যুদ্ধের খেরোপাতা!
ছোটবেলা বাবা শোনাত অদ্ভুত সব গল্প। তার গল্পের ঝুড়ি থেকে ছড়িয়ে শব্দমালাগুলো আমার শৈশব কৈশোরের বড় একটা সময় মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে। কখনো মনে হতো যদি আমি হতেম দিগ্বীজয়ী হালাকু খাঁ তাহলে আমার পতাকা চীন ছাড়িয়ে আরও দক্ষিনে সম্প্রসারিত করতাম। যে আলেকজান্ডার ভারতবর্ষে এসে তার বিজয় রথ থামিয়ে দেয় আমি সেই ভারতবর্ষকে আমার রাজধানী। অথবা যদি হতেম সেই এলেন কোয়ার্টারমাইন, তাহলে তাহলে প্রেইরী অঞ্চলের সবুজ বুক চীড়ে জেগে উঠা পাহাড়ের গোপন গূহ্যদ্বার পেরিয়ে চলে যেতাম সেই চিরযৌবনের দেশে যেখানে মৃত্যু জরা ব্যাধী কখনো কাউকে ছিনিয়ে নেবে না।
আশ্চর্য্য হয়ে দেখি আমার সেই স্বপ্নমাখা দিনগুলো আজ স্বপ্নহয়ে সময়ের পড়তে মিলিয়ে গেলো। বাবার চোখে দেখা পৃথিবীটা একটু একটু করে পাল্টাতে পাল্টাতে পুরো যান্ত্রিকময়, রোমাঞ্চহীন একঘেয়েমীতে পরিণত হলো। মনে পড়ে একবার গিয়ে ছিলাম পুঠিয়ার প্রাসাদ দেখতে জীর্নশীর্ন হলেও প্রাসাদের সামনে থাকা বিশাল সবুজ মাঠ দেখে আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিলাম। সে মাঠে বসে শুনেছিলাম কিভাবে মোঘল সম্রাজ্যের বংশধররা তাদের সম্রাজ্য এখানে কিভাবে বিস্তার করে। মোঘল সম্রাজ্যের পতনের পর হিন্দু রাজারা এখানে রাজবাড়ি বানায়। আশে পাশে বানায় বিশাল বিশাল মন্দীর যেখানে শোভা পেতো টেরাকোটার মহা মূল্যবান মূর্তি সমূহ। সে আমলে অবশ্যই ব্যাংক ছিলো না, তাই রাজারা তাদের স্বর্নালংকার, মূল্যবান মনি মুক্তা সমূহ প্রাসাদের কোনো গোপন কুটুরীতে রেখে দিতো। বলা হতো এই প্রাসাদের নীচে আছে গভীর সুড়ঙ্গ যা দিয়ে প্রতিটা মন্দীরে রাজারা যাওয়া আসা করতো।
আস্তে আস্তে সব রাজারাই মারা যায়, তাদের সম্রাজ্যসমূহ মিইয়ে যায় সময়ের আবর্তনে। একসময় এলাকা বাসী রাজাদের সেই মহামূল্যবান গুপ্তধনের খোজে রাজবাড়ীর আনাচে কানাচে এমনকি মন্দীরের ভেতর লুটপার, খোদাই শুরু করে। কেউ কেউ পুরোনো কাগজে নকশা একে সেটাকে রাজার গুপ্তধনের গোপন রাস্তা বলে বিক্রিও করেছে। ভাবতে অবাক লাগে একসময় এই বাংলার প্রতিটা গ্রাম ছিলো স্বয়ংসম্পূর্ন। তারা নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য ফলিয়ে এতটাই উদ্বৃত্ত থেকে যেতো যে সেগুলো বিদেশী বণিকদের কাছে বিক্রি করে দিতো, সংগ্রহে রাখতো শৌখিন, বিলাসী সামগ্রীর সমাহার। সে সময় বহু আগের ঘটনা নয়, পৃথিবীর বয়স যদি ধরি কয়েকশো কোটি তাহলে এই তো কয়েকশত বছর।
এখন মানুষ মানুষকে কামড়ে খায়, না খেয়ে মরে অথবা বুভুক্ষ থেকে হাতে অস্ত্র নিয়ে আরেকজনের গা থেকে রক্ত ঝরিয়ে লুটে নেয় খাদ্য ক্রয়ের অবলম্বন। শুনেছি পুঠিয়ার প্রাসাদ সরকার বাচাতে অক্ষম বলে কলেজ বানিয়ে দেয়। বুদ্ধিটা খারাপ ছিলো না, শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা যে কতটা বেশী সেটা একজন স্কুল শিক্ষকের ছেলে হয়ে না বুঝার কথা নয়। বাবাকে খুব মনে পড়ছে, কেন যেনো সে মোঘল সম্রাজ্যের ভক্ত ছিলেন। অন্যদিকে মা সে রূপকথার ভক্ত। মাঝে মাঝে ভাবি এই শান্ত শিষ্ট মহিলা কিভাবে জানে একটা দৈত্য বা রাক্ষসকে বধ করবার ১০১ টা বুদ্ধি। ছোটবেলা যখন না ঘুমিয়ে পিট পিট করে জানালার ধারে বসে থাকতাম তখন মা ঘরে এসে কোলে শুইয়ে বলতো,"আয়, একটা গল্প শোনাই। এক দেশে ছিলো রাখাল, আনমনা, উদাস কিন্তু মাথা ভরা বুদ্ধি......"
তার প্রতিটা গল্প যেন এই দুনিয়ার গল্প ছিলো না, এখন যখন মাঝে মাঝে মনে পড়ে সেই তাল তলার পুকুড়পাড়ে লুকিয়ে থাকা খোক্ষসটার কথা মনে হয় এগুলো অন্য কোনো গ্রহ অথবা অন্য কোনো ডাইমেনশনের।
আর মাত্র ১২ দিন, মাইমুনা হাসপাতালে। শুনেছি ছেলে হবে। তার ছোট্ট ছেলের জন্য ঘর ময় এত খেলনা আর ওয়ার্ড্রব ভরা এত জামা যে নিজের জামা কাপড় নিয়ে আমার বের হয়ে যাবার জোগাড়। তাই কাজ শেষ করে আমি বাড়ি যাই না। ও হাসপাতালে, ডাক্তার কিছু বলছে না, কিন্তু মনে হয় কিছু একটা হয়েছে।
এই সুইডিশদের এক সমস্যা। দেখা গেলো রাস্তায় কোনো সুইডীশ গাড়ী উল্টে একসিডেন্ট করে হাত পা ভেঙ্গে বসে আছে, তখন যদি কেউ জিজ্ঞেস করে,"এই তুমি ঠিক আছো?"
সে একটা বিশাল হাসি দিয়ে বলবে,"আমি কখনোই এত ভালো ছিলো। আজকের দিনটা খুব সুন্দর। তোমাকে শুভ দিন।"
জানুয়ারীর ১৮ তারিখ ওর সীজারের ডেট থাকলেও প্রচন্ড ব্যাথার কারনে আগেই ভর্তি করিয়েছে। দরকার হলে আগেই অপারেশন করবে। আমার জন্য হাসপাতালের গেস্ট রুমে একটা কেবিনও দিয়ে দিয়েছে। বলছে রেডী থাকতে।
ওদিকে আমি স্পেন যাওয়াটা ক্যান্সেল করেছি। সোফিও স্পেন যায়নি। মাঝে মাঝেই আসে মাইমুনাকে দেখতে। মাইমুনা ওর সাথে এত পুটুর পুটুর কি কথা বলে কখনো জিজ্ঞেস করিনি। কিন্তু সোফি যাবার পর ওর হাসি মিলিয়ে যায়, আমার চৌদ্দগুষ্ঠির নাম তুলে শুদ্ধ বাংলায় গালি দেয়। ডাক্তার এসে মরফিন দেয়। ও ঘুমিয়ে যায়। দীর্ঘ ঘুম শেষ করে ও আর মনে করতে পারে না। শুধু কাঁদে কিছুক্ষন, তারপর আবার স্বাভাবিক। অদ্ভুত এক সময় চলছে ওর। কিছু খেতে পারছে না, প্রচন্ড ব্যাথায় আমার হাতটাকে এমন শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আমার হাতের পাতা চূর্ন হবার জোগাড়। কষ্ট হয়, তবুও কিছু বলি না। তাই মাঝে মাঝে ছোটবেলা শোনা মা এর সেই পুরোনো দিনের গল্পগুলো শোনাই আর ও চুপচাপ শুনে আর চোখ দিয়ে ঝরে পড়ে পানি।
ইদানিং ঠান্ডা ঠিক মতো পড়েনি। গত দু বছর ধরে আব হাওয়ার এক অদ্ভূত পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। প্রচন্ড ঠান্ডার দেশ সুইডেন থেকে শীত উধাও। শুনেছি উত্তর মেরুর বরফ গলে গেলে সাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে। বাংলাদেশ মালদ্বীপের মতো ছোট ছোট উপকূলবর্তী দেশের অধিকাংশ তলিয়ে যাবে পানির নীচে। তখন শুরু হবে এই মানবজাতীর খুবই কঠিন সময়। এই কঠিন সময়টা নাকি খুব বেশী দূরে নয়। আমার তাতে কিছু যায় আসে না, কারন আর কিছুদিন পর আমি নতুন অতিথির জন্য আমি আমার গল্পের ঝুড়ি খুলে বসবো। কখনো রূপকথা, কখনো মোঘল সম্রাজ্য, কখনো ভাইকিং দের পাগলামী। আমার মনে হয় নতুন অতিথিটার শিশুকালটা পুরোটাই স্বপ্নে ডুবে থাকবে!
মায়া মায়া লেখা।
সকলের মঙ্গল হোক..
লেখাটির প্রথম অংশটির সাথে দ্বিতীয় অংশটির সাযুজ্য খুঁজে পেলাম না। ভাষা প্রাঞ্জল তবে অনেক টাইপো।
চীড়ে>চিরে
ব্যাধী>ব্যাধি
মন্দীরে>মন্দিরে
আরো অনেক
আমার মনে হয় নতুন অতিথিটার শিশুকালটা পুরোটাই স্বপ্নে ডুবে থাকবে
ভাল লাগল
শুভ কামনা
মন্তব্য করুন