জোছনা রাতের অন্ধকার
এক. ভরা পূর্ণিমার এ ধবধবে জোছনায়ও চৌধুরী সাহেবের দোতলা বাড়িটাকে একটা ভূতুড়েবাড়ি বলে যেকেউ ভুল করতে পারে। মনে করতে পারে কয়েক যুগধরে এ-বাড়িতে কোন জনমানুষের পা পড়েনি। যারা এ-বাড়িটি সম্পর্কে জানে না, যাদের কোন ধারণা নেই, অথবা যারা এ মফস্বল শহরে একেবারে নতুন, চাকরি অথবা বেড়াবার সুবাদে আজকালের কোন এক সময় পা রেখেছে, এখনও এ শহরের সাথে অভ্যস্থ হয়ে উঠতে পারেনি, তাদের কাউকে তাদের সবচেয়ে কাংখিত স্বপ্নপুরনের প্রতিশ্রুতি দিলেও মনে হয় না কেউ এ মুহূর্তে বাড়িটির আশপাশে ভিড়তে চাইবে। বরং চিরচারিত প্রাণের মায়ায় একশভাগ দুরে থাকতে চাইবে। অথচ এ-মফস্বল শহরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ অথবা বলা যায় অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে চৌধুরী সাহেবের এ-দোতলা বাড়িটি। দু’বর্গ মাইলের মধ্যে এ একটি বাড়ি ছাড়া আর কোন বাড়িঘরের চিহ্ন নেই। চৌধুরী সাহেব নিজেই আর কোন বাড়িঘরের চিহ্ন তৈরি হতে দেননি। নিজ বাড়ির সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ার আশংকায়। মহানন্দার তীর ঘেষে যে বিশাল আমবাগান, যে আমবাগানটি প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে চৌধুরী সাহেব কিনে নিয়েছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসজীবন শেষ করে, সে আমবাগানের শেষপ্রান্তে প্রায় ত্রিশ বছর আগে চৌধুরী সাহেব এ-বাড়ি বানিয়েছিলেন। মফস্বলীয় কায়দায় নামকরণ করলে বাড়িটির নাম হতে পারতো চৌধুরী ভিলা। অথবা বাদশাহ শাহজাহানের মতো স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা প্রকাশের আনুষ্ঠানিক চিহ্ন হিসেবে নাম রাখলে এ-বাড়ির নাম হতে পারতো সেলিনা মঞ্জিল বা সেলিনা মহল। এমনকি একমাত্র মেয়ের নামেও বাড়িটির নাম হতে পারতো। তাতে স্থানীয় লোকজন এতদিনে এ- বাড়িটিকে শিলা মঞ্জিল নামেই চিনতো। কিন্তু চৌধুরী সাহেব পরিবারের কোন সদস্যের নামে বাড়ির নাম রাখলেন না। চৌধুরী তরুনকালে শিল্প-সাহিত্য চর্চা করতেন। এলাকায় একটা সাহিত্য সংগঠনের সভাপতি ছিলেন। জীবিকার দরকারে একসময় দেশ ছাড়লেও শিল্প-সাহিত্য যে একেবারে ভুলে যানটি তার প্রমাণ রাখলেন বাড়ির নামকরণের সময়। চৌধুরী বাড়ির নাম রাখলেন-অরুণোদয়। এ-মফস্বল শহরের বেশিরভাগ মানুষ অরুণোদয় নামটি মনে রাখাতো দূরে থাক, উচ্চারণই করতে পারে না। তাদের কাছে এটা চৌধুরী বাড়ি নামেই পরিচিত। শ্বেতপাথরে খচিত অরূণোদয় নামটি যখন ঘোরঅমানিশায়ও জ্বলতে থাকে, চিকচিক করে, সে দৃশ্য দেখে শুধু চৌধুরী সাহেব নন, আর যারা যারা এ শব্দটির অর্থ জানে, তারাও ভাবেন, অরুণোদয় নামটি শতভাগ স্বার্থক হয়েছে। মহানন্দার বুক যখন পানিতে থৈ থৈ করে, বিশেষ করে ভরা বর্ষায়, তখন যদি কখনওসখনও রাতের আকাশে সারি সারি মেঘের ফাঁকে হঠাৎ করেই চাঁদ উকি মারে, তখন মহানন্দার বুক আর এ-বাড়িটি একসাথে চিকচিক করতে থাকে। তখন যে কারও মনে হতে পারে বাড়িটির সাথে নদীর অথবা নদীর সাথে এ-বাড়ির একটা অঘোষিত সখ্যতা আছে। মিল আছে। সে মিল আর সখ্যতার কারণে একই সময়ে তাদের শরীরে ঝিলিক মারে। বাড়ির নকশা, রঙ, আর বৈদ্যুতিক আলো এমনভাবে সাজানো, তাতে বাড়িটি দিনে বেশি সুন্দর নাকি রাতে বেশি সুন্দর, সেটা নিয়ে এলাকায় অনেকের মধ্যে বিস্তর বিতর্ক আছে। কখনও কখনও কারও কারও মধ্যে এ-নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলতেও দেখা গেছে। মফস্বল শহরের মানুষদের, ঠিক সব মানুষদের নয়; বলা যায় পুরুষদের অবসর কাটে চায়ের দোকানে, দেশ, জাতি, রাষ্ট্র এমনকি বিশ্ব উদ্ধারে। সে আলোচনায় অরুণোদয় নামের এ বাড়িটিও স্থান পায়- এ থেকে মোটামুটি বাড়িটির সৌন্দর্য ও আকর্ষণ-এ মানুষ কতটা বিমোহিত- তার কিছুটা আঁচ করা যায়। প্রতিটি চাঁদনী রাতে যে বাড়িটি এ-মফস্বল শহরের একটা বাড়তি সৌন্দর্য হিসেবে যুক্ত হয় আজ ভরা পূর্ণিমার রাতে সে বাড়িটিকেই একটা ভূতুড়েবাড়ি মনে করার মতো কার্যকারণ তৈরি হওয়া নিঃসন্দেহে ভীষণ আশ্চর্যের। সে আশ্চর্যরকম ঘটনাটিই ঘটেছে আজ।
গত কয়দিন ভীষণ গরম পড়ছে। নবাবগঞ্জ ভৌগলিকভাবে এমন একটি জেলা, যেখানে শীতের সময় শীত আর গরমের দিনে গরম পড়ে, খুব নিরলসভাবে। তারপরও এ-বছর গরমের মাত্রা আগের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। অস্বাভাভিকভাবে। আজ যুক্ত হয়েছে অসহ্য গরমকে সীমাহীন করে তোলার আরও কিছু উপাদান। ফলে মহানন্দার জলসিক্ত যে বাতাস প্রতিদিন আমগাছের পাতায় ঝিরঝির কাঁপন তুলে, গরমেও পরম মমতায় হিমেল পরশ বুলিয়ে যায়, একটা নির্দিষ্ট বিরতিতে, আজ সে বাতাসও নেই। প্রতিটি গাছের পাতা একদম স্থির হয়ে আছে। কোন সাড়াশব্দ নেই। নিরিবিলি। নিস্তব্ধ। শান্তসুবোধ বালক-বালিকাদের মতো। অথবা অনেক দূরে ফেলে আসা প্রিয় মানুষ, যে কেবল কামনায় আছে। ভাবনায় আছে। অনুভবে আছে। তারপরও এ মুহূর্তে অধরা। আমবাগান থেকে অদূরে অবস্থিত বাড়িগুলোর দরজা-জানালা খোলা। কোন কোন বাড়ির সদস্যদের নড়াচড়া, হাটাচলা কিছুটা আঁচও করা যাচ্ছে। কেউ কেউ বাড়ির বৈদ্যুতিক আলো নিভিয়ে দিয়েছে। এমনও হতে পারে এ- ভরা পূর্ণিমার স্নিগ্ধআলোয় ডুব দিয়ে থাকার একটা প্রবল ইচ্চা তাদের ইতিমধ্যে আক্রান্ত করেছে। অথবা অসহ্য খরতাপের হাত থেকে কিছুটা মুক্তির জন্যও তারা বাতি নিভিয়ে থাকতে পারে। অনেক দুরের কোথা থেকে দু’একটি কথাবার্তার শব্দও ভেসে আসছে। খুব অস্পষ্টভাবে। কেবল চৌধুরী সাহেবের অরুণোদয় ভবনটি একশো ভাগ সাড়াশব্দহীন। বাড়ির সবক’টি দরজা-জানালা বন্ধ। এমনকি সদর দরজাও বন্ধ। সমস্ত বৈদ্যুতিক বাতিগুলো নেভানো। দারোয়ানদেরও নড়াচড়ার শব্দ নেই। প্রতিদিনের মতো দারোয়ানদের বাঁশির শব্দে রাতের নিস্তব্ধতাকে থেমে থেমে ভেংগে দেয়ার কোন আলামত নেই। অথচ এ-সময় শুধু দারোয়ানরা নয়; চৌধুরী সাহেব নিজেও কয়েকবার চারদিকে পরখ করে আসেন। নিরাপত্তাব্যবস্থাপনাজনিত তার নড়চড়ার দৃশ্য মাঝে মাঝে দূর থেকেও দেখা যায়। আজ সকালেও অনেকে চৌধুরী সাহেবকে তার চিরচারিত অভ্যাসটির চর্চা করতে দেখেছে। একটা লাঠি হাতে তিনি সারা আমবাগানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। যে কাজটি তিনি সকাল-বিকাল-রাতে রুটিন হিসেবে করে থাকেন। কিন্তু আজ রাতটা একেবারে ব্যতিক্রম হয়ে উঠেছে। এ-মুহূর্তে বিশাল আমাবাগানের মধ্যে কেবল নিঃশব্দে দোতলা বাড়িটিই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সে বাড়ির বাইরে বা ভেতরে যেন কোন সাড়াশব্দ নেই। অন্তত বাইরে থেকে সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে না।
দুই
চৌধুরী সাহেবের আমবাগান এবং তার আশপাশের এলাকায় রাত ক্রমশ: হাত-পা ছড়িয়ে মহাআয়েশে গভীর হতে থাকে। রাত যত গভীর হয়; এ মফস্বল শহরের আকাশে জেগে উঠা চাঁদটি যেন সমান্তরাল গতিতে উজ্বল হতে থাকে। কিন্তু চাঁদের সে উজ্জ্বলতা বা জোছনার স্নিগ্ধতা চৌধুরী সাহেবের বাড়ির ছাদ, আঙিনা, আমবাগান, তার দারোয়ান অথবা চৌধরী পরিবারের অন্যকোন সদস্যকে কোনভাবেই স্পর্শ করতে পারে না। বরং আজ চৌধুরী বাড়িতে রাতের গভীরতার সমান আনুপাতিকতায় নিস্তব্ধতা হাত মেলায়। কোলাকুলি করে। সহবাসে লিপ্ত হয়। দূর থেকে চাঁদের জোছনা যেন সে সহবাসের দৃশ্য দেখতে থাকে অপলক দৃষ্টিতে। এ-রকম সহবাস-দৃশ্য দেখে যেন চাঁদেরও মনে পুলক জাগে। চাঁদও প্রবল উৎসাহে ছড়াতে থাকে আপন সৌন্দর্য। এমন কত কত পূর্ণিমার রাতে চৌধুরী সাহেব ছাদে বসে কাটিয়েছেন। মহানন্দার বুকে ধবল জোছনার মাতামাতির মুগ্ধতায় হঠাৎ হাত রেখেছেন পাশে বসা স্ত্রীর কাঁধে। সে হাত কেবল কাঁদ ছুয়েই ক্ষান্ত থাকে নি। প্রসারিত হয়েছে এক অন্তহীন পথে। তারপর দু’জন মিলে অনুবাদ করেছেন আপন শরিরীকাব্য। শরীরের শিরায় শিরায় জেগে উঠা তরঙ্গে সাঁতার কেটেছেন। শৈশবে বড়দের কাছথেকে হঠাৎ হঠাৎ পাওয়া বহুপ্রতিক্ষিত রঙিন চকলেটের মতো একে অপরের ঠোট চুষতে চুষতে অথবা যৌবনের বিস্তৃত এনাটমি পড়তে গিয়ে কখন জোছনা মিলিয়ে গিয়ে পুব আকাশ রঙিন হয়ে উঠেছে, নতুন ভোরের সূর্যালোয়, সেটা টের পাননি। আজ ঠিক সে রকম একটি পূর্ণিমা হলেও, ছাদে গিয়ে জোছনা উপভোগ তো দূরে থাক, চৌধুরী সাহেব নিজকে বিচ্ছিন্ন রেখেছেন বাইরের সমস্ত কোলাহল থেকে। চাঁদের জোছনা, জোছনার স্নিগ্ধ-মায়াবী সৌন্দর্যের বদলে আজকের ভরা পূর্ণিমাকে চৌধুরী সাহেবের মনে হচ্ছে, তার জীবনে দেখা সবচেয়ে ভয়াবহতম অমাবশ্যা। যে দিকে চোখ যায় তার চোখের সামনে ভেসে উঠে ধবল জোছনার বদলে কেবল অমাবশ্যার অন্ধকার। রাগে, কষ্টে তার হাত কাঁপে, চোখ কাঁপে, সারা শরীর কাঁপে। একশ তিন-চারডিগ্রী জ্বর হলে যেমন শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। জোছনা রাতের গোলাকার চাঁদটি কালো অমাবশ্যা হয়ে ভেসে উঠে তার সামনে। তারপর কালো-অপরিস্কার দাঁত বের করে চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে একটা টিটকারীর হাসি হাসে। চৌধুরী সাহেবের কানে যেন কেমন একটা শব্দ অস্পষ্টভাবে বাজতে থাকে। কে যেন তার কানে ফিসফিসিয়ে বলে যায়-ছি, চৌধরী সাহেব, শেষ পর্যন্ত আপনার ঘরেও পাপ, পাপ পাপ!। চৌধুরী আশেপাশে তাকায়। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। তারপরও শব্দটি ক্রমশ তার কান হয়ে মাথায়, তারপর সারা শরীরে প্রশমিত হয়। তার অসহ্য লাগে। কান যেন বন্ধ হয়ে আসে। তার এ মুহূর্তে মনে হয়, কান দু’টি না থাকলেই বুঝি ভাল হত। অরুণোদয় ভবনের একটি অন্ধকার কক্ষে চৌধুরী সাহেব অপেক্ষা করতে থাকে। আজ রাতে, সূর্য উঠার আগেই এ-আপদ বিদায় করতে হবে। না হয় সব ধুলায় মিশে যাবে। তিলতিল করে গড়ে তোলা মানসম্মান, ইজ্জত। সব সব।
তিন.
চৌধুরী সাহেবের দ্বিতল বাড়ি মানে অরুণোদয় ভবনের নিচ তলার ছোট একটি কক্ষ। ভবনের একেবারে পেছনের দিকে এর অবস্থান। বাইরের আলো-বাতাসের তেমন একটা প্রবেশাধিকার নেই এ কক্ষটিতে। বাড়ি তৈরির সময় এটাকে সম্ভবত অতিরিক্ত গুদামঘর হিসেবে চিন্তা করা হয়েছিল। কিন্তু এখন এটি একটি পরিত্যক্ত কক্ষ। গুদামঘর হিসেবেও ব্যবহার করা হয় না। কখনও কখনও একসাথে খুব বেশি আত্বীয়স্বজন এসে পড়লে, রাতে ঘুমানোর জায়গার সংকুলান না হলে, অতিথিদের সাথে আসা কাজের লোকদের থাকতে দেয়া হয় এ-ঘরটিতে। তাছাড়া সারা বছর এ কক্ষে কোন মানুষের পদচিহ্ন পড়ে না। আসলে কক্ষটি বিশাল বাড়ির এতটা ভেতরে যে, পাঁচশ ওয়াটের কয়েকটি বৈদ্যতিক বাতি জ্বালিয়ে রাখলেও বাইরে থেকে টের পাবার কোন সম্ভাবনা নেই। বছরের অধিকাংশ সময় ব্যবহার অনুপযোগী, অব্যবহৃত এ কক্ষটিই আজ চৌধুরী পরিবারের কাছে সবচেয়ে নিরাপদ কক্ষ। সেখানেই মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে, বিছানা পেতে শোয়ানো হয়েছে চৌধুরী ও সেলিনা চৌধুরীর একমাত্র কন্যা-শীলাকে। শিলার মাথার কাছে একটি এবং পায়ের কাছে দু’টি হারিক্যান জ্বালানো। বসে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মা সেলিনা চৌধুরী। মনে মনে তসবিহ পড়ছেন। আল্লাহকে ডাকছেন। পরিস্থিতির প্রতি কড়া নজর রাখছেন। আর নিয়মিত বিরতিতে অগ্রগতির বিবরণ শুনিয়ে আসছেন অন্য একটি কক্ষে অপেক্ষমান চৌধুরী সাহেবকে। অগ্রগতির সংবাদ বিচার-বিশ্লেষণ করে মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছেন চৌধুরী সাহেব। শিলার ঠিক কোমরের কাছে বসে আছে খালা শিউলী আক্তার এবং তার সাথে আসা ধাত্রীবিদ্যায় পারদর্শী ধলাবানু। এ কাজে বিস্তর অভিজ্ঞতার জন্য শেরপুরে তার খ্যাতি রয়েছে। অনেক দূর থেকে ধলাবানুকে নিয়ে আসা হয়েছে। ধলাবানু আসতে রাজী হয়েছে- সে জন্য চৌধুরী সাহেব এবং তার স্ত্রী সেলিনা চৌধুরী খুবই কৃতজ্ঞ। তারা এটাকে চৌধুরী পরিবারের প্রতি ধলাবানুর বিশেষ দয়া হিসেবে দেখছেন। না হয় কোন না কোন ক্লিনিকে নিয়ে যেত হত শীলাকে। তাতে এক কান থেকে আরেক কানে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ার আশংকা ছিল। যদিও ধলাবানুকে দিয়ে কাজটি সারাতে গেলে তাদের একমাত্র কন্যার বিপদ হতে পারে, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। কিন্তু সে চিন্তা এখন বড় নয়। বরং চৌধুরী পরিবারের মানসম্মান আর বিয়েরবাজারে যোগ্য পাত্রী হিসেবে শীলার সম্ভাবনা অটুট রাখার বিষয়গুলোই চিন্তার মূলকেন্দ্রে ঘুরপাক খেতে থাকে।
কিছুক্ষণ আগে শীলার তলপেটের ব্যথাটা আরও বেড়েছে। প্রসববেদনাকাতর মেয়েটিকে দেখে সেলিনা চৌধুরীর মেয়েটিকে কাছের কোন ক্লিনিকে নিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু সে ইচ্ছেটা আর বাড়তে দেয় না। তার আগেই খুন করে ফেলে নিজের ভেতর। কারণ সেলিনা চৌধুরী খুব ভাল করেই জানে, তার স্বামী চৌধুরী কিছুতেই তাদের একমাত্র মেয়েটিকে এ মুহূর্তে এ-শহরের কোন ডাক্তার বা ক্লিনিকে নেবে না। এবং এটাও ঠিক যে, এ- ছোট শহরে সবাই যেখানে সবার হাড়ির খবর রাখে, সেখানে শীলাকে যদি ক্লিনিকে নেয়া হয়, তা নিমিষে রাষ্ট্র হয়ে যাবে। অতএব ধলাবানু-ই এ মুহূর্তের ভরসা। ধলাবানু তার অভিজ্ঞতালব্ধ চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে শীলাকে। কিছুক্ষণ পরপর শীলার শরীরটা উপরের দিকে উঠে আসছে। চিৎকার করছে। কপাল দিয়ে ঘাম ঝরছে। ধলাবানুর অভিজ্ঞতা বলে-এগুলি শেষের দিকের আলামত। শেষ সময়ে যেসব কৌশল ব্যবহার করতে হয়, তার প্রতিটিই প্রয়োগ করে যাচ্ছে। সে নিশ্চিত হয় কয়েক মিনিটের মধ্যেই খালাস পাবে। সে একবার সেলিনা চৌধুরীর দিকে তাকায়। আবার মনোনিবেশ করে শীলার নাভীমূল অঞ্চলে। হঠাৎ ওঁয়া, ওঁয়া শব্দে ভেঙ্গে যায় চৌধুরী বাড়িতে আয়োজিত রাতের বাড়তি নিরবতাও। ধলাবেগমের চোখ খুশিতে ঝিলিক দিয়ে উঠে। যেমন ঝিলিক দেয় তার অন্যসব ক’টি সফল ঘটনায়। ধলাবেগম একটা বড় স্বঃস্তির নি:শ্বাস ফেলে। সে নিঃশ্বাসই বলে দেয় যে, ধলা বেগমের শুধু অভিজ্ঞতার ঝুলিই বড় হয়নি। তার কাজের চাহিদা নিজ এলাকার বাইরেও তৈরি হয়েছে। সে খুশী সে চেষ্টা করেও লুকাতে পারছে না। চৌধুরী পরিবারের শত গোপনীয়তার আয়োজনের মধ্যেও সে বলে উঠে, বাহ, একেবারে শীলা মায়ের চেহারা। কেমন ফুটফুটে-পরিস্কার। ধলাবেগম কথাগুলো বলতে থাকে আর প্রসবউত্তর দরকারি কাজগুলো সারতে থাকে। ধলাবেগমের কথায় সেলিনা চৌধুরীর বুকটা ধড়পড় করতে থাকে। শীলাকে বেশ কিছু ঘুমের বড়ি খাইয়ে দেয়া হয়। ইচ্ছে না থাকার পরও সেলিনা চৌধুরী অনাহত আগুন্তুকটিকে কয়েকবার আড়চোখে দেখে। তার এ দেখাও ধলাবেগমের বক্তব্যকে মনে মনে সমর্থন দেয়। তারও মনে হয়, চেহারা ঠিক শীলার মতোই হয়েছে। তার ভেতরে ভেতরে নানী ডাক শোনার এক অদৃশ্য বাসনা তৈরি হয়। কিন্তু সে বাসনা স্থায়ী হতে দেয় না, অথবা সে জানে এ রকম একটি বাসনা তৈরির কোন সুযোগই নেই। দুরুদুরু বুকে সেলিনা চৌধুরী মুখ ফেরায় শীলার দিকে। কোন সাড়া শব্দ নেই। মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। তারপরও নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করে। তিনি স্পষ্ট দেখতে পান শিশুটি মুখ নাড়াচাড়া করছে। সম্ভবত তার ক্ষিদে পেয়েছে। এটা দেখে তার ভেতরের নারীসত্ত্বাটি জেগে উঠে। সেলিনা চৌধুরীর ইচ্চে হয় শীলার বুকের কাপড় সরিয়ে কোন একটি স্তনের সাথে শিশুটির মুখ লাগিয়ে রাখতে। শিশু তার মায়ের স্তন চুষছে- পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দৃশ্যটি দেখতে বুকের মধ্যে একটা প্রবল আকাংখা জেগে উঠে। তার মনে পড়ে যায় শীলার জন্মগ্রহণের মুহূর্তটি। শীলাকে স্তন্যদানের সুখকর স্মৃতিগুলো। এ রকম কতিপয় মাতৃসূলভ ভাবনা তাকে ক্রমশ দখল করতে থাকলেও সেলিনা চৌধুরী জানে, রাত শেষ হয়ে আসছে। ভোর হওয়ার বেশি বাকী নেই। হঠাৎ একটি তোয়ালের মধ্যে পেঁচিয়ে শিশুটিকে নিয়ে যায় পাশের অন্ধকার কক্ষে। যেখানে চৌধুরী সাহেব সারারাত অপেক্ষা করছে। অগ্রগতির দৃশ্যমান আলামত দেখে চৌধুরী উঠে দাঁড়ায়। চৌধুরীর ভেতরে আরেক চৌধুরী জন্ম নেয়। নতুন চৌধুরী আগের চৌধুরীকে গিলে খায়। এ মুহূর্তে চৌধুরী অন্যজগতের কেউ। এখন সে পৃথিবীর যেকোন সম্ভাবনার উপর পা মাড়িয়ে হাটতে পারবে। গোলাপের বাগান দু’পায়ে মাড়াতে পারবে। কোন দ্বিধা-দ্বন্দে ভোগার সময় নেই আজ। চৌধুরী তার রোমশ হাত রাখে সদ্যফোটা গোলাপের পাপড়িতে। তারপর এক একটা পাঁপড়ি ছিড়ে ফেলে। নিজ হাতে। সেলিনা চৌধুরী চোখ বন্ধ করে রাখে। মনেমনে ভাবার চেষ্টা করে কিছুই হয়নি। কিছুই ঘটেনি তার সামনে। গোলাপের চোখ দিয়ে রক্তঝরে। মুখ দিয়ে রক্তঝরে। কানবেয়ে রক্তঝরে। একটি কালো পলিথিনে রাখা হয় সদ্যজাত রক্তাক্ত গোলাপটিকে। কিছুক্ষণ আগেও যে সুবাস ছড়িয়েছিল, অথবা সুবাস ছড়াতে পারতো আরও অনেক অনেক বছর। টিপটিপ পায়ে ঘুরে বেড়াতে পারতো চৌধুরী বাড়ির একতলা, দোতলা, সিঁড়ি, ছাদ, বারান্দা, প্রতিটি রুম। নির্মল উচ্ছাসে মাতিয়ে রাখতে পারতো সবার হৃদয়-মন্দির। ততক্ষণে মসজিদ থেকে ভেসে আসে আজানের শব্দ। চৌধুরী তার হাত, মুখ, চোখ পরিস্কার করে মুছে ফেলে হন্তারকের দৃশ্যমান চিহ্নগুলো। একটি বাজারের ব্যাগে কালো পলিথিনটি রাখা হয়। তারপর চৌধুরী বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে। বাজারের ব্যাগটি নিয়ে। যাবার সময় সেলিনা চৌধুরীর কানের কাছে ফিসফিস করে বলে- আপদ বিদায় করে আসি মহানন্দার স্রোতে। সম্ভবত তখনও মহানন্দার জলরাশিতে ধবল জোছনা তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে মাতামাতি করছে।
চার.
শীলাকে দেয়া ঘুমের ঔষধের রেশ কাটতে কাটতে পরের দিন সকাল সাতটা বেজে যায়। শীলার ঘুম ভাঙ্গে। সকালের মিষ্টি আলো ঘরের জানালা বেয়ে সোজা এসে পড়ে শীলার বিছানায়। গত রাতের চাঁদের মতোই আজকের সূর্যটাও বড় বেশি উজ্বল। ঘরে আলো আসতে দেখেই শীলা বুঝে নেয় সে আর গত রাতের বিদঘুটে অন্ধকার ঘরটিতে নেই। তাকে অন্যঘরে নিয়ে আসা হয়েছে। তার সারা শরীরে ক্লান্তির ছাপ। একটু নড়াচড়া করার শক্তিও যেন নেই। শরীর নড়াচড়া না করলেও বুকের ভেতরে জমেথাকা স্মৃতি নড়াচড়া শুরু করে। আস্তে আস্তে গতরাত হাজির হয় তার সামনে। নিজের তলপেটে হাত রাখে। ভীষণ খালি খালি মনে হয়। গতকালও যেখানে আরও একটি জীবনের স্পন্দন ছিল। তার সারা শরীর তখনও একটা চাদর দিয়ে ঢাকা। বাবা চৌধুরীকে দেখা যাচ্ছে না। মা ও খালা বসে আছে তার মাথার কাছে। প্রসবউত্তর রুগীর খাবারদাবার রার্খা পাশের একটা টেবিলে। এখন শীলার কাছে এটি স্পষ্ট, যে গোলাপের সম্ভাবনাকে সামনে রেখে সে গত নয় মাস অপেক্ষা করেছে, শুধু অপেক্ষা করেনি, বলা যায় লড়াই করেছে, বিপ্রতীপ স্রোতের সাথে, বাবা-মার সাথে, একরাতের ঘুর্ণিঝড়ে সব তছনছ হয়ে গেছে। তার শরীরের ভেতরে বেড়ে উঠা সে শরীর, সে প্রাণ, সে গোলাপটি কেমন ছিল। শীলার মতো নাকি সৈকতের মতো। তার বুকজুড়ে কান্না আসে। কিন্তু কাঁদার শক্তিও নেই। অবসন্ন শরীরে। শীলার মনে পড়ে যায়-এক বৃষ্টিভেজা বিকালের কথা। নি:শ্বাসে নিঃশ্বাসে বিস্তৃত বিশ্বাসের হাতধরে সেদিন শীলা ও সৈকত একাকার হয়ে গিয়েছিল। পরম একাগ্রতায় পরস্পরের জন্য খুলেদিয়েছিল সমস্ত অলিগলি, সীমারেখা। লিখেছিল বহুপ্রতিক্ষিত এক প্রেমময় কাব্য। এর কিছুদিন পরেই শীলা টেরপেয়েছিল অন্য একটি প্রাণের অস্তিত্ব। নিজের শরীরে। না, শীলা সেদিন কোন ভয় পায়নি। বরং শরীরে প্রাণধারণের এক ব্যতিক্রম সক্ষমতা শুধু নারীরই আছে, সেটা ভেবে আপ্লুত হয়েছিল। শিলার মনে পড়ে যায় একটি মিছিলের কথা। সারাদেশে তখন খন্ডখন্ড মিছিল চলছে। প্রায় নয়বছর ধরে ঝেঁকেবসা স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে। মিছিলে পুলিশের গুলি চালাবার কথা। সৈকতের গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা। গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকার কথা। হাসপাতালে একটানা পাঁচদিন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে জীবনের কাছে হেরে যাবার কথা। তারও অনেক পরে মায়ের চোখে ধরা পড়ার কথা। মা’র চোখে পড়ার পর থেকে মা খুব বুঝিয়েছিল। বলেছিল, সৈকত যেহেতু বেঁচে নেই, নষ্ট করে ফেল। সমাজ, সংসার, চুনকালী আরও কতসব শব্দ শুনতে হয়েছে। ধর্মের দোহাই দিয়েছে। কোন কিছুই টলাতে পারে নি। শীলা- সৈকতের দু’বছরের ভালবাসাবাসির পথপরিক্রমার এক অনিবার্য মুধরতম মুহূর্তের উত্তরাধিকার একটি নিস্পাপ ভ্রণকে নষ্ট করা মানে দু’জনের মধ্যে বেড়ে উঠা একটি পবিত্র অঙ্গীকারের অস্বীকার। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন-মিছিলের পরিচিত মুখ সৈকতের অকাল মৃত্যু না হলে, সামরিকজান্তার হাতে সৈকত খুন না হলে, আজ সে অঙ্গীকার আরও বিস্তৃত হতো, আরও পাকাপোক্ত হতো। সামাজিক নিয়মে এতদিন তাদের সংসারও হতো। অতএব নিজের জরায়ুতে ধারণকরা প্রাণটি যাতে পৃথিবীর আলো দেখতে পায়, তার জন্য যা যা করা দরকার শীলা সব কিছুই করেছে। এমনকি বাবা-মার কড়াকড়িতে ছয়মাসের মতো একটা বিচ্ছিন্ন সামাজিক জীবনও কাটিয়েছে। না, শীলা আর কিছুই ভাবতে পারে না। অথবা ভাবতে চায় না। তার চোখ জুড়ে নোনা জলের বন্যা নামে। নিজকে মনে হয় এক যুদ্ধফেরত পরাজিত সৈনিক। তার প্রিয় বাবা, মা, খালা, সমাজ- সবাইকে মনে হয় হন্তারক। শিশু হন্তারক। নবজাতকের খুনী। তার মনে হয়, রাষ্ট্রে যেমন স্বৈরাচার থাকে, ঠিক সমাজেও স্বৈরাচার থাকে। সৈকত খুন হয়েছিল রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচারের হাতে; আর সৈকত-শীলার ভালবাসার উত্তরাধিকার খুন হয়েছে সামাজিক স্বৈরাচারের হাতে। শীলা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে, উচ্চারণ করে-খুনী। উচ্চারিত সে শব্দ খুব বেশি দূর যায় না। অথবা যায়। আবার যেতে যেতেই মিলিয়ে যায়। বাতাসের সাথে। শুধু শীলাই পড়ে থাকে। তার বিছানায়। অনেকটা অবশভাবে। নিরুত্তাপভাবে। তখনও তার সামনে টাটকা হয়ে থাকে একটি গোলাপের স্মৃতি। লাল টকটকে গোলাপের স্মৃতি। তার নিজের শরীরের উষ্ণতা দিয়েই বেড়ে উঠেছিল যে গোলাপ। তারই জরায়ুতে। বিগত নয় মাসজুড়ে। তার কল্পনায় ভেসে উঠে মহানন্দার বুক। তার মনে হয় মহানন্দার বুকে আজ কোন জলরাশি নেই; কেবল বইছে রক্তের স্রোতধারা।
ধন্যবাদ আরাফাত।
শুভেচ্ছা। ভাল থাকবেন।
খুবই নাটুকে
পড়ে মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা।
মন্তব্য করুন