হঠাৎ পড়লো মনে
পুষির কথা মনে পড়লো হঠাৎ। না, না, আমার পুষি বিড়ালের কথা না । যদিও আমার ধবধবে সাদা পুষি বিড়ালটা ছিল বিড়ালকূলের গর্ব এক অনন্য ব্যতিক্রম । তাকে মনে পড়ে প্রায়ই । এত বাধ্য একটা বিড়াল নিয়ে যে কেউ গর্ব করতেই পারে, কারণ সে কথনও চুরি করে খেতনা । বরং অন্য বিড়াল, এমনকি কুকুরকেও সে আটকে দিত আমার কোন খাবার চুরি করা হতে । উঠোনে বসে খাবার খেলেও সে কাক বা হাঁস-মুরগীদের কাছে ভিড়তে দিত না । তার নির্দিষ্ট পাত্র ছাড়া অন্য কোন পাত্রের খাবারের দিকে সে ফিরেও তাকাতোনা । তবু আজ তার কথা নয় । সেই ছোট্টবেলায় তার অকাল প্রস্থানে ধূলায় গড়াগড়ি দিয়ে কত যে কান্নাকাটি করেছিলাম, সে কথাও আজ নয় । আজ অন্য এক পুষির কথা হঠাৎ করে মনে পড়লো । এই পুষিটা হচ্ছে একটা মেয়ে, আমাদেরই প্রতিবেশী ।
পুষির বাবা সরিষা, তিল, তিসি কাঠের ঘানিতে (আমরা বলতাম ‘ঘানিগাছ’) দিয়ে তেল বের করতো । তাদের বাড়ী পরিচিত ছিল কলুবাড়ী নামে (আমাদের আঞ্চলিক কথ্য ভাষায় ‘খুলুবাড়ী’) । মাঝেমধ্যে তাদের ওখানে যেতে হতো তেল কিনতে । চোখে ঠুলি পরানো বলদ কাঠের ঘানির চারপাশে ঘুরছে, ঘানি থেকে ফোটায় ফোটায় তেল পড়ে পাত্র ভরে উঠছে, সে বয়সে এ দৃশ্য বড়ই মনোরম মনে হতো । অবাক বিস্ময়ে দেখতাম আর অমন একটা ঘানির মালিক হবার ইচ্ছা হতো । ঘানিতে চড়তে পারার আনন্দও কম ছিলনা, পাথরের ভারের বদলে কখনো-সখনো ভার হওয়ার সুযোগ জুটতো আমারও । অবশ্য সেটা নির্ভর করতো পীরুচাচার (পুষির বাবা) মর্জির উপরে । তো আজ হঠাৎ সেই কলুবাড়ীর পুষির কথা মনে পড়লো ।
আমাদের বসত ঘরের বারান্দার কাছাকাছি উঠোনের এক কোনে ছিল একটা পাতকুয়া । এই কুয়ার পানিই আমাদের ও প্রতিবেশীদের পানীয় জলের উৎস । অবশ্য অনেকেই তখন নদীর পানির উপরেও নির্ভর করতো । একমাত্র নলকূপটি ছিল আমাদের বাড়ীর পাশের হাই স্কুলে । একদিন আমরা দু’ভাই আমাদের ঘরের বারান্দায় খেলছিলাম । এমন সময় পুষি এলো কলসী কাঁখে কুয়া থেকে পানি নিতে ।
পুষির বয়স তখন বোধহয় দশ বা বারো বছর । আর আমার ৮-৯ বছর হতে পারে । আমার পিঠোপিঠি যে ভাই, সে আমার চেয়ে দু’বছরের ছোট । ছোট হলেও সেই-ই ছিল আমার সবচেয়ে কাছের এবং সর্বক্ষণের খেলার সাথী । পুষি আমাদের খেলার সাথী ছিলনা । প্রতিবেশী এবং পীরুচাচার মেয়ে হিসেবে পরিচয় ছিল, ঘনিষ্টতা গড়ে ওঠেনি । বয়সে আমাদের চেয়ে বড় এবং মেয়ে বলেই বোধহয় তার সাথে খেলার সাথীর সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনি । তবে সেদিন কী খেয়ালে কে জানে, আমার ছোট ভাই হঠাৎই পুষিকে ডেকে বললো, “আয়রে পুষি, খেলা করি” । আর যাবে কোথায় ? পুষি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো । তার মুখনিঃসৃত বাণী আমাদের ভস্ম করে দেবার জন্য ছিল যথেষ্ট । যেসব শব্দ তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছিল তার অধিকাংশের অর্থ তখন না জানায় বা বুঝতে না পারায় সম্ভবত তেমন কিছু ঘটেনি । পুষির বাণীতে ছিল এমন কয়েকটি শব্দ, যেমন “ঢ্যামনা, বারোচুদা, ছিনাল, গুখেকো” (বন্ধুরা, অশ্লীল মনে হলে অগ্রিম ক্ষমাপ্রার্খী) এখনও মনে আছে । আরো যে কত বিশেষণে সেদিন আমরা দু’ভাই বিশেষায়িত হয়েছিলাম তা আজ আর মনে নাই । তবে পুষির সে উগ্র বাঘিনীর দৃষ্টি ভুলতে পারা সম্ভব নয় কোনমতেই ।
পুষির এমন ক্ষেপে উঠবার কারণ সেদিন ঐ অতটুকু বয়সে আমরা দু’ভাইয়ের কেউই উদ্ধার করতে পারিনি । যখন বুঝতে শিখলাম, তখন বুঝলাম পুষির অমন রণরঙ্গিনী হয়ে উঠবার যৌক্তিকতা । “আয়রে পুষি, খেলা করি”, এ খেলার অর্থ যে ‘অন্য কোন খেলা’ হতে পারে তা বুঝতে আমাদের দু’ভাইকে বেশ বড় হয়ে উঠতে হয়েছিল । আর তা বুঝতে পেরে লজ্জ্বিত হয়েছিলাম, এখনও মনে পড়লে ‘লজ্জ্বায় রাঙা’ (নাকি বাদামী?) হয়ে উঠি ।
''অবাক বিস্ময়ে দেখতাম আর অমন একটা ঘানির মালিক হবার ইচ্ছা হতো ।''
ছোটবেলার ইচ্ছেগুলো কতই না বিচিত্র! আমি স্বপ্ন দেখতাম- কনডেন্সড মিল্ক কারখানায় চাকরি করব। তাহলে হাতের তালুতে নিয়ে ইচ্ছে মতো দুধ খাওয়া যাবে!
''আয়রে পুষি, খেলা করি।'' হা হা...
এখনতো আমিও হাসি । কিন্তু গালি যখন খেয়েছিলাম.....
চুপচাপ পড়ে গেলাম।
শুধু শুধুই পড়লেন, একটুও ব্যথা পেলেন না ?
আয়রে পুষি, খেলা করি...
তানবীরা, কিছুই বুঝলেন না মনে হচ্ছে- গুরু উদরাজীকে বলবো নাকি- বাখ্যা করতে?
আয়রে পুষি, খেলা করি
হা হা প গে এবং অস্থির হুদা ভাই। দারুণস্য দারুণ।

ধন্যবাদ । কিন্তু "হা হা প গে এবং অস্থির " এটুকুর অর্থ যে বোধগম্য হলো না !
অসুবিধা নাই হুদা ভাই। হা হা প গে বুঝবেন, চে ধ উ দা বুঝবেন; সবই বুঝবেন এক সময়। কুনু টেনশন লৈয়েন্না।
আপনি তো 'কুনু টেনশন লৈয়েন্না' বলে আমাকে আরো টেনশনে ফেললেন । আমার কি আর বুঝবার বয়স আছে ? মনে হচ্ছে টেনশনে ঘুমাতেই পারবো না ।
এইটাও বড়বেলার একটা মজা। ছোটবেলাকার অনেক রহস্য বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হতে আরম্ভ করেছিলো বলে মাঝে মাঝে বয়স্কদেরও নির্বোধ মনে হয়েছে।
এখনো রসময়, আমাদের নাজমুল ভাই
কলুবাড়ি, পাতকুয়া, ঘানি গাছ, শব্দগুলো পুরোনো হলেও এপ্রজন্মের কাছে নতুন।
না রে ভাই, আপনার নাজমুল ভাইয়ের এখন অসময় (র সময় নয় মোটেই)।
মন্তব্য করুন