এতগুলো বিরক্তি
১.
বর্ষাকালে তখন ধানক্ষেতে হাটু পানি থাকতো। ডিঙ্গি নৌকায় করে মাছ ধরতে বেরিয়ে যেতো সবাই। বাশের মাথায় লোহার পেরেক গেথে জোরসে মাছের গায়ে গাথা হতো। যখন মাছটাকে কাটা বিদ্ধ অবস্থায় পানির ওপরে তোলা হতো তখন বড় বড় রুই কাতলা তাতে ছটফট করতো। বাসায় দিগ্বিজয়ী হাসি দিয়ে বলতাম,"মা, দেখো কি পেয়েছি!"
কিছু কিছু রোমাঞ্চ জীবনে আর ফিরে আসে না, সেই অনুভূতি মনের ভোল্টে অতি মূল্যবান সঞ্চয় হিসেবে জমা থাকে। মাঝে মাঝে সেই সঞ্চয় থেকে সুদ হিসেবে নস্টালজিয়া ধার করি, জটিল জীবনে থেকে নিজেকে আলাদা করে মুক্ত করি নিজের জন্য।
বহুদিন পর রাজশাহীতে পা দিয়ে বুঝতে পারলাম এ মাটির উষ্ঞতা এখনো মলিন হয় নি। এই উষ্ঞতা ততক্ষনাৎ ছড়িয়ে যায় দেহে মনে। আমার প্রতিটা পদক্ষেপে শরীর শিহরন ধরিয়ে দেয় আমার সঞ্চিত পুরোনো অতিতের নস্টালজিয়া। যদিও মানুষগুলোকে চিনি না, ঠিক যেনো পাল্টে গেছে প্রতিটা গলি, কত মানুষ।
মাকে কবর দিতে গিয়ে মোনাজাতটা যখন ধরলাম তখন কেন যেনো ভেঙ্গে পড়লাম। এমন সময় মনে হলো আমি এমন বিশাল কারো কাছে হাত পেতেছি যিনি সত্যি জানেন আমি এখন কতটা নিঃসঙ্গ, এতিম। এতিম হবার এক সর্বগ্রাসী বেদনা আমাকে চিবিয়ে ফেলছিলো, বুকের ভেতর থেকে এক হ্রাশ কান্নার সুনামী আমাকে ছাপিয়ে ফেললো। আমি হাটু গেড়ে ডুকড়ে কেদে ফেললাম। ঠিক সেই মুহুর্তে আমার কাঁধে হাত রেখে বলার কেউ ছিলো না,"তুমি একা নও, আমি আছি, আমরা আছি!" মাথাটা ঠিক তখন থেকেই খালি হয়েছিলো। ঢাকায় ফেরাটা অর্থহীন, এ এক যান্ত্রিক নগরী যেখানে বইছে দোজখের লু হাওয়া। একটা ন গরী ঠিক কিভাবে এমন করে ধ্বংস্তুপে পরিনত হয়ে গেলো বোঝাটা কষ্টকর। তবুও মানুষ থাকছে আর নগরীর হটকারীতে, বিষাক্ত ছোবল সবাইকে গিলে ফেলছে।
সেই ভেবে রাজশাহী চলে আসা, অতীতের সেই সুখ খুজতে আসা।
২.
মুখের বিশাল দাড়ি দেখে চিনতেই পারি না এ আমাদের আহসান। নিউমার্কেটে বেশ জমাটি শাড়ীর দোকান। সন্ধ্যা ৭-৮ টা তেই ও বেরিয়ে আসে। ওর বাসায় গিয়ে দেখি বিশাল সংসার। আংকেল আন্টি এখন বেচে।
: ঠিক কতো দিন পর দেখা হলো বলতো?
: ১২ বছর।
: আংকেল আন্টির কথা শুনেছি। তুই কি সুইডেনেই থেকে যাবি?
: তাবলীগ করে ব্যাবসা করার সময় পাস?
: আল্লাহর রাস্তায় সময় দেয়ার চাইতে বড় কিছু হতে পারে না। তুই দিয়ে দেখ, দেখবি সব দায়িত্ব সে নিয়ে নিয়েছে। এই তো দেখ, খারাপ তো নেই।
: কলোনীপাড়ায় একটা জায়গা দেখেছি। ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
: দেশটাকে তোরা যট খারাপ ভাবিস, এখনো অতোটা খারাপ নেই। আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখ। তোর কেসের ঝামেলা মিটে গেছে?
: ওহ! ঐ কেস! যারা করেছিলো তাদের নাকি ক্রশফায়ার হয়েছে। এখন আমাকে নিয়ে ভাবার কারো সময় নেই।
: শুকুরআলহামদুলিল্লাহ। একটা কথা বলি শোন। ফিরে আয়।
এমন সময় ভাবী খেতে ডাক দিলেন। ডাইনিং টেবিলে দেখি বিশাল আয়োজন। খিচুড়ী সাথে ডাল ভর্তা, বেগুন ভর্তা, আলু ভর্তা, শিম ভর্তা, মুরগীর ভূনা মাংস, বেগুন ভাজী, আচার আরও কত কি!
: আরে এত কিছু? এগুলো কি রোজ রাতের মেন্যু নাকি শুধু আমার জন্য?
ভাবী একটা মিস্টি হাসি দিয়ে বলে উঠলো,"আপনার বন্ধু কালকেই বাজার করে এনেছে। ভাইয়া হোটেল ছেড়ে দেন। বাসায় চলে আসেন। যতদিন মন চায় থাকেন। ওপর তলাটা খালিই পড়ে আছে। ও বলেছে আপনি নাকি থাকবেন।"
আমি বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,"কিরে! কি ব্যাপার? আমাকে রেখে দেয়ার প্লান কবে থেকে?"
: আগে শুরু কর। খেয়ে ঘুম দে। পরে এসব নিয়ে কথা হবে।
ভাপ ওঠা খিচুড়ি মুখে দিয়ে মনে হলো ব হুদিন পর সেই চেনা স্বাদ, কিন্তু প্রচন্ড ঝাল। আমার ঘাম ছুটে গেলো। শুধু খিচুড়ি না, সব খাবারই এসিডের মতো ঝাল।
: ভাই, খেতে পারছেন তো?
: একটু ঝাল, কিন্তু রান্না অসাধারন। মা থাকলে এভাবেই রাঁধতো।
: একটা কথা বলবো?
: অবশ্যই।
: আকবরকে নিয়ে চলে আসেন। মাইমুনার কথা ভেবে কি হবে? যে গেছে সে তো আর আসবে না।
আমি শুধু হাসলাম। বিগত ১ বছর আমার জন্য বিশাল এক ওলট পালটের বছর। আমি ছিলো লাগামবিহীন। আমার লাগাম টেনে ধরতে গিয়ে কেউ একটা বিশাল গন্ডগোল করে ফেলেছে। যার মূল্য দিতে হলো কাছের সবাইকে। যদি লাগাম টেনে না ধরতো তাহলে আজকে সবাই যার যার মতো বেচে থাকতো। সুখে থাকতো।
নাটকীয়তা জীবনে আছে, কিন্তু বিপর্যয় মেনে নেয়া কস্টের।
৩.
দু'সপ্তাহ পর ঢাকায় ফিরে আসি। টিকেট কেটে হোটেলে ফিরি। লবীতে গিয়ে দেখি মাইমুনার বাবা বসে আছেন।
: তুমি কি আজকে বাসায় আসতে পারবে?
: ফোন দিলেই এসে পড়তাম। শুধু শুধু এই বৃষ্টির দিনে কষ্ট করলেন।
: কষ্ট করতাম না যদি তুমি মানুষ হতে। সবকিছু কেড়ে নিলে আমাদের। তবু মাইমুনার দিকে তাকিয়ে...থাক, এসব বলে আর লাভ নেই। মাইমুনার মা তোমার সাথে কথা বলবে।
এই বলে উনি বেরিয়ে গেলেন লবি থেকে ৭০ এর কাছাকাছি এমন শক্ত সামর্থ মানুষ খুব দেখেছি। কন্ঠে এমন দৃপ্ততা নিয়ে কেন যে মানুষটা পুরান ঢাকার ভাগাড়ি নিয়ে পড়ে আছেন জানি না। ওনাকে শ্রদ্ধা করি ঠিক যে কারনে ওনার সামনে যখনই দাড়াই তখনই মনে হয় সে আমাকে আমার আয়নাটা খুব নির্দয়ভাবে তুলে ধরেন। নিজের আয়নার রূপ নিয়ে সন্দেহ থাকলেও যখন তার মুখে বর্ননাগুলো শুনি তখন মনে হয় আমি তাই। কঠোরতার মধ্যে সম্মোহনী শক্তি সবার থাকে না।
লবিতে চাবী নিতে গিয়ে রেসপশনিস্টের মেয়েটা একটা এনভেলপ ধরিয়ে দিয়ে বললো,"স্যার, আমাদের ম্যানেজম্যান্ট থেকে একটা গিফট!"
পিংক রঙ্গের এনভেলপটা হাতে নিয়েই মনের মধ্যে বিশাল লোভ জাগলো। এনভেলপ খুলতে খুলতে লিফটে ঢুকে গেলাম। টেম্পটেশন নাইটের ইনভাইটেশন, হোস্টেস নাতাশা, সন্ধ্যা ৮ টা থেকে এন্ট্রি তাও আবার সেদিন রাতে। সাথের লিফলেট দেখে মনে হলো জন্জ্ঞালের এই নগরীর রাত যে এমন চাকচিক্য লুকিয়ে রেখেছে জানা ছিলো না।
৪.
: আকবর ওখানে কার কাছে?
: নার্স আছে। ওর বয়সী কাউকে মা ছাড়া প্লেনে এলাউ করে না।
: বুকের দুধ ছাড়া বাচবে কেমনে? আল্লাহ জানে কার না কার কি খাওয়ায়? বাবা, মাইমুনার কথা খুব মনে পড়ে। আকবররে দেখার খুব ইচ্ছা। একবার দেখার ব্যাবস্হা করো।
: আম্মা, আমি চাচ্ছিলাম আপনাদের ওখানে যাওয়ার ব্যাবস্থা করি। মাস তিনেকের জন্য। আপনারা দেখে যান। যতদিন ও বড় না হয়, আমি একটা ব্যাবস্থা করলাম।
: ওর বাবা কি রাজী হবে? তুমি কি এখনো মদ খাও?
আমি কোনো উত্তর দেই না।"আম্মা আজ উঠি। প্যাকিং করতে হবে। রাজশাহী থেকে ফিরে আমি ক্লান্ত। পরশু ফ্লাইট। আপনি আমাকে জানান।"
মাইমুনার মা মাথা নীচু করে কাঁদতে লাগলেন। বাবা একটু দুরেই সোফায় বসে খবর দেখছিলেন টিভিতে। চোয়াল শক্ত, চোখের দৃষ্টি স্থির।
: বাবা, আমি যাচ্ছি!
: আল্লাহর কাছে একটাই প্রশ্ন, কেন এই জানোয়ারটাকে নিলো না? আমার ফুটফুটে মেয়েকে কেড়ে নিলো।
পেছন ফেরে ফুপিয়ে কান্নার মহোৎসব শোনার মতো মানসিকতা নেই। মোবাইল চেক করে দেখি ৯:৩০ টা। হোটেলে ক্যাবে যেতে সময় লাগবে না। ঢাকার রাতের চাকচিক্যময়তা খুব একটা দেখা হয়নি! মনের অবষন্নতা দ্রবীভূত করার জন্য শক্তিশালী কিছু দরকার আমার!
seriously??? so sorry to hear that, may Allah bless them with heaven and give you the strength of overcoming the grief
মা’র জন্য পরম শ্রদ্ধা। আল্লাহ্ তাকে যেন ভালো রাখেন। আকবরের জন্য ভালোবাসা।।
আল্লাহ আপনাকে শোক সইবার শক্তি দিক।
গভীর সমবেদনা
এমন একটা পোস্টে কি মন্তব্য করতে হয় আমি আসলে জানি না শুধু কেন যেন মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল
ধন্যবাদ সবাইকে।
মন্তব্য করুন