ইউজার লগইন

শরতের সরোদ

শরতের সরোদ

-শাশ্বত স্বপন

‘তুমি যাবে ভাই-যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়...।’

ভরা যৌবনের জলতরঙ্গে শরতের কোন এক পড়ন্ত ভাদ্র বেলায় কবি জসিম উদ্দিনের নিমন্ত্রণের ডাকে সারা দিয়ে আমার হাত ধরে উপমা বলেছিল, শুনেছি তোমার গ্রামকে বড় ভালবাস তুমি; ছবির মত ছায়া সুনিবিড় তোমার গ্রাম; এ দেশের গ্রাম দেখা হয়নি আমার কোনদিন; দেখিনি ধান-পাট-শষ্যে ক্ষেত; দেখিনি ডোবা-নালা-খাল-বিল-বাওর-হাওর-নদী-সাগর; দেখিনি প্রকৃতির পাহাড়-ঝরণা-ছড়া-মেঘ-কুয়াশা-নদী আর রহস্যময় পাহাড় ঘেরা অপার সৌন্দর্যের পাহাড়ি ভুমি। আমায় তুমি নিয়ে চল সখা, তোমার যেখানে খুশী-তোমার চোখে দেখব আমি শরতের শাশ্বত রুপ।

উপমা গোমেজ আমার ছোট বেলার খেলার সাথী, এক সাথে স্কুল, কলেজে বড় হয়ে উঠা--এক সূতায় বাঁধা দু’টি কবিতা। জোড়া কবিতা মিলে এক গদ্যের কাহিনী হবার আগেই তাদের পুরো পরিবার স্বপ্নের এক দেশে প্রবাসী হয়ে যায়। তারপর দু'বছরে এক কি দুইবার মাটির টানে দেশে মানে ঢাকা আসা। আমার পিতা মরহুম নাসির রহমান ছোট্র এক চাকুরীর সুবাদে অনেক বছর আগে বিক্রমপুর থেকে ঢাকা আসে। তেজগাও এলাকায় পাশাপাশি দু’টি মহল্লায় আমরা থাকতাম। আমাদের গ্রামটি সুন্দর হলেও আমাদের বসতির অবস্থা অতি করুন। তাই ওকে কোনদিন গ্রামে নিয়ে যাইনি। কিন্তু গ্রামের গল্প বলেছি বহুবার। পূর্ব পুরুষ থেকেই ওরা ঢাকার তেজগায়ের স্থায়ী বাসিন্দা।

এইবারই প্রথম ওকে আমার গ্রামে নিয়ে যাওয়া। শুরুতেই সদ্য বিদায়ী বর্ষার গল্প দিয়ে আরম্ভ করলাম--বিরামহীন মুসলধারে বৃষ্টি প্রকৃতির ডোবা-নালা-খাল-হ্রদ-নদী-বিল-বাওর-হাওর-সমুদ্র জলধারাকে বর্ষা কিভাবে কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে; কিভাবে গ্রাম বাংলার তৃষিত ভূমি, তৃষ্ণার্ত প্রকৃতিকে জলদানে করে পরিতৃপ্ত ও শান্ত। প্রকৃতির মাঠ-ঘাট বর্ষাকালে পূর্ণ গর্ভধারণ করে কিভাবে মাতৃমমতায় শত শত সহস্র কোটি সন্তানতুল্য শষ্যদানায় মাঠ-ঘাট ভরিয়ে দিয়ে জেগে উঠে শরতে, তোমাকে এবার দেখাব। যাওয়ার পথে দেখালাম উজানের স্রোতে ভেসে আসা সর্বহারারা জল-কাঁদা মাখা রাস্তার দু’পাশে পোকা-মাকড়ের বসতি ভেঙ্গে জেগে উঠা ভিটায় ছুটে চলেছে।

গায়ের মেঠো পথে চলতে ওকে দেখালাম -- শরৎ কালে বৈঁচি, বাঁশ, নিম. কুঁচলতা, শেয়াকুল কাঁটা, উলুখড়ের সাদা ফুল, কলমি, গাঁদামনি, বৌ-টুনটুনি, পুনর্বা, ক্ষুদে ননী, নাটাকাঁটা, গোয়ালনটে, সাদানটে কতনা বীরৎ, লতাগুল্ম আর সোঁদালী গাছের বনঝোপে ভরে উঠে না চষা মাঠ। সাপ, ব্যাঙ আর পোকামাকড় আর মরাকদমের ফুল মাড়িয়ে বেগুনী রংয়ের কুমুদফুল অথবা বনসিমফুল তুলে এনে ওর হাতে দিতে এ ভরা যৌবনে কতনা ভাল লাগে! নৌকাপটু মাঝি আমি--বাবলা, যজ্ঞিডুমুর, পিটুলী, নটকান গাছের তলায় হিজল গাছের সাথে বাঁধা ডিঙ্গী নিয়ে ওকে নিয়ে ছুটলাম, মন যেদিকে চায়। ডিঙ্গী চলে কলমীর গন্ধভরা সরু খালে-নদে-উপনদে-শাখায়-উপশাখায়। বিলের ফাঁকে ফাঁকে বাবলা গাছ আর বক ফুল গাছ থেকে ফুল টুপটাপ ঝরে পড়ে জলের উপর। বিলের ফুটন্ত শাপলা আর পদ্ম ফুল দুজনার উপস্তিতিতে যেন পূজার অর্ঘ্য হয়ে পায়ে এসে পড়তে চায়। তুমি যেন জল দেবী! একথা শুনে তুমি আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবলে।

নিস্তরঙ্গ জলরাশি¬--দু’পাশে সারি সারি সাজানো কাশবাগান--নির্মল আকাশ--জলে নীল আকাশের ছবি--সাদা মেঘের কাঁচুলী নগ্ন আকাশের বুক ঢেকে আছে। আকাশের নীলাভ নরম বুকে কখনও কখনও খন্ড খন্ড কিছু মেঘ পাহাড় অথবা শাখামৃগের মত মনে হয়। সন্ধ্যায় জোনাকীর নিভু নিভু প্রদীপ--ঝিঁ ঝিঁ পোকার অবিরাম ডেকে চলা--ছলাৎ করে জেগে ওঠা দু’একটা জলঢেউ যেন, হৃদয় ছুঁয়ে যায়। উপমা আমার সাথে থাকা সত্ত্বেও মনে হয়, কেউ আমার সাথে নেই। সৌখিন মাঝি, সৌখিন জেলে অথবা বিকালটুকুর সৌন্দর্য ভাগ করে নেওয়া অতিথি মানুষগুলো অথবা শেষ বিকালের ঘরে ফেরা পাখিরা জলপোকা মুখে নিয়ে উপভোগ করে জলডাঙ্গার জলবেষ্টিত দোয়াল্লীর চরের প্রকৃতি। জলাঙ্গীর স্নিগ্ধ ভেজা বাংলার লালিমা মাখা গোধূলীবেলায় বলাকারা সারা দিনের কর্মক্লান্তি নিয়ে নীড়ে ফিরে যায়। আঁধার নামে ধীরে ধীরে, দিগন্তে ঘুমাতে যায় ক্লান্ত সূর্য। বাঁকা চাঁদ সূর্যের আলো ধার করে রাখে দিনের বেলা; রাতে জোৎস্নায় ভরে দেয় জল আর কাঁশফুলে ঘেরা মাঠ, ঘাট আর গল্পে ভরা আঙিনা। রাতে লক্ষ্মীপেঁচা ডাকে শিমুলের ডালে অথবা নিমপেঁচা বসে থাকে নিমডালে। এমনি শরতের পূর্ণিমার রাতে যদি দুজনে চাঁদের বুড়ীর কাছে বেড়াতে যেতে পারতাম। গায়ের জলপথে ধীরে ধীরে নেমে আসে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক আধার প্রকৃতিকে করে আরো ভীত সন্ত্রস্ত। যেন, স্বপ্নের হাত ধরে কৃষ্ণপক্ষের রাত্রির এই অন্ধকারে অনন্তের পথে দু’জনে চলেছি শরতের এই জল পথ ধরে। জল পথের ফাঁকে ফাঁকে জেগে উঠা খালের দুপারে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত। হয়তো বনপোকা, ইঁদুর-শিয়ালের গর্ত।

পরদিন আবার শরতের বুকে পথ চলাঃ শ্রাবনে ও শ্রাবনের শেষে পাট কাঁটা এবং পানিতে ঝাঁক দেওয়া শুরু হয়, ভাদ্র মাসে পাটের আঁশ ছাড়িয়ে সাড়ি সাড়ি ঝুলানো বাঁশে শুকানো হয়। জলজ উদ্ভিদ--শ্যাওলা, কচুরীপানা, শাপলা পাতা আর ফুলে ভরে যায় পুরো বিল। বর্ষার জলে আকন্ঠ নিমজ্জিত মাঠের ফসল, হিজল গাছ, বড়ই গাছ, ্লতা গুল্ম আর বিরুৎ জাতের ছোট ও ছড়ানো গাছ-গাছালি আবার জেঠে ওঠে নতুন শপদে। জলের ছোঁয়ায় জঙ্গলের বিশাল বটগাছের অসংখ্য ঝুরি নেমে বড় বড় গুঁড়িতে পরিণত হয়েছে। বট, হিজলের ডালে বসে দিনের বেলা মাছরাঙ্গা, বক, চিল, শকুন, শালিক, দোয়েল আর রাতের বেলা হুতুম পেচা, বাঁদুর মাছ শিকার করে। বিকালের মেঘ মাখা স্নিগ্ধ আলোয় বিল অঞ্চলের উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েরা অথবা বেড়াতে আসা শহুরে বাবুরা নৌকা চড়ে গোধূলী বেলা সূর্যের লালিমা দেখতে দেখতে বাড়ি ফিরে। যুবক-যুবতীদের চোখের চাহনী নতুন কবিতার মত মন নেচে উঠে যেন, ‘দুলছে হৃদয় দুলছে মন, জল ছুঁই ছুঁই সারাক্ষণ...।’

খাওয়ার সময় ওকে শুনালাম আমার জীবনের পঁচিশটি শরতের গল্পঃ ভাদ্রের শালুক-শাপলা দিয়ে রান্না তরকারী, রাঁঙ্গা আলুর শাক, পুঁই শাক, কলমি শাক--কতনা সবজির সমাহার অথবা বকফুলের বড়া! আহ! কলমি শাক দিয়ে রান্না ছোট চিংড়ীর চচ্চরী অথবা বিল-ঝিল-বাওর-হাওর এর হিজল, করচ, শুল্লী, বলুয়া, বনতুসী, নলখাগড়া জলডোবা গাছ-গাছালীর বাঁকে বাঁকে ডিঙ্গী ভিড়িয়ে জাল, বরশী, টেঁটা অথবা লুঙ্গি-গামছা দিয়ে ধরে আনা আইর, মাগুর, বাইম, টেংরা, বউজ্জা, সিং, কই, পুটি, গুতুম, গুলশা, কাকিয়া, বেতি, তিতনা ইত্যাদি মাছের ঝোলে মায়ের বকুনি অথবা কানমলার স্বাদ যেন হারিয়ে যায়। শরতের মাঠে মাঠে কৃষকের ব্যস্ততা। রোপিত ফসলের কচি ডগা দেখে মন জুড়িয়ে যায়। আগাছা জেড়ে ফেলে নতুন উদ্দোমে জাগে সময়। বেলা বাড়ে, পাখির কলকাকলী, ভিনদেশী অতিথি কৃষকের বাঁশীর হৃদয় টানা সুর--চোখ বন্ধ হয়ে এ মন যেন অজানা প্রজাপতির দেশে হারিয়ে যায়। হাঁটুজলে নেমে ধঞ্চে অথবা শোলা ঘাস কাটা; আশ্মিনের শেষে ক্ষেতের আইল উঁচু করে পানি সেচে মাছ ধরা; পায়ের ছাপে ছাপে পানি শুকিয়ে যায়, আগাছা গঁজে উঠে। উপমা অবাক হয়ে শুনে। আমার ডাকে হঠাৎ কেঁপে উঠে; আবেগাপ্লুত হয়ে বলে, সবুজ, তোমাকে ছেড়ে, এ দেশ ছেড়ে আমি আর বিদেশে যাব না।

না, শরৎ কিবা আমি--কেউ উপমাকে এ দেশের ঘাস-ফুল-নদীর সাথে বেঁধে রাখতে পারিনি। যাওয়ার সময় আমাকে বলেছিল, তুমি যাবে আমার সাথে? কবি জীবনানন্দের সাথে সুর মিলিয়ে আমি বলেছিলাম, ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও--আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাব; দেখিব কাঁঠাল পাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে...।’ শরতের কাঁশফুলের ছবি, দূর্গা অথবা লক্ষীদেবীর আগমনে ডোল অথবা কাঁসারী ঘন্টার আওয়াজ, ভাদ্রবিলের শাপলার হাতছানি, মেঘমুক্ত নীলাকাশ--হাজার বছর অপেক্ষায় থাকব আমি অধীর আগ্রহে, শরতের তারা ভরা রাতে তোমার জন্য।

পোস্টটি ৯ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


সুন্দর। আপনার সাথে গ্রাম ঘুরে আসতে বেশ ভালো লাগলো।

শাশ্বত স্বপন's picture


ধন্যবাদ। ষড়ঋতুর প্রতিটি ঋতুতেই আপনাদের নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা রাখি এবং অবশ্যই গ্রামে...। চলুন এবার একটু বাসে উঠে দুষ্টামী করি...।তারপর ভারোবাসার জন্য হাজার বছরের অপেক্ষা ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌'কোন এক নদীকে' পড়ি। দেখুন তো নারীর বিষয়ে একমত হতে পারেন কিনা?

টুটুল's picture


আপনার সাথেই ঘুরতে চাই ... লিখতে থাকুন

তানবীরা's picture


সুন্দর। আপনার সাথে গ্রাম ঘুরে আসতে বেশ ভালো লাগলো।

শাশ্বত স্বপন's picture


ধন্নাবাদ

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

শাশ্বত স্বপন's picture

নিজের সম্পর্কে

বাংলা সাহিত্য আমার খুব ভাল লাগে। আমি এখানে লেখতে চাই।