মনখারাপের দিনলিপি
আমরা কেউ না কেউ খুন হয়ে যাচ্ছি। প্রতিদিন। যেন বা খুন হয়ে যাবার জন্যই আমরা জন্ম নিয়েছি। খুন হতে পারাই আমাদের যোগ্যতা। আমাদের অনতিক্রম্য নিয়তি! ‘অপরাধ বিচিত্রা’ ‘অপরাধ জগত’ ঘরানার অনুকরণে এখন চলতি দৈনিকগুলোর নামও পাল্টে দেয়া যায়। রাখা যায় নতুন নাম- দৈনিক খুনবার্তা, খুনবিচিত্রা, ইত্যাদি। খুনের বিভৎস সংবাদ আর স্বজনের গগণবিদারী আহাজারির ছবিতে ভোরের সংবাদপত্রের পাতা আর রাতের টেলিভিশন পর্দা দখল হয়ে থাকলেও নাগরিক হিসেবে আমাদের একটা মহিমান্বিত অনুভব নিয়েই থাকতে হয় এই ভেবে যে, আমাদের একটা রাষ্ট্র আছে। রাষ্ট্র নায়ক-নায়িকা আছেন। আমাদের রাজরাজড়া, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা আছেন। তাঁদের এজমালি অথবা আলাদা আলাদা ‘খাসকামরা’ আছে। সেইসব খাসকামরায় লাল-নীল-সাদা-হলুদ, আরো কত বৈচিত্রময়-বর্ণীল আয়োজন আছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে, এখানে-ওখানে নাগরিক করের টাকায় পোষ্য আমাদের জন্য জনপ্রিয় ‘শোষক-শাসক, প্রশাসক-নির্বাহী’ আছেন। এতসব ‘আছে’র মধ্যে কোনো কোনো দিন হঠাৎ হঠাৎ করেই শুধু ‘নাই’ হয়ে যাচ্ছে আমাদের কারো কারো প্রিয়জন। আর আমরা বাকীরা, - যারা এখনো হারিয়ে যাই নি, অথবা যাদের প্রিয়জন হারাই নি, হয়তো সম্ভাব্য তালিকায় আছি- তারা রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ অথবা অন্যকারো প্রেম-রোমান্টিকতার গান-কবিতা শুনতে শুনতেই উপভোগ করছি বৈচিত্রময় খুনের সংবাদ। কারণ সমাজ-রাষ্ট্র আমাদের ইতোমধ্যে ‘খাপখাইয়ে নেয়া’র ‘অভ্যস্থ হয়ে উঠা’র এক যাদুকরী যোগ্যতা দান করেছে। ইতিহাস ও বংশপরস্পরায় প্রাপ্ত আমাদের শাসককূলের পক্ষ থেকে নাগরিক করের বিপরীতে এর চেয়ে বড় উপহার আমাদের জন্য আর কী হতে পারে! তাছাড়া ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা নাগরিক মধ্যবিত্ত। আমাদের শুধু বিপ্লবী হলে চলে না। আমাদের শিখতে হয় আপোষকামিতার শিল্পায়ন। বেশিরভাগ সময় আমাদের থাকতে হয় বিপ্লবহীনতায়। আমরা কিছু না হয়েও আমাদের হতে হয় অনেক কিছু- প্রেমিক, কবি, সংসারী, ভীতু এবং স্বপ্নকাতর। আজীবন অপূরণীয় স্বপ্নকাতরতাই আমাদের ‘মরে মরে বেঁচে থাকা’ জীবনে ‘তেল-পানি-রসদ’ যোগায়। আর আমরা অসংখ্য-অস্বাভাবিক মৃত্যু আর খুনের ঘটনায়ও নিশ্চল থাকি, আমরা খাই, ঘুমাই, ডেট করি আর নির্দিষ্ট মেয়াদ অন্তর শিল্পপ্রসব করি। অপেক্ষা করি আগামী ভোরের। নতুন কোনো খুন বা মৃত্যু সংবাদের। যেন খুন-মৃত্যুই স্বাভাবিক, বেঁচে থাকা-ই দু:সংবাদ।
মন্তব্য করুন