স্যানেটারি ন্যাপকিনের হালের একটি বিজ্ঞাপন এবং বিজ্ঞাপনে মতাদর্শ নির্মাণ-বিনির্মাণের দায়
ক. অতিসম্প্রতি নারীর ঋতুস্রাবকালীন রক্তপ্রবাহ ব্যবস্থাপনা ও পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক একটি বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে। পুনপৌণিকভাবে। বেতার ও টেলিভিশন- এ দু মাধ্যমেই। শ্রেণীর প্রশ্নে সাধারণত স্যানেটারি ন্যাপকিন-এর বিজ্ঞাপনের প্রধান লক্ষিত জনগোষ্ঠী মধ্যবিত্ত এবং তার উপরতলার নারীরা। যার বেশির ভাগ আবার শহুরে। বিগত দু’দশকের শিল্পায়ন ও নগরায়নের প্রেক্ষিতে নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী নারীরাও এখন এর টার্গেটভোক্তা। কিন্তু আমি যে বিজ্ঞাপনটির কথা বলছি, কথিত বিজ্ঞাপনটির কেন্দ্রস্থিত ভোক্তা বা ব্যবহারকারী মূলত: কিশোরী মেয়েরা। যারা প্রধানত শহর-উপ-শহরের। যাদের আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া আছে। শ্রেণীর বিচারে যাদের অবস্থান তলানিতে নয়; অবশ্যই কমপক্ষে মধ্যবিত্ত স্তরে। জৈবিক বা শারিরীক বিকাশের ধাপে যারা সবেমাত্র প্রথম ঋতুস্রাবের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছে। অথবা খুব শীঘ্রই একই অভিজ্ঞতা দিয়ে যাবে, এমন সম্ভাবনা রয়েছে। তবে কথিত এ বিজ্ঞাপনের লক্ষিত জনগোষ্ঠী অপরাপর স্যানেটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপনের মতো প্রধানত নারী হলেও, খুব সুনির্দিষ্টভাবে কিশোরীরা হলেও, এ বিজ্ঞাপনের ভোক্তা হিসেবে পুরুষকেও প্রত্যাশা করা হয়েছে। একই সাথে পণ্যটির ক্রেতা হিসেবেও। যদিও পণ্যটির চুড়ান্ত ভোক্তা পুরুষ নয়; নারীই। তবে সকল পুরুষ নয়: শুধু বাবারা, আবার সব বাবা নয়, যিনি বা যারা মা-হারা কন্যার বাবা। মূলত: এ বিজ্ঞাপনের মূলআধেয় আমাকে এ-একটি ভিন্ন কারণে আকৃষ্ট করেছে। সে বিশেষ আকর্ষণ থেকে উৎসারিত কিছু ভাবনা বলা যায় গত কিছুদিন যাবত নিজস্ব চিন্তাপরিসরে রীতিমত কিলবিল করছে। তারই ফলাফল হিসেবেই এ লেখায় হাত দেয়া। ফলে অনুমান করি, আমার মতো হয়তো অনেকেরই বিজ্ঞাপনটি চোখে পড়েছে। তাদের ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক যাই হোক না কেন। তবে বিজ্ঞাপনটি সম্পর্কে মূলকথায় যাবার আগে বিজ্ঞাপনের রাজনীতি ও এর সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্ব নিয়ে ভূমিকা হিসেবে কিছু কথা বলে রাখা দরকার বলে মনে করছি। তারপর বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে এ বিজ্ঞাপনটি নারীর ঋতুস্রাববব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত মতাদর্শ, বিশেষ করে মূল্যবোধ, আচারণ ও দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ-বিনির্মাণের একটি সূচনা হিসেবে বিবেচনা করা যায় কিনা-সেটি দেখার চেষ্টা করবো। তবে মূল আলোচনায় যাবার আগে আরও একটি কফিয়ত দিয়ে রাখা একটি দায়িত্ব বলে মনে করছি। সেটি হচ্ছে, আমি কোন বিজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞ নই। আমি গণমাধ্যমের শিক্ষার্থীও নই। এর কারিগরি দিক আমার জানা থাকার কথা নয়। সুতরাং শৈল্পিক বা কারিগরি বিচারে বিজ্ঞাপনটি কতখানি মানসম্মত, উৎরেগেছে, তার বিচার-বিশ্লেষণের সাধ বা সাধ্যি- আমার কোনটাই নেই। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে বিজ্ঞাপনের আধেয়, ভাষা, শব্দ, বার্তা, এর চরিত্র আমাকে সবসময় টানে। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করি। আপাতত সে অপ্রয়োজনীয় অভ্যাসটাও এ লেখায় হাতদেয়ার একটি প্রণোদনা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
খ. আমাদের মতো সাধারণের চোখে বিজ্ঞাপন মূলত: উৎপাদিত পণ্যপ্রসারের একটি নিয়মিত উপায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের শিক্ষার্থীদের কাছেও প্রধানত তাই। কিন্তু উৎপাদিত পণ্যেপ্রসারের নিয়মিত মাধ্যম হিসেবে, কাংখিত ভোক্তার সাথে যোগাযোগের খাতিরে, বিজ্ঞাপনকে কিছু ভাষা, চিত্র (স্থির অথবা চলমান), কিছু চরিত্র, আরও প্রয়োজনীয় নানা জিনিষ, প্রতিকী, বেছে নিতে হয়। যাকে আমরা একটি বিজ্ঞাপনের আধেয় বলতে পারি। এ আধেয় নির্বাচন কখনই স্থান-কাল-সংস্কৃতি এমনকি রাজনীতি ও শ্রেণী নিরপেক্ষ নয়। বরং বিজ্ঞাপন সবসময় কোন না কোন নির্দিষ্ট স্থান-কাল, সংস্কৃতি এমনকি রাজনীতি ও শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে। শুধু করে না, ভীষণভাবে করে। হয় তাকে টার্গেট করে। না হয় সে বিশেষ কাল- গোষ্ঠী- শ্রেণীর রাজনৈতিক ও সংস্কৃতির উৎপাদন-পুনরোৎপাদনে সক্রিয় ভূমিকা রেখে। বিজ্ঞাপন অন্য অনেক কিছুর মতো জাতীয় আবেগগুলোকেও হরহামেশা তার পণ্যের প্রসারে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে। জাতীয় দিবস, জাতীয় সংস্কৃতি, এমনকি জাতি, রাষ্ট্র-ধর্মের মতো ধারণাও বিজ্ঞাপন মাঝেমাঝে পরিবেশন করে। কখনও কখনও হালাল-হারাম পণ্য জাতীয় ধারণা তুলে বিজ্ঞাপন সুক্ষ ধর্মানুভূতিও ব্যবহার করে। ফলে বিজ্ঞাপন শুধু পণ্যের প্রসারে ভূমিকা রাখে না। পণ্যের প্রসারের পাশাপাশি একটি নির্দিষ্ট সমাজের মূল্যবোধ, নৈতিক মানদন্ড, ন্যায্য-অন্যায্যতার ধারণা, সামগ্রিকভাবে সংস্কৃতির নির্মাণ-বিনির্মাণে নিরবিচ্ছিন্ন সক্রিয় ভূমিকা রাখে। অতএব, বিজ্ঞাপন শুধু পণ্যপ্রসারের একটি বাণিজ্যিক টুলস নয়, এটি একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানও। এবং ইতিহাসের পরস্পরায় এটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই বিকশিত হয়েছে। এটি একদিকে পণ্য-সংস্কৃতি তৈরি করে, যা ভোগবাদের টিকে থাকা ও উৎবৃত্তমূল্য তৈরির জন্য আবশ্যকীয় একটি শর্ত। আগেই বলেছি, বিজ্ঞাপনের প্রথম পরিচয় হচ্ছে, এটি একটি বাণিজ্যিক টুলস। সম্ভবত পণ্যপ্রসারের সবচেয় বেশি ব্যবহৃত স্বীকৃত উপায়। ইলেট্রনিক মিডিয়ার ক্ষেত্রে যে বিপ্লব ঘটেছে, বিশ্বায়িত অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থায়, বিগত কয়েক দশকজুড়ে, সে বাস্তবতায়তো বটে, এর আগেও বিজ্ঞাপন ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। কিন্তু যেটি ভুলে গেলে চলবে না, এবং সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের জন্য সবসময় আমলে রাখারমতো, তা হচ্ছে, বিজ্ঞাপন সবসময় হয় নতুন অর্থ তৈরি করে, অথবা পুরনো অর্থকে বলবান করে। বেগবান করে। বিজ্ঞাপনে নির্মিত অর্থগুলো বিদ্যমান সংস্কৃতির সাথে হরহামেশা মিথষ্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়, বোঝাপড়া করে, দরকার হলে বদলে দেয়, অথবা বদলে দেয়ার প্রাণপণচেষ্টা করে এবং বিজ্ঞাপন অবশ্যই সংস্কৃতির উপর বিপুল প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। এটি সংস্কৃতির একটি উপাদানও। সংস্কৃতির একটি উপাদান হিসেবে বিজ্ঞাপন নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ককাঠামো, জেন্ডার, বর্ণ, শ্রেণী, যৌনতা, সৌন্দর্য, বয়স সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠিত ধারণার যে ঘেরাটোপ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাকেই প্রতিনিধিত্ব করে। সেটিকেই পুননির্মাণ করে। শক্তিশালী করে। তবে কখনও সেটি ভেংগে নতুন নির্মাণের পথে যে এগোয় না- তা নয়; এটি তখনই করে, যখন বিজ্ঞাপনটির জন্য নতুনভোক্তা তৈরি করা জরুরি হয়ে পড়ে। ফলে একটি প্রবল পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে বিজ্ঞাপন প্রধানত পুরুষতন্ত্রেরই প্রতিনিধিত্ব করে। কাঠামোগতভাবে এটি খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর এ কারণে বিশ্বায়িত পুঁজিবাদের প্রান্তস্থ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের মতো সমাজে পণ্যের বিজ্ঞাপননির্মাণ-এর ভাষায় আমরা যেমন ঐতিহ্যবাহী পুরুষতন্ত্রের উপস্থিতি লক্ষ্য করি, আবার বিনির্মিত পুরুষতন্ত্রের উপস্থিতিও মাঝে মাঝে দেখা যায়। যেটিকে ভোগবাদী অথবা পুঁজিবাদী পুরুষতন্ত্র নামে ডাকা যায়। দু’টিই আবশ্যিকভাবে উপস্থিত হয় স্রেফ পণ্যেপ্রসারের স্বার্থে। সমাজবিজ্ঞানী এরভিং গফম্যান বিজ্ঞাপন সম্পর্কে বলতে গিয়ে ’কমার্শিয়াল রিয়েলিজম’ বা ‘বাণিজ্যিক বাস্তবতা’-র কথা বলেছেন। যেখানে পণ্যউৎপাদনকারী ও বিজ্ঞাপননির্মাতা দু’ পক্ষ মিলে তাদের বিজ্ঞাপনটি এমন উপায়ে ও ভাষায় তুলে ধরে, ভোক্তাকে বোঝাতে চায় যে, বিজ্ঞাপনে যা তুলে ধরা হচ্ছে সেটাই বাস্তব অথবা বাস্তব হওয়া উচিত। আপনি-আমি, আমরা যদি এ বাস্তবতা থেকে দুরে থাকি, তবে বাস্তবতার স্বার্থে আমাদের এ পণ্যটি ব্যবহার করা দরকার। যা আমাদের প্রত্যাশিত ও গ্রহণযোগ্য বাস্তবতায় উত্তরণে সাহায্য করবে। বিউটিবাণিজ্য সম্পর্কিত প্রায় সবকটি বিজ্ঞাপন শতভাগ এ ঘরানার। পরিসরের সীমাবদ্ধতার কারণে সে আলোচনায় এখানে যাওয়া সম্ভব নয়; হয়তো প্রাসঙ্গিকও নয়। তারপরও এটুকু বলে রাখা দরকার যে, একটি শিল্প হিসেবে বিজ্ঞাপনের ভাষা ও পরিবেশনের নৈতিকতা নিয়ে বিতর্ক আছে। বিতর্ক চলছে। আগামীতেও হয়তো এ বিতর্ক চলতে থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বিজ্ঞাপন হচ্ছে সমাজিকায়নের অন্যতম এজেন্ট, যা সামাজিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে নিরন্তর সক্রিয় ভূমিকা রাখে। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে এখন কথিত সেনেটারি ন্যাপকিন- সেনোরার বিজ্ঞাপনটির দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক।
গ.কী আছে বিজ্ঞাপনটিতে। খালি চোখে তাকালে তেমন কিছু না। খুবই সাধারণ একটি বিজ্ঞাপন। তারপরও বিজ্ঞাপনটি আমাকে আকৃষ্ট করেছে। এর নির্মাণশৈলীর জন্য নয়। সেটা আমার বোঝার কথাও নয়। যা আগেই বলেছি। বরং বিজ্ঞাপনটি আমার দৃষ্টিগোচর হওয়ার মূলকারণ বিজ্ঞাপনটির আধেয় বা কন্টেন্ট। আমি বিজ্ঞাপনটি নিয়ে অনেকের সাথে আলাপ করেছি। যখন আলাপ করেছি, বিশেষ করে নারীদের সাথে, তাদের কাছ থেকেও একই রকম অথবা আমার প্রতিক্রিয়ার কাছাকাছি মতামত পেয়েছি। তাঁরাও মনে করেন যে, বিজ্ঞাপনটি স্যানেটারি ন্যাপকিন সম্পর্কিত অন্য আট-দশটা বিজ্ঞাপন থেকে ভিন্ন। তবে আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে অন্যবিজ্ঞাপনগুলোর সাথে কথিত বিজ্ঞাপনটির মিল-অমিল দু’টিই আছে। এ মিল-অমিল দেখতে পাওয়ার কারণটাও বলা দরকার। অন্তত নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে। আগেই বলেছি, এটি নারীর, সুনির্দিষ্ট করে বললে, কিশোরী মেয়েদের ঋতুস্রাবকালীন রক্তপ্রবাহ ও পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থাপনার পণ্য- সেনোরার একটি বিজ্ঞাপন। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশ হচ্ছে একটি প্রবল পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধনির্ভর সমাজকাঠামো। এর প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলোও পুরুষতান্ত্রিক। ফলে ঐতিহাসিকভাবেই এখানে নারীর ঋতুস্রাব খুবই গোপনীয় বিষয়। নারীর জন্য -ভিতর-বাহির-আদলে যে কাঠামোটি এখানে জারি আছে, সাংস্কৃতিকভাবে, বহুদিন ধরে, সেখানে ঋতুস্রাব সামাজিক বিষয় হিসেবে বাইরের নয়; শতভাগ ভেতরের বিষয়। এটি অপ্রকাশ্য রাখা একটি কঠিন সামাজিক নিয়ম। এর গোপনীয়তা রক্ষা করা বহুলচর্চিত ঐতিহ্যবাহী আচরণ। হাল আমলের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত নারী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে, অথবা সাম্প্রতিককালে আনুষ্ঠানিক জীবিকার্জনের সাথে যুক্ত শহুরে মেয়েদের খুব ছোট একটি অংশের ক্ষেত্রে এ নিয়ম এর কিছুটা ব্যত্যয় মাঝেমাঝে ঘটলেও, আবারও বলতে হচ্ছে, আমাদের সমাজে ঋতুস্রাব এখন পর্যন্ত খুবই গোপনীয় বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একে গোপন রাখার মূল্যবোধটি শুধু প্রবল নয়; এ মূল্যবোধ এর উৎপাদন-পুনরোৎপাদনও বিজ্ঞাপনসহ নানা আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা উৎসাহিত এবং নিয়ন্ত্রিত। আর এর প্রধান কারণটি, ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার সাথে নারীর যৌনক্রিয়ায় অথবা সন্তানধারণে সক্ষম হয়ে উঠার বিদ্যমান সামাজিক ধারণার সাথে সহ-সম্পর্কিত। ঋতুস্রাবকেন্দ্রিক শুচি-অশুচি, পবিত্র-অপবিত্র থাকা-না থাকার ধারণাটিও এর সাথে সম্পর্কিত। ফলে বেশিরভাগ পরিবারে শিশুকণ্যাটি যে বাবার আদর-সোহাগ-ভালবাসায় বেড়ে উঠে, সে যখন কিশোরী হয়ে উঠে, শুধু পুরুষতান্ত্রিক সামাজিকায়নের কারণে, তার প্রথম ঋতুস্রাবের ঘটনা, তার ভয় পাওয়া-না পাওয়ার অভিজ্ঞতা বলতে পারে না। বলে না। অথচ অন্যান্য দৈনিন্দিন প্রাকৃতিক ক্রিয়া ( যেমন পায়খানা-প্রশ্রাব) সম্পাদন ও এ সংক্রান্ত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে হয়তো এ বাবাই, অথবা বাবা-মা দু’জন মিলে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছে। তার মানে হচ্ছে প্রথমত যৌনতাকেন্দ্রিক বিদ্যমান ধারণার জন্যই ঋতুস্রাবকে বাবার মতো খুব আপন মানুষটির কাছেও গোপন রাখার কসরত করতে হয় কিশোরী মেয়েটিকে। এবং এ সময় বাবা যে সহযোগিতা-সমর্থন দিতে পারতো- তা থেকে খুব প্রিয় মেয়েটি বঞ্চিত হয়। রাজশাহী এলাকায় প্রায় তিনশজন কিশোরী মেয়ের উপর একটি গবেষণা করেছিলাম বছর দুয়েক আগে। তাতে আমি দেখেছি যে, মাত্র আটজন বাবা মেয়ের প্রথম ঋতুস্রাব ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা করেছিল। শতকরা হিসেবে এটি খুবই সামান্য। সবচেয়ে অবাক করে দেয়া তথ্য হচ্ছে, গবেষণাভুক্ত ঐ কিশোরী মেয়েদের একটি বড় অংশ, তাদের প্রথম ঋতুস্রাবের ঘটনা মার কাছেও বলেনি। দাদী অথবা অন্য কাউকে জানিয়েছে। বাবা-মার আদরে বেড়ে উঠা মেয়েটি হঠাৎ করেই, তার জীবনের বিশেষ সন্ধিক্ষণে, বাবার সমর্থন না পাওয়াটা মেয়েদের জন্য একটি সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক বঞ্চনা। আর এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে এ প্রথমবারের মতো একটি বিজ্ঞাপন দেখার অভিজ্ঞতা হলো, যেখানে বাবাই তার কিশোরী মেয়েটির ঋতুস্রাবকেন্দ্রিক জরুরি বিষয়ব্যবস্থাপনার জন্য ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন। ডাক্তারের সাথে কথা বলছেন। ঋতুস্রাবকেন্দ্রিক বিদ্যমান সামাজিক মূল্যবোধ ও আচরণ বিনির্মাণে এ বিজ্ঞাপনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকহলো, বাজার করতে গিয়ে কিশোরী মেয়েটি নিজেই বলছে, স্যানেটারি ন্যাপকিন দেখিয়ে, বাবা, এটাও নিতে হবে। অর্থটা হচ্ছে, হয়তো দু’-একদিনের মধ্যেই বাবা আমার পিরিয়ড় শুরু হবে। অথবা হয়েছে। স্যানেটারি ন্যাপকিন সম্পর্কিত অন্যবিজ্ঞাপনগুলোর আধেয় বিশ্লেষণ করলে, এটি বলতেই হয়, এ বিজ্ঞাপন বিদ্যমান সামাজিক মূল্যবোধের জায়গাটা ভেংগে একটি নতুন মূল্যবোধ ও আচরণ তৈরির প্রতি খুব জোরালো ইংগিত দিয়েছে। কারণ, স্যানেটারি ন্যাপকিনের অধিকাংশ বিজ্ঞাপনেই, ঋতুস্রাবকে মেয়েদের সামাজিক গতিশীলতা ও চলাচলের প্রতি অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবেই পরিবেশন করা হয়েছে। একটি বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, মেয়েটি রাতের বেলা লেখাপড়াও করতে পারছে না। বারবার উঠে যেতে হচ্ছে। তার পিরিয়ড় শুরু হয়েছে বলে। যেটি আসলে ঋতুস্রাবকেন্দ্রিক বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শেরই পুননির্মাণ ছাড়া আর কিছু নয়। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে আমার বলতে দ্বিধা নেই যে, এ বিজ্ঞাপনটি একটি নতুন সূচনা, অন্তত ঋুতস্রাবকেন্দ্রিক পাবলিক-প্রাইভেট ধারণার যে বহুলপ্রতিষ্ঠিত সীমা-পরিসীমা, তার বিপরীত বার্তা নিয়ে আসতে পারার জন্য। খুব সীমিত পরিমাণে হলেও। তবে যে কথাটা বলে রাখা দরকার, যা আগেও বলেছি, পুঁজি ও বাজার বিদ্যমান মতাদর্শের শুধু ঐটুকুই ভাংগে, যেটুকু তার পণ্যের প্রসারের জন্য দরকার পড়ে। সে ধারা বা সীমাবদ্ধতা থেকে এ বিজ্ঞাপনটিও মুক্ত হতে পারে নি শেষ পর্যন্ত। কেননা, এখানে ফারিয়া নামক কিশোরী মেয়েটিকে বাবা সহযোগিতা করেছে, এ কথা সত্য; কিন্তু একই সাথে দেখানো হয়েছে যে, বাবা এ কাজটি করছেন শুধু মেয়েটির মা নেই বলে। যেন কাজটি মা থাকলে মারই করবার কথা। অথবা মারই প্রধান দায়িত্ব। এমনকি বিজ্ঞাপনের অন্যতম চরিত্র নারী ডাক্তার নিজেও অবাক হয়েছেন, এ রকম একটি বিষয় নিয়ে একজন পুরুষ, এ ক্ষেত্রে বাবা, যখন তার কাছে হাজির হয়েছেন। কিন্তু ঋতুস্রাব যে, একটি স্বাভাবিক সুস্থ্য জৈবিক উত্তরণের ধাপ, নারীশরীরের পূর্ণতারই একটি প্রক্রিয়া, পায়খানা-প্রশ্রাবের বেগ পেলে যেমন সবাইকে সাড়া দিতে হয়, সর্দি-জ্বর-কাশি হলে যেমন যত্ননিতে হয়, দরকার মতো, বাবা-মা সহ পরিবারের সবাইমিলে, এটি সেরকমই একটি স্বাভাবিক বিষয়- এ ধারণাটি নির্মাণের কোন চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়নি এ বিজ্ঞাপনটিতে। সুতরাং এ বিজ্ঞাপনটিতে বিদ্যমান পুরুষতন্ত্রের বিনির্মাণ যেমন আছে আবার পুনরোৎপাদনও আছে। নির্মাতা কতখানি সচেতন ছিলেন জানি না। হয়তো ছিলেন। হয়তো ছিলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিনির্মাণের পুরো দায়িত্ব ও কৃতিত্বটা বিজ্ঞাপনটি নিতে পারে নি। নিতে পারলে খুব বেশি অভিনন্দিত করতে পারতাম। সমাজ-নৃবিজ্ঞানী এরভিং গফম্যানের বিখ্যাত একটি বই ’ জেন্ডার এডভারটাইজম্যান্ট’। এ বইটিতেও তিনি একিট সুনির্দিষ্ট সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে নারী-পুরুষের কাছে পণ্যবিপননকারী বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কীভাবে সামাজিক আচরণ প্রত্যাশা করে, তা দেখার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে, নারী-পুরুষ সম্পর্র্কিত প্রতিষ্ঠিত ধারণাটি মূলত: মতাদর্শিক। বিজ্ঞাপন ততক্ষণ পর্যন্ত এ মতাদর্শেরই পুননির্মাণ করে। যতক্ষণ পর্যন্ত তার পণ্যের প্রসার নিশ্চিত থাকে। বিনির্মাণের পথে এগোয় না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, জোর দিয়ে বলতে চাই, বিনির্মাণ সম্ভব। খুব সম্ভব, যদি নারী-পুরুষ সমতায় বিশ্বাসী সচেতন বিজ্ঞাপন নির্মাতা তৈরি হয়, অথবা সে মানসিকতা থেকে কেউ এগিয়ে আসে। ভবিষ্যতে সেরকম কিছু আসবে, বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে, অন্তত সে স্বপ্নতো দেখাই যাই। এবং সে স্বপ্নটাই আমরা দেখছি। কারণ একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে, আমারা চাই বা না চাই, বিজ্ঞাপন বিরাট ভূমিকা পালন করে। বিদ্যমান নেতিবাচক মতাদর্শ ভেংগে নতুন মতাদর্শ নির্মাণে আমরা বিজ্ঞাপনে বিকল্প আধেয় দেখতে চাই। বিকল্প বার্তা দেখতে চাই। বিকল্প ভাষা দেখতে চাই। যা নারী-পুরুষকেন্দ্রীক প্রতিষ্ঠিত ঘেরাটোপ এর পুনরোৎপাদন নয়, বিনির্মাণকেই উৎসাহিত করবে। কারণ বিজ্ঞাপন প্রধানত; বাণিজ্যিক হলেও, এটি একই সাথে একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। অতএব বিনির্মাণের দায় বিজ্ঞাপন এড়াতে পারে না। পারা উচিত না।
গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা!
আরাফাত কৃতজ্ঞতা এত বড় লেখা পড়ে মন্তব্য করার জন্য।
ভাল লিখেছেন , আপনার চিন্তার সঙ্গে এক মত
আপনাকেও ধন্যবাদ।
এবং আমার ব্লগে স্বাগতম!
ধন্যবাদ, ভালো একটি লেখা উপহার দেবার জন্য। তবে এধরনের বিজ্ঞাপন আবার কোন কারনে বন্ধ না হয়ে যায়।
ধন্যবাদ পড়ে মন্তব্য করার জন্য। তবে এ বিজ্ঞাপনের একটি বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে এটি করেপোরেট বিপনন থেকে বের হতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ঐটাকেই গুরুত্ব দিয়েছে।
শুভেচ্ছা। ভাল থাকবেন।
সুচিন্তিত, সচেতনতামূলক এবং পরিশ্রমসাধ্য লেখাটির জন্য আপনি আন্তরিক ধন্যবাদ প্রাপ্য।
পড়েছেন। মন্তব্য করেছেন। মন্তব্য পেয়ে অনুপ্রাণিত।
আপনাকে শুভেচ্ছা।
কিশোরী মেয়েটিকে বাবা সহযোগিতা করেছে, এ কথা সত্য; কিন্তু একই সাথে দেখানো হয়েছে যে, বাবা এ কাজটি করছেন শুধু মেয়েটির মা নেই বলে। যেন কাজটি মা থাকলে মারই করবার কথা। অথবা মারই প্রধান দায়িত্ব। এমনকি বিজ্ঞাপনের অন্যতম চরিত্র নারী ডাক্তার নিজেও অবাক হয়েছেন, এ রকম একটি বিষয় নিয়ে একজন পুরুষ, এ ক্ষেত্রে বাবা, যখন তার কাছে হাজির হয়েছেন। কিন্তু ঋতুস্রাব যে, একটি স্বাভাবিক সুস্থ্য জৈবিক উত্তরণের ধাপ, নারীশরীরের পূর্ণতারই একটি প্রক্রিয়া, পায়খানা-প্রশ্রাবের বেগ পেলে যেমন সবাইকে সাড়া দিতে হয়, সর্দি-জ্বর-কাশি হলে যেমন যত্ননিতে হয়, দরকার মতো, বাবা-মা সহ পরিবারের সবাইমিলে, এটি সেরকমই একটি স্বাভাবিক বিষয়- এ ধারণাটি নির্মাণের কোন চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়নি এ বিজ্ঞাপনটিতে। সুতরাং এ বিজ্ঞাপনটিতে বিদ্যমান পুরুষতন্ত্রের বিনির্মাণ যেমন আছে আবার পুনরোৎপাদনও আছে। নির্মাতা কতখানি সচেতন ছিলেন জানি না। হয়তো ছিলেন। হয়তো ছিলেন না।
সহমত।
অনেক ধন্যবাদ।
এ জায়গাটুকু আমারও বেশী ভাল লেগেছে
ধন্যবাদ পড়ে মতামত দেয়ার জন্য।
শুভেচ্ছা। ভাল থাকবেন।
আগ্রহী হলে পড়তে পারেন:
http://www.newagebd.com/detail.php?date=2014-03-16&nid=86772#.UzqM2fmSxYa
লিংক শেয়ার করার জন্য অনেক কৃতজ্ঞতা। লেখাটি পড়েছি। বলাই বাহুল্য, লেখাটি ভাল লেগেছে এবং চিন্তার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ জায়গায় মিল আছে।
ধন্যবাদ।
বিজ্ঞাপনটা অবশ্যই স্টেরিওটাইপ বিনির্মাণের জন্য জরুরি। তবে বিজ্ঞাপনটা নিয়ে পাবলিকে ফোরামে আলোচনা হওয়াটা আরো দরকার। আপনার এই লেখাটি আসলে একাধিক কারণে প্রয়োজনীয়, ও সময়োপযোগী।
অনেক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ আপনার মতামতের জন্য।
আপনারে সাথে একমত হয়ে বলছি, শুধু বিজ্ঞাপন নয়; বিষয়টি নিয়েও পাবলিক ফোরামে আলোচনা হওয়া দরকার। একটি স্বাভাবিক উত্তরণের প্রক্রিয়াকে যখন আমরা পাবলিক-প্রাইভেট হিসেবে চিহ্নিত করি, তখনই মানুষ হিসেবে বিকাশের সুযোগটা সীমিত হয়ে পড়ে।
আবারও ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন