ইউজার লগইন

বন, কুয়াশা অার শীতের গল্প

বন, কুয়াশা অার শীতের গল্প/ কুয়াশা ঢাকা সময়

সেই কবে ঘাস, গাছ ইত্যাদি কাটার কাজে এই বনে এসেছি, দুই/তিন মাস তো হবেই। অথচ মনে হয়, দিন সাতেক হবে। কুয়াশা ঢাকা এই শীতের মাঝে কিভাবে সময় চলে যায়, সঙ্গীরা সকলে টের পেলেও আমি পাই না। আমি কুয়াশা ঘেরা এই বন পথে প্রতিদিন সূর্যের উদয় দেখি, দেখি দূরের টিলা, জঙ্গল; আবার সন্ধ্যায় বন ঝাউ, দীর্ঘ ঘাস (বাঁশ) তথা বনশীর্ষ লাল আভায় মাখিয়ে সূর্য ঘুমিয়ে যায়। দিন মজুরী কাজ শেষে নতুন কাজের খুঁজে আবার ছুটে চলি লাউয়া ছড়ায়, চিম্বুক পাহাড়ে, ভাওয়াল বনে অথবা অন্য কোথাও। রাতের চর বন আর ভাওয়াল বন আমার চোখে একই রূপ ধারন করে। নিঃশব্ধ অরন্যভূমি, নিস্তব্ধ জনহীন জোৎস্না রাত্রি, চকচকে সাদা বালু, কোথাও দো-আঁশ মাটি মিশানো বন, দিনের রৌদ্রে কাচা শুকনা কাঁশবনে রাতে জোৎসার আলো পড়ে অপার্থিব সৌন্দর্যের অপূর্ব মহিমায় ভরে দেয় আমার দৃষ্টির দিগন্ত। জল ডোবায় সাদা-বেগুনি কলমী ফুলের সমারোহ আর এই ভিজা বালু-দো-আঁশ মাটিতে সাদা সাদা (কেউ বলে এর নাম দুধলি ফুল) ফুল--বড় মিষ্টি সুগন্ধ ছড়ায় আশেপাশে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে হঠাৎ করে। এ সময় বৃষ্টি! অবাক হলাম, এটা কি মাস? কখনো কখনো পৌষ মাসে কিছু কিছু বৃষ্টি পড়ে। মাঘ মাসে বৃষ্টি নাই। সবাই বন পথে সাপের ভয়ে গান গেয়ে অথবা হাততালি দিয়ে পথ চলে। আমি আমার সঙ্গীদের সবাইকে ‘শীতনিদ্রা’ সম্পর্কে বললাম--দেহের তাপমাত্রা শীতের সাথে উঠা-নামার কারনে সাপ-ব্যাঙ এখন দেখা যাবে না।

গায়ের চির চেনা পথে রোদের ছোঁয়ায় কুয়াশা কাটে। জমানো শিশিরে রাস্তাঘাট ভিজে যায়। গাছে গাছে অবিরাম চলে ঝরা পাতার খেলা। পাখিরা শশব্ধে উড়ে যায়। বাগানে ডালিয়া, চন্দ্র মল্লিকা, গাঁদা ফুল ফুটে। নানা জাতের ধান কাটা শুরু হয় কোন কোন মাঠে। আলু, সরিষা, মুগ, মসুর ইত্যাদি ফসলে; ফুলকপি, বাঁধাকপি, শীম, পিয়াজ, রসুন ইত্যাদি সবজিতে বাড়ীর আঙিনা, শুকনো ডোবা বিল ভরে যায় সৌন্দর্যে। পুকুরের হাঁটু ময়লা পানিতে ছোটদের ছোট ছোট মাছ, ব্যাঙাচি ধরার খেলা। গায়ের বধূয়ার কলসী কাঁখে নদীর ঘাটে যাওয়া। নতুন জামাই বেড়াতে আসলে অথবা নতুন বউ দেওর, ননদদের সাথে নিয়ে বাপের বাড়ী ‘নাইওর’ আসলে খেজুর রস আর পিঠার সুবাস ছড়িয়ে পড়ে পাড়াময়। মাটির সরাতে, বেতের থালে, কলাপাতায় অথবা পিতলের প্লেটে সাজানো থাকে গ্রাম বাংলার বাহারি রকমের পিঠা--পাকান পিঠা, ভাপা পিঠা, কুসলি পিঠা, চিতই পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, নকসা পিঠা, পাতা পিঠা, জামাই পিঠা, আন্দসা, কাটা পিঠা, চুটকি পিঠা, মুঠা পিঠা, চ্যাপা পিঠা, জামদানী পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, ঝুড়ি পিঠা, ফুলঝুরি পিঠা, বিবিখানা পিঠা, মাছ পিঠা, হৃদয় পিঠা, গোলাপ ফুল পিঠা, পেঁচানো পিঠা, ফুল পিঠা, শাহী বিবিখানা পিঠা ইত্যাদি আরো কত রকমের পিঠা; মা, বোন, বউদের পিঠাশৈলী আর রাত-দিনের অক্লান্ত পরিশ্রম সকলের স্বাদ, তৃপ্তি আর স্বস্তির মধ্যদিয়ে পিঠাশৈলী আর পরিশ্রম সার্থক হয়। এত রকমের পিঠা খেয়ে কতবার হারিয়ে গিয়েছি কত স্বপ্নরাজ্যে। জামাইয়ের সাথে শালা-শালী, বিয়াইয়ের সাথে বিয়াইনরা মেতে উঠে গ্রাম-বাংলার মুখে মুখে প্রচলিত ‘ধাঁধা মিলাও--পিঠা খাও’ উৎসবে।

কুয়াশার ভোরে ‘গাছি’র কাঁধে মধুবৃক্ষ খেজুর গাছের রস। কতবার গিয়েছি ‘গাছি’র বাড়ী। খেজুরের রস থেকে গুড় বানানোর সে কি শিল্প--পাতলা ঝোলা গুড়, নলেন গুড়, দানা গুড়, পাটালী গুড়--আমি আনমনা হয়ে যাই গুড়ের সুগন্দে। সমগ্র দেশ, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ-দক্ষিণবঙ্গ আমার চোখের সামনে কুয়াশা ঘেরা মনে হয়। এই আমার মামাবাড়ী--শরিয়তপুরের জাজিরা--খেজুর রস আর সরিষা--এ রকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাংলার অন্য কোথাও দেখিনি। মনে হয়, আমি যেন মৌমাছির মত সরিষার ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছি, প্রকৃতিকে ত্রিমাত্রায় ধারণ করে গদ্য পুঁথির মালা গেঁথে চলেছি।

পোস্টটি ৩ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

শাশ্বত স্বপন's picture

নিজের সম্পর্কে

বাংলা সাহিত্য আমার খুব ভাল লাগে। আমি এখানে লেখতে চাই।