দেবযানী ও জ্যোতি
কচের বিদায়ের পর সময় থেমে থাকেনি, থেমে থাকেনি দেবযানীর জীবনও। সময়ের প্রলেপ পড়েছে দেবযানীর আহত হৃদয়ে। সেই দুঃসহ সময়ে দেবযানীর সঙ্গী ছিলো অসুর রাজ ভৃষপ্রভ কন্যা রাজকুমারী শর্মিষ্ঠা। কোন এক পড়ন্ত সকালে দেবযানী ও শর্মিষ্ঠা জলকেলী করার জন্য রাজপুরীর সরোবরে গেল। শর্মিষ্ঠা ও দেবযানী তাদের পোষাক-পরিচ্ছদ শুকনো জায়গায় রেখে দুজনে জলে নামলো এবং বিভিন্ন জলক্রীড়ায় নিজ নিজ নৈপূণ্য প্রদর্শন করতে লাগলো। এমন সময় আচমকা ঝড়ো হাওয়ায় তাদের পোষাক উড়িয়ে নিয়ে একটু দূরে ফেললো। তারা দুজনে যখন দৌড়ে গিয়ে পোষাক পরলো তখন তাড়াহুরোয় একটা ভুল হয়েগেল রাজকুমারী ভুল করে দেবযানীর পোশাক আর দেবযানী রাজকুমারীর পোশাক পড়ে ফেলল।এই নিতান্ত কৌতুককর ব্যাপারটা রাজকুমারী শর্মিষ্ঠাকে উত্তেজিত করে তুললো, কে জানে হয়তো রাজকুমারীর পোষাকে দেবযানীকেই বেশি মানাচ্ছিল অথবা নিছকই রাজরক্তের গরিমায় রাজকুমারী ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো দেবযানীর প্রতি। সে অকথ্য ভাষায় দেবযানীকে গালাগালি করতে লাগলো তার পোষাক পড়ে রাজকুমারী সাজার হীন চেষ্টার জন্য। তুমি কি জান না তোমার বাবা আমার বাবা রাজা বৃষপ্রভের অন্নে প্রতিপালিত একজন ভিক্ষুকমাত্র তুমি কোন স্পর্ধায় রাজকন্যার পোষাক এ হাত দিলে শর্মিষ্ঠার একথায় শুক্রাচার্য্যের অপমানে দেবযানী নিজেও অপমানিত ও দুঃখিত বোধ করলো কিন্তু দেবযানীর আহত দৃষ্টি শর্মিষ্ঠার রাগ প্রশমিত করতে পারলো না বরং তার ক্রোধ উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগলো এক সময় ক্রোধাণ্বিত শর্মিষ্ঠা দেবযানী কে শারিরীক ভাবে আঘাত করতে লাগলো ও তাকে ধাক্কা দিয়ে এক জলকূপেফেলে দিল। দেবযানী মৃত ভেবে শর্মিষ্ঠা রাজপ্রাসাদে ফির গেল।
কূপে পড়েও দেবযানী মারা যায় নি কিন্তু সে একা একা কিছুতেই কূপ থেকে বের হতে পারছিলো না তাই সেই কূপে বসেই চোখের জল ফেলছিলো। এমন সময় ভরতবংশীয় ক্ষত্রিয় রাজা সুদর্শন জ্যোতি সেই বনেই শিকারে এসেছিলেন। তৃষ্ণার্ত জ্যোতি জলের খোঁজ করতে গিয়ে সৌভাগ্যক্রমে চলে আসেন সেই কূপের সামনে যেখানে ছিল দেবযানী। কূপের মধ্যে অনিন্দ্যসুন্দর দেবযানীকে দেখতে পেয়ে বিভ্রান্ত জ্যোতি তার পরিচয় জানতে যায়। দেবযানী জানায় সে শুক্রাচার্য্যের কন্যা, শুক্রাচার্য্য জানে না সে এই কূপে বন্দী হয়ে পড়েছে। দেবযানী তার ডান হাত বাড়িয়ে জ্যোতিকে অনুরোধ করে তাকে এই কূপ থেকে মুক্ত করতে। জ্যোতি তাকে টেনে তোলে।
দেবযানীর কোন ইচ্ছে ছিলো না অসুররাজ্যে ফিরে যাবার। সে স্বচ্ছন্দ বোধ করছিলো না শর্মিষ্ঠার বাবার রাজ্যে এবং শর্মিষ্ঠার সাথে তার কথোপকথন মনে করে তার হৃদয় বিতৃষ্ণায় ভরে উঠছিলো তাই সে জ্যোতির সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হবার বাসনা প্রকাশ করে। কিন্তু "মহারাজ তুমি এক কুমারী কন্যাকে ডানহাত ধরে টেনে তুলেছো তাই আমি মনে করি সর্বান্তকরণেই তুমি তার স্বামী হবার দাবীদার, আমাকে গ্রহন কর" - দেবজানীর এই প্রস্তাব জ্যোতি দুঃখিত চিত্তে নম্রভাবে প্রত্যাখ্যান করে "হে দেবী তুমি একজন ব্রাহ্মণ কুমারী আর আমি একজন ক্ষত্রিয় পুত্র, আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারি না, আমি তোমার যোগ্য নই। পিতৃগৃহে ফিরে যাও দেবী" - এই বলে দেবযানীকে একা রেখে জ্যোতি তার রাজ্যে চলে যায়। দেবযানীর ফিরে যাবার কোন ইচ্ছে ছিলো না তাই সে সেই কূপের কাছেই এক গাছের নীচে বসে কাঁদতে থাকে।
অন্যদিকে দীর্ঘক্ষণ দেবযানীর ফেরার অপেক্ষায় থেকে চিন্তিত শুক্রাচার্য্য তার এক অনুচরকে পাঠায় দেবযানীর খোঁজে। অনেক কষ্টে সেই দূত দেবযানী কে খুজে পায় কিন্তু দেবযানী ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানায়, সে বলে তার ছায়াও পড়বে না বৃষপ্রভর রাজধাণীতে।
দূতের বার্তাপেয়ে শুক্রাচার্য্য দেবযানীর কাছে এসে তার সব কথা শুনে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে এবং তাকে ফিরিয়ে নিতে চায় কিন্তু দেবযানী জানায় যেখানে তার পিতাকে ভিখারী বলাহয় সেখানে সে কখনোই ফিরে যবে না। শুক্রাচার্য্যও স্থির করেন সেও আর অসুর রাজ্যে থাকবেন না। শুক্রাচার্য্য বৃষপ্রভাকে বলেন মহারাজ আপনার কাছ থেকে আমি সবসময় যথোপযুক্ত সম্মাণ পেয়ে এসেছি কিন্তু রাজকুমারীর আচরণে দেবযানী অত্যন্ত অপমানিত বোধকরেছে সে আপনার রাজ্যে থাকবে না এবং তাকে ছাড়া আমিও থাকতে পারবো না তাই আমি বিদায় নিতে এসেছি, আমার অপারগতা ক্ষমা করবেন। শুক্রাচার্য্যের অসুর রাজ্য ত্যাগের ঘোষণায় বৃষপ্রভ খুবি বিমর্ষ ও চিন্তিত হয়ে পরেন, বৃষপ্রভ বলেন আমি আমার কন্যার ব্যাবহারে দুঃখিত আপনি যদি আমাকে ত্যাগ করেন আমি নিজেকে আগুণে বিসর্জন দেব কিন্তু তার এই কথা শুক্রাচারয্যকে দমাতে পারে না কারন পৃথিবীর যেকোন কিছুর চেয়ে দেবযানী শুক্রাচার্য্যের কাছে বেশি প্রিয় ছিল অসুরদের ভাগ্যের চেয়ে দেবযানীর দুঃখ তাকে বেশি বিচলিত করে তুলেছিল তাই সে বৃষপ্রভকে জানায় আপনি যদি দেবযানীকে বোঝাতে পারেন ভালো নাহলে আমাকে বিদায় নিতেই হবে।
অসুররাজ তার পারিষদবৃণ্দকে নিয়ে দেবযানীর কাছে ক্ষমা চাইলে দেবযানীর রাগ কিছুটা কমে এবং সে অসুররাজ্যে থেকে যেতে রাজি হয় কিন্তু এক শর্তে তার যেখানে বিয়ে হবে সেখানে শর্মিষ্ঠাকে পরিচারিকা হিসেবে যেতে হবে। সব কথা শুনে শর্মিষ্ঠা তার ভুল বুঝতেপারে এবং নিজরাজ্যের মঙ্গলের জন্য দেবযানীর কথায় রাজি হয়। দেবযানী পিতৃগৃহে ফিরে যায়।
কিছুদিন পর দেবযানী আবার জ্যোতির সাক্ষাৎ প্রার্থনা করে এবং জানায় সেইদিন থেকে সে নিজেকে জ্যোতির স্ত্রী হিসেবেই জানে কিন্তু জ্যোতি তার নিজের কথায় অনড় থাকে কারন সাশ্ত্রমতে একজন ব্রহ্মণ পুত্র ক্ষত্রিয় কন্যাকে বিয়ে করতে পারে কিন্তু ক্ষত্রিয় পুত্র ব্রাহ্মণ কন্যাকে বিয়ে করতে পারেনা কিন্তু দেবযানীর পুণপুণ অনুরোধে জ্যোতি দেবযানীকে গাণ্ধর্ব মতে বিয়ে করে এবং বিয়ের পর আশীর্বাদের জন্য শুক্রাচার্য্যের কাছে যায়। এটাই সম্ভবত মহাভারতের প্রথম অসমবর্ণ বিবাহ। যদিও এই বিয়েতে শুক্রাচার্য্য খুশি ছিলেন না তবুও তিনি এ বিয়ে মেনে নেন কারণ একবার বিয়ে হয়ে গেলে সেটা ভাঙার কোন নিয়ম তখন ছিলো না। এর পর জ্যোতি এবং দেবযানী সুখে কালাতিপাত করতে থাকে কিন্তু সুখ ক্ষণস্হায়ী। দেবযানীর পরিচারিকা হয়ে শর্মিষ্ঠা এসেছিলো দেবযানীর সাথে আর শর্মিষ্ঠা একদিন জ্যোতিকে অনুরোধ করে তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে। শর্মিষ্ঠার রূপে মুগ্ধ জ্যোতি দেবযানীর অগোচরে শর্মিষ্ঠাকে গোপণে বিয়ে করে কিন্তু এই ঘটনা গোপণ থাকেনি । ক্রুদ্ধ দেবযানী তার বাবার কাছে অভিযোগ করলে শুক্রাচার্য্যের অভিশাপে জ্যোতি অকাল বার্ধক্য বরণ করে।
অকাল বার্ধক্যে আক্রান্ত জ্যোতি দেবযানীকে স্মরণ করিয়ে দেয় তাদের একসাথে থাকা সুখের সময়ের কথা, কূপথেকে তাকে টেনে তোলার কথা এবং অভিশাপ ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ জানায় কিন্তু অভিশাপ ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষমতা শুক্রাচার্য্যের ছিলো না তাই তিনি জ্যোতিকে বলেন যদি কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজের যৌবন তোমার বার্ধক্যের সাথে বদল করে তবেই কেবল মাত্র তুমি তোমার হারানো যৌবন ফিরে পেতে পার। জ্যোতি একে একে তার চারছেলেকে তার এই দূরাবস্থার কথা জানয় ও তদের কাছে অনুরোধ জানায় তাদের যৌবন এর বদলে পিতার বার্ধক্য ধারণ করতে, সে কথা দেয় অল্পকিছু সময় পরেই সে আবার তার বার্ধক্য ফিরিয়ে নেবে এবং যে তার বার্ধক্য কিছু সময়ের জন্য ধারণ করবে সেই হবে ভবিষ্যৎ রাজা। কিন্তু তার চার ছেলের কেউ ই রাজী হয় না অবশেষে তার পঞ্চম ও কণিষ্ঠ পুত্র পুরু তার বাবার প্রস্তাবে রাজি হয়। দীর্ঘদিন পুরুর দেয়া যৌবন সম্ভোগ করার পর জ্যোতি প্রতিশ্রুতি মত পুরুর যৌবন তাকে ফিরিয়ে দেয় এবং পুরুই হয় জ্যোতির সম্রাজ্যের উত্তোরাধিকারী।
চমপ্রদ রূপকথাগুলোর মধ্যে কিন্তু চিরচারিত মানব মনের বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।
এই গল্পটা মহাভারতের আর মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনী জুড়েই আছে জটিল মনঃস্তত্বের খেলা; আমার পোস্ট পড়ে আসলে কেউ মূল কাহিনীর ১০ ভাগ রস ও উপভোগ করতে পারবে না
আহারে যৈবন!
আজকের পোস্টের মোরাল কই?
এসো নিজে করি :
আজকের আলোচ্য গল্পের মোরাল (মোরালগুলো ) কী বলতো বাবুরা
এই সিরিজটা ভাল হচ্ছে। চালাইয়া যান।
ধন্যবাদ মাসুম্ভাই
দারুন হইতেছে। তবে টাইপো গুলি কহিয়াল কৈরা।
কপাল!!! কহিয়াল = খিয়াল
টাইপো গুলো যেগুলো চোখে পড়লো সেগুলো ঠিক করেদিলাম কিন্তু বানান ভুলগুলো তো রয়েই গেল কেউ ভুল ধরে দিলে ঠিক করেদিতে পারতাম
পড়িলাম। জ্ঞান বাড়িল।
জ্ঞান বেশি বাড়লেআবার অজ্ঞান হয়ে যাবার ভয় থাকে কিন্তু
সময় নিয়া সিরিজটা পুরা পড়তে হবে। একসাথে পড়ুম। আপাতত ঢু দিয়া গেলাম।
একচুয়েলী এই দেবযানীর গল্প এখানেই শেষ
আহা.. কত কাহিনি
হ
একেবারে মহাভারত সামারি...এই পর্বে কি শিক্ষা আছে সেটা কিন্তু বিবাহিত পুরুষেরা স্বীকার করবে না
মহাভারত সামারী না কোনভাবেই ; কয়েক টা গল্প জাস্ট আপনাদের সাথে শেয়ার করতেসি
কাঁকনের সাম্প্রতিক আগ্রহের বিষয় বোঝা গেলো। বেশ ভালো কাজ হচ্ছে।
কেমন আছো?
ধন্যবাদ আপু; আছি ভালোই; শুধু আপনার অভাবে কানু গ্রুপ কানা হয়ে যাইতাসে
আমি প্রতিটি গল্প খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। অনেক আগের পড়া, স্মৃতিতে অনেক ধূলো জমেছিল, সেগুলোতে শান দিচ্ছি।
একদম অন্যরকমের লেখা পড়তে খুব ভালো লাগছে। কাঁকন সম্ভব হলে বেহুলা লখীন্দর এগুলোতেও হাত দিও।
বেহুলা লখীন্দর ছোট বেলায় পড়ছি আপু ভালো মনে নাই আর এইটা নেটে পাওয়াও যায় না
আহারে সামুর মত গোল্লা দেয়ার উপায় নাই!
কাঁকনা, জ্যোতি নাতো তার নাম যযাতি!
তুমি দেখ্লাম আরো একটা পোস্টে তারে জ্যোতি বৈলা লিখসো। মহাভারতে অসবর্ণ বিয়েও এইটাই প্রথম না। শকুন্তলা বামুন, ওর জামাই রাজা মানে ক্ষত্রিয়।
তোমার সাইন্স ফিকশন মিস করি। তোমারেও।
ইতি
আমারনিক
মন্তব্য করুন