মৌমাছিদের যুদ্ধ
খুব ছোটবেলা থেকেই আমাদের ঘর পাঁকা ছিলো না। গ্রীস্মের প্রচন্ড দাবদাহে যখন মাটিতে পা রাখা দায় হতো তখন মা মেঝে লেপে দিয়ে পাটি বিছিয়ে দিতেন। সে পাটিতে পিঠ যখন এলিয়ে দিতাম তখন এক অদ্ভুত শীতলতা শরীরময় ছুয়ে যেতো। চোখের দৃষ্টিতে ঝুলে থাকা টিনের চালের নীচে কাঠের পাটাতনকে মনে হতো রাতের তারা ভরা নীল আকাশ। আমি ধুমকেতু হয়ে নাম না জানা তারাদের দেশে ঘুরে বেড়াই। সেখানে আছে দৃষ্টি সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া তেপান্তর।
বর্ষা আসি আসি করে এমন সময় বাবা নিজ হাতে নতুন মাটি লাগাতেন। পুরোন মাটির ওপর নতুন মাটি লাগতে চাইতো না। কখনো কোনা থেকে মাটি খসে পড়তো অথবা গরমে নতুন মাটি চলটা ধরে উঠে যেতো। বাবা স্কুল থেকে এসে সেগুলো সযত্ন করে ঠিক করতেন। মঙ্গলবারে হাট বসলে বাবা বাড়ির পাশে বুনে দিতেন বিভিন্ন জাতের গাছ। আমাকে শেখাতেন কিভাবে মাটি খুড়তে হয় কিভাবে চারা থেকে কাগজের মোড়ক ছাড়িয়ে লাগাতে হয় সযতনে। মার সাথে মাঝে মাঝেই এটা নিয়ে বনিবনা হতো। জিজ্ঞেস করতো বাড়ির পাশে কড়ই গাছ লাগালে কিভাবে উঠোনে ছা্যা পড়বে, কিভাবে কাপড় শুকোবে? বাবা হাসি দিয়ে বলতো এগুলো গাছ নয়, এগুলো আমাদের পরিবারের সদস্য। এরা ছায়া দেবে গরমে আবার রোদ কমে গেলে নিজেরাই পাতা ঝরাবে। মা এসব কথা বুঝতো না। মা ব্যাস্ত হয়ে যেতেন নতুন ওলের সোয়েটার বুননে, আমার জন্যে।
আকবরের দিকে আনমনে চেয়ে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা। নেশা লাগা ঘোর থেকে নিজেকে ছাড়ানো মুশকিল হয়ে যায়। এতটা নিস্পাপ সৌন্দর্য আমি দেখিনি, এতটা শান্তি কাউকে উপভোগ করতে দেখিনি। এরকম শান্তি সুখী সময় হয়তো আমিও উপভোগ করেছিলাম বেশ বড় সময়ের জন্যে কিন্তু আমি ভুলে গেছি। ঘরের জানালা খুলে দেখি মানুষ দৌড়াচ্ছে প্রতিটা দিকে। রাস্তা মেপে অনেকে ফিরে আসলেও কেউ কেউ ফিরে না। সবার যুদ্ধংদেহী মনোভাব একটা কথাই মনে করিয়ে দেয় সেটা হলো সবাই কিছু না কিছু জিনিসে স্বাধীনতা চায়। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য সে বিসর্জন দেয় ঈশ্বরপ্রদত্ত জীবনটা উপভোগ করার স্বাধীনতা, এই বিশাল মহাবিশ্বটাকে নিজের জীবন ধারন করার অবলম্বন বানানোর স্বাধীনতা।
মাইমুনার দিকে তাকালে মনে হয় নিতান্ত ছোট্ট দুনিয়া বেচে থাকা সুখী একটা মেয়ে। যার চাহিদা মিশে আছে আকবরের হাসিতে, আমার সাথে খুনসুটিতে। আমাকে শাসন করাতে সে পৈশাচিক আনন্দ পায়, যখন কাজে যাই তখন ঠিকই বুঝতে পারি সে আর আমার মা দল বেধে বুদ্ধি করে এসব কান্ড করে আমাকে শাসনে রাখে। আমি জানি তবুও কিছু বলতে পারি না। মা কিছু দিন হলো ওদের মা বাবার সাথে উঠে গেছে। নিতান্ত একা সে মহিলা, শুধু এই একটা ধাধা কখনোই বুঝতে পারলাম না আদতে সে সুখী হতে পেরেছে কি?
জীবনের কিছু দিক যেনো আমি কখনোই বুঝতে পারিনি, মানুষের সুখী হওয়া খুব বড় কিছু অনষঙ্গের ওপর কখনোই নির্ভর করে না। যদিও কিছু কিছু সময় তা অনুঘটকের মতো কাজ করে বৈকি। দিনভর অক্লান্ত পরিশ্রম করেও সে ক্লান্ত হবে না যদি না নীড়ে ফেরে সে একটু শান্তির ছোয়া পায়। আজও অজস্র মানুষ, রিক্সাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা ধরতে গেলে বিনামূল্যেই নিজের শরীরটাকে যন্ত্রে মতো নীংড়ে গাধার খাটুনি খাচ্ছে। তা দিয়ে হয়তো নিজের আহার জোটানো মুশকিল, সংসার তো আরও কঠিন। দক্ষিনবঙ্গের কোনো জেলাতে যখন পা দেই তখন আমি কখনোই এসব রিক্সাওয়ালা ঠেলাওয়ালাদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করি না। কারন এরা দিনের বেলা মাটি কামড়ে সমাজের যেকোনো অপরাধ নির্যাতন স হ্য করে। যখন সন্ধ্যা নামে, তখন তাদের রূপ পাল্টাতে থাকে। রাতের আধারে তারা বনে যায় বুনো পশু। হত্যা, খুন, গুম, ধর্ষন সবকিছুই হয়, কিন্তু কারা করেছে কেন করেছে কেউ জানে না। দশকের পর দশকের আমরা সমাজের উপরের শ্রেনীরা এমন ভয়ংকর নিম্ন বর্গ তৈরী করেছি। তারা জানে মনের দয়ায় ৫ টা টাকা বেশী দেয়াটা তাদের জীবন বদলাবে না। আজ যে হাতে ৫ টাকা দিলাম, কাল হয়তো এমন ১০ টা হাত দিয়ে তার শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নেবো, তার সামনেই তার স্বপ্ন গুলোকে না খাইয়ে হত্যা করবো। তারা এগুলো জানে বলেই এটেল গড়নের সুঠাম শরীরে তাদের হিংস্রতার প্রমান দেয়।
আমি জানালাটা বন্ধ করে দেই, জানালা দিয়ে ইদানিং খুব নৃশংস পৃথিবী আমার চোখে ধরা দেয়। যুদ্ধ আজ খুব দূরেও নয়। ওপেনহাইমার বলেছিলো তারা এমন এক বোমা বানাবে যে কিনা সকল যুদ্ধের ইতি টানবে, কিন্তু তিনি ভুল ছিলেন। দেশগুলো আর যুদ্ধ করে না আজ যুদ্ধ করে প্রতিটা মানুষ প্রতিটা পরিবার। কিছু কিছু যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে গোত্রের মধ্য দিয়ে পুরো জাতিতে, কিছু কিছু যুদ্ধ যেনো নিজের ছোট দুনিয়াতেই ঘুরপাক খায়।
"ওয়ে আকবর! তোর যুদ্ধটা কি নিয়ে হবে?"
আকবর চুপটি করে ঘুমিয়ে আছে মুখে একটা চুষনি নিয়ে। আমি আমার স্বপ্নের ভাবালুতায় দেখতে থাকি আকাশটা ছোট বলে তারা যুদ্ধ ঘোষনা করেছে পাখিদের বিরুদ্ধে। আর পাখিরা তাদের যুদ্ধে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছে মর্ত্যে থাকা তুষার মানব আর বিদ্ঘুটে খোক্ষসের কাছে। আর গান গাওয়া গাছেদের বন যেখানে একসময় পাখি আর মৌমাছিগুলো একসময় সুখে দুখে এক সাথে ছিলো, আজ আগুনে পুড়ছে!
লেখাটা ভালো হইছে..
মন্তব্য করুন