প্রতিদিন সমাগম ঘটে হাজার হাজার মানুষের, সে মেলা থেকে ফেরার পথে একজন লেখক অথবা একজন মানুষ খুন হয়ে যাবেন- এটা নিশ্চয় অভিজিৎ এর কাছে ছিল অকল্পনীয়। আর এ অকল্পনীয় নৃশংস ঘটনাটি যেখানে ঘটেছে সেটি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার অন্যতম ব্যস্ততম লোকালয়। তার ঠিক বিপরীত পাশে এ সময় ঘরমুখো যাত্রীদের জন্য অপেক্ষায় থাকে কমপক্ষে শ’খানিক সিএনজি, টেক্সিক্যাব, রিক্সা ইত্যাদি। ঘটনার খুব কাছে উদ্যানের ভেতর সারিসারি চা-দোকান। পুলিশ প্রহরা। ধারণা করি, ঘটনার সময় অভিজিৎ এর জীবনসঙ্গী বন্যা তার সর্বোচ্চ কন্ঠে চিৎকার করেছিলেন, সাহায্যের প্রত্যাশা করেছিলেন। অন্তর্জালে যে ছবিটি ছড়িয়ে পড়েছে, যে ছবিটি দেখে মানুষ হিসেবে লজ্জ্বায় আর বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে ভয়ে কুঁচকে যাবার মতো, সে ছবির ভাষা তাই বলে। কিন্তু কেউ সে ডাকে সাড়া দেয় নি। কেউ এল না সময় মতো। যখন এলো ততক্ষণে সব শেষ। কেন কেউ এগিয়ে এলো না? এ প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত লুকিয়ে আছে দেশে ক্রমাগত বিকাশমান ভয়ের সংস্কৃতির সাথে। অপরাজনীতি, সন্ত্রাস, দুর্ঘটনার সাথে আমাদের অভ্যস্থ হয়ে উঠার সাথে। এবারের বইমেলা থেকেই আলী রীয়াজের 'ভয়ের সংস্কৃতি: বাংলাদেশে আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের রাজনৈতিক অর্থনীতি' বইটি কিনেছিলাম। বইটি পড়া শুরু করেছি। শেষ না হতেই এ ঘটনাটি ঘটলো। আলী রীয়াজ বাংলাদেশের ভয়ের সংস্কৃতির যে উপাদান ও বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনায় নিয়ে এসেছেন, একবারও ভাবিনি, বইটি পড়া শেষ না হতেই বইয়ের ব্যাখ্যাগুলি এত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে অভিজিৎ রায় এর হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে। আমাদের সম্মিলিত ভয়ের চৌহদ্দি আরেকটু বেড়ে যাবে। আমরা আরো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠবো আমাদের যাপিতজীবনে। ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন এর শনিবারের সংখ্যায় লিখেছে, অভিজিৎ এর ওপর যখন হামলা চলছিল, অনেকেই মনে করেছে মারামারি হচ্ছে একটি সংগঠনের নিয়মিত সদস্যদের মধ্যে। এ জন্য কেউ প্রথমে এগিয়ে আসে নি। এ এগিয়ে না আসার কারণ কি রাজনৈতিক সন্ত্রাসের প্রতি আমাদের ভয়, অভ্যস্থতা, নাকি দুটিই? একবার এক আলাপচারিতায় এক আফ্রিকান নাগরিক আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা কীসে দেখতে পাও? আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশের মানুষ যেকোন দুর্যোগে, দু:সময়ে জানবাজি রেখে অপরের পাশে দাঁড়ায়। রাষ্ট্রের জন্য অপেক্ষা করে না; নিজেরাই এগিয়ে আসে, ঘুরে দাঁড়ায় আপন শক্তিতে। বলেছিলাম এটি আমাদের সবচেয়ে বড় সামাজিক পুঁজি। আলী রীয়াজ তার বইতে দেখিয়েছেন- একটা সমাজে যখন ভয়ের সংস্কৃতি প্রবল হয়ে উঠে, রাষ্ট্র ও সমাজ যখন প্রতিনিয়ত আতঙ্ক ছড়ায় তখন নাগরিকদের ঘুরে দাঁড়াবার সম্ভাবনা ক্ষীণ হতে থাকে। ভয়, আতঙ্ক আর বিচ্ছিন্নতার অন্যতম সাম্প্রতিক নিদর্শন হচ্ছে- টিএসসির মতো জনবহুল এলাকায় কারও সময়মতো এগিয়ে না আসা। এ রকম একটি ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সারা দেশের বিদ্যায়তনগুলো যেভাবে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার কথা সেটাও হয় নি। এ না হওয়াটাও আমাদের সামগ্রিক ভয়, আতঙ্ক আর বিচ্ছিন্নতাবোধের সাথে সম্পৃক্ত। বলতে দ্বিধা নেই, যেটা আলী রীয়াজও তার বইতে দেখিয়েছেন, এ ভয়, আতঙ্ক আর বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি করা হয়েছে রাজনৈতিকভাবে।
চার.
মনে রাখা দরকার জন্ম ও বিকাশের কারণেই বাংলাদেশ শুধু ভৌগলিক সীমারেখা সমৃদ্ধ একটি রাষ্ট্র নয়, বাংলাদেশ একই সাথে একটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চও। সে হিসেবে বিকাশের ধারায় বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজের আরো বেশি দায়িত্বশীল-মানবিক হয়ে উঠবার কথা। চিন্তার বৈচিত্রময়তাকে ধারণ করবার কথা। আমাদের চিত্তগুলো ভয়শূণ্য হওয়ার কথা। কিন্তু তার বদলে আমরা ক্রমশই সংকুচিত হয়ে পড়ছি। আমাদের শিশুরা সংকুচিত হয়ে পড়ছে। আমরা কি বলবো আর বলবো না, কি লিখতে পারবো আর পারবো না তার একটি ছাচ তৈরি করা হচ্ছে। সমাজ-রাষ্ট্র ও রাজনীতির কারণে প্রতিক্রিয়াশীলতার নিচে চাপা পড়ছে লালসবুজের বাংলাদেশ।
২০০৪ সালে ২৮ জুলাই দৈনিক জনকন্ঠে হুমায়ুন আজাদ একটি খোলাচিঠি লিখেছিলেন। দুই নেত্রী ও দেশবাসীর কাছে। হুমায়ুন আজাদের মতো সাহসী মানুষ নিজের ও পরিবারের বিপন্নতার কথা বলে সবিনয় অনুরোধ জানিয়ে বলেছিলেন, 'আপনারাই ঠিক করবেন বাংলাদেশ কি ঘাতকের চাপাতির নিচে থাকবে, বাংলাদেশের রক্তের বন্যায় কি ডুবে যাবে বাংলাদেশ এবং বিশ্ব শিউরে উঠবে বাংলাদেশ কে দেখে। সময় বেশি নেই, এখনই আপনাদের কর্তব্য স্থির করার জন্য আবেদন জানাই।' গত এগার বছরেও আমরা, আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র হুমায়ুন আজাদের সে বিনীত আবেদনকে যথার্থ অর্থে বিবেচনায় নিতে পারি নি। এ সমাজ, এ রাষ্ট্র তার কর্তব্য ঠিক করতে পারে নি। আর পারে নি বলেই 'বাংলাদেশে এখন চিন্তার সাহায্যে চিন্তাকে বাতিল করা’র বদলে খুন করার সংস্কৃতি প্রবল হয়ে উঠেছে। যেটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও এর বিকাশের ধারণার শতভাগ বিপরীত। আমরা কি এভাবে ডুবতেই থাকবো? খুন হতেই থাকবো? আমাদের মৃত্যু, খুন- এ সমাজ-রাষ্ট্রের কাছে কি কেবল একটি পরিসংখ্যান হয়ে থাকবে?
কিছু বলার নেই। শেষ হয়ে গেছে মানবতা
জঘনয় এক অবস্থা!
মন্তব্য করুন