পথ হারা পাখি
কুয়াশার ভোর। গাড়ি চলছে ধীর গতিতে, দশ-পনের হাত সামনের জায়গাটিও ঝাপসা দেখায়। কুয়াশাঘেরা পিচঢালা পথে ড্রাইভার তাই খুব সাবধানে, ধীর গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। সুপারভাইজার চিৎকার করে বলছে, ‘জানালার পাশে যারা বসছেন, দয়া করে জানালা খুলবেন না, পিকেটাররা ককটেল-বোমা-ঢিল মারতে পারে।’ বাপ্পি সুপারভাইজারের মুখের পানে চেয়ে আছ। মুখ নয় যেন, চায়ের কাপ থেকে ধূয়া বের হচ্ছে। রাস্তায় ককটেল ফুটলেও এরকম ধূয়া বের হয়, তবে বেশ আওয়াজে। বাপ্পি এটা বেশ ভাল করে জানে। আগে সে রবীন্দনাথ, নজরুল, কার্ল মার্কস, লেলিন, মানিক পড়ত। এখন এদের লেখাগুলো পড়া তার কাছে পাপ মনে হয়। কিন্তু সে সব বিদ্যার ঘোর তার মনে, মননে আস্টে-পৃস্ঠে লেগে আছে। ঘন কুয়াশাঘেরা নৌঘাট-নদী-বালুতীর তাকে পিছু টানে, কি যেন, মনে করিয়ে দিতে চায়।
বেশ কিছুদিন ধরে দেশব্যাপী অবরোধ-হরতাল চলছে। ঢাকা থেকে মাওয়া এক ঘন্টার পথ, মধুমতি বাসটি দেড় ঘন্টার বেশি সময় নিয়েছে। বাপ্পি একটা গুরুত্বপূর্ণ মিশনে গোপালগন্জের টুগিংপাড়া যাচ্ছে। তার নেতা, বড় ভাই তাকে এই মহান কাজ সফল করতে আদেশ করেছে। এ কাজে কামিয়াম হতে তার সাথিরা তার জন্য আল্লার কাছে মোনাজাত করেছে। আজ ১৭ তারিখ, টুংগিপাড়া শেখ মুজিবের মাজারের কাছে গিয়ে তাকে এ কাজটা করতে হবে। কিছু কাফের মারা গেলে তার দল তথা ইসলামের জন্য বড় কাজ হবে।
সকাল ৯টা, মাওয়া থেকে কেওড়াকান্দির ঘাটে কোন লন্চ, ফেরী, স্পীটবোট যাবে না। ঘন কুয়াশায় স্পিটবোট, লন্চ, ফেরী পথ হারিয়ে ফেলে। সকলের অনুরোধে সাড়ে নয়টায় স্পীটবোট ছাড়ল। সবাই যে যার মত দোয়া পড়তে লাগল। আলাপচারিতায় বুঝা গেল, বোটে সরকারী প্রশাসনিক অফিসার, একজন ডাক্তার, এক জন হিসাব রক্ষক, দুইজন ব্যবসায়ী, এক পর্দানশীন নারী তার স্বামীর সাথে বসেছে; আর বাকিরা মাদারীপুর-গোপারগন্জের বাসিন্দা। মহান মিশনে সে এতই মোহাচ্ছন্ন যে, এখন তার কাছে সে, চালক হুজুর আর এই পর্দানশীন পরিবারটা ছাড়া সবাইকে কাফের মনে হয়। চালক মাদ্রাসা পড়ুয়া হুজুর মানুষ; নিজেদের লোক বলে মনে হলেও; তার নিজের দাঁড়ি নেই; এই ভেবে তার নিজেকে ছোট মনে হল। যদিও সপ্তাহ খানিক আগে এই মিশনের স্বার্থে সে তার নিজের দাঁড়ি কামিয়েছে। কিছুদূর যেতেই বোট থেমে গেল। পথ হারিয়ে স্পিটবোট একটা তীরে এসে ভিড়ল। চালক একটা গালি দিল, ‘যা শালা, এই তো পুরাতন মাওয়া ঘাটে এসে গেছি।’
চালক হুজুরের গালি, যাত্রিদের সাথে খারাপ ব্যবহার দেখে বাপ্পির কাছে তাকে ভালো লোক মনে হচ্ছে না। পর্দানশীন নারী আর তার সাথে পুরুষটির হাসি-তামাসা-আচার ব্যবহার সন্দেহ হচ্ছে। বোরকা পড়ে মুখ-দেহ ঢেকে মেয়েটি মনে হয়, দাঁড়িবিহীন যুবকটির সাথে পালাচ্ছে। ১৫ বছর আগে তার অপরূপ সুন্দরী বোনও বোরকা পড়ে গণেশদার সাথে এভাবে পালিয়েছিল। যাই হোক, ইসলাম কায়েম হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
বোট আবার উত্তর-পশ্চিম দিকে যাত্রা করল, পাঁচ মিনিট পরে লৌহজং এর চরে নাকি জাজিরা কোন চরে এসে ঢেকে গেল, চালক ঠিকমত ধরতে পারছে না। সবাই ভয় পেয়ে গেল। জল পথে লন্চ, ফেরী, পদ্মা ব্রীজের কাজ সব থেমে আছে। ঘন কুয়াশায় লাইট যে প্রবেশ করতে পারে না, বাপ্পি আগে তা জানত না। বোট ডুবে গেলে, সেও ডুবে যাবে। গ্রামে সে যেটুকু সাঁতার শিখেছে, তার উপর হাঁপানি রোগ--ফলে ১০ মিনিট এই ঠান্ডা মানিতে সে টিকতে পারবে বলে, তার মনে হয় না। সাধারন মানুষের মত সেও বেশ ভয় পেয়ে গেল, বারবার পড়তে শুরু করল, লা-ইলাহা ইল্লা আনতা ছুবাহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জোয়ালেমিন।
মনে করতে লাগল, এই ২৩ বছরের জীবনে সে কতবার পথ হারিয়েছে। নাস্তিকদের সাথে সমাজ উদ্ধার করতে গিয়ে কতই না গুনার কাজ করেছে। আওযামী লীগ-বিএনপির সাথে দুই এক বছর যুক্ত থাকলেও, মন দিয়ে সে কাজ করেনি, তার ভালো লাগেনি। তাবলীগ জামাতে গিয়ে করেছে আরেক ভুল, কাজ কাম ফেলে তার খাস্তে নামে, চল্লিশ দিনের চিল্লায় যায়, তিন চিল্লা দিলে নাকি বেহেস্ত কর্ণফার্ম্। আবার ইস্তেমায গেলে নাকি হজ্বের সমান ছোযাব পাওয়া যায়--যা ধর্মের পন্চম স্তম্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। এই বোটে এসে সে কি আবার ভূল করল। দেরি করে লন্চে আসাই ভালো ছিল।
শিখা আপা, তার বড় বোন, বিয়ের পরে পর্দানশীন; তার স্বামী নাম পরিবর্তন করে রেখেছে আমিনা। সে সরাসরি তার বোনের দিকে অনেকদিন হল তাকায় না। এটাই হল ইসলামের প্রকৃত জীবন যাপন। আওযামী লীগ থেকে বিএনপিতে যোগ দিলে ছাত্রলীগ কর্মীরা তাকে বেদম পেটায়, হাত-পা ভেঙ্গে দেয়। হাসপাতালে ভর্তি ছিল পুরো এক মাস। তারপর সে চট্রগ্রাম থেকে ঢাকায় বোনের বাসা কামরাঙ্গির চরে চলে আসে। হাসপাতালে তার দুলাভাই মিজানের আজ্ঞাবহ লোকেরাই তাকে দেখা-শুনা করেছে, সব খরচ বহন করেছে। এই দুলাভাইয়ের এক চোখ কানা, কেন কানা, তা বাপ্পি সব জেনেছে। আর আজ্ঞাবহ ভাইযেরা কারা, তার বোনের কাছ থেকে অনেক পরে সে জানতে পেরেছে । অবশ্য অনেকদিন পরে দুলাভাই বোনের সাথে ঝগড়া করে এমন কথা বলে ফেলেছে, যা শুনে সে বাসা থেকে বের হয়ে আসে। অনেকদিন সে বোনের বাসায় আর আসেনি। বারবার তার কানে সে কথাই বেজে উঠত, তোমার ভাইকে নির্ঘাত মরণ থেকে বাচিঁয়েছি, তোমার পিড়িতের গণেশরে দুনিয়া ছাড়া করেছি, নইলে সে তোমার হাতের লেখা চিঠি আর দু’জনার ছবি দিয়ে তোমার জীবন তো শেষ করতই, আমার মান-সন্মানও ধুলায় মিশায়ে দিত। গণেশের পরিবার ওদের দেশ ইন্ডিয়াতে চলে গেছে, নইলে গণেশের ছোট বোন কল্যাণী তোমার ভাইরে কাফের বানাইয়া ফালাইত।
পরবর্তীতে এই মিজানের কারণেই সে তাদের দলে যোগ দিযেছে। বাপ্পির মগজ বেশ ভালই ধোলাই হয়েছে। তার এখন মনে হচ্ছে, দুলাভাই ঠিক কাজটিই করেছে। নইলে তার বোন, তার আজ কি হত। যাই হোক, আল্লাহ যা করে, তা ভালর জন্যই করে। মিজানের সাথে কাজ করতে গিয়ে প্রায় এক বছর হল বাপ্পি পলাতক।
২০ মিনিটের পথ লুকোচুরি খেলতে খেলতে, ভয় পেতে পেতে কেওড়াকান্দির ঘাটে ভিড়তে পারল না। ঘাটটির কাছে নদীর কোন এক তীরে ঢেকল। নামার পরই মনে হল ভালই হয়েছে। মূল ঘাটে পুলিশ টহল দিচ্ছে। কুয়াশা কেটে না গেলে কোন যান ঘাটে ভিড়বে না; ঘাট ছেড়েও যাবে না। বাসস্ট্যান্ডে এসে লোকাল গাড়িতে পা রাখতেই সেল ফোন বেজে উঠল।
-এহসান, লোকালয় থেকে তফাতে যাও
-জ্বি ভাই, একটু দূরেই আছি।
-উপর থেকে একটু আগে ফোন আসছে। মিশন বাতিল কর।
-কেন ভাই?
- ওখানে করে তেমন ফায়দা হবে না। বরং যে কয়জন সাথী ভাই আছে, তাদের উপর অত্যাচার বেড়ে যাবে। ওখানে সংখ্যা আরো বাড়ুক
-ভাই, ওখানে সংখ্যা তো অনেক--
-তুমি যাদের গুনায় ধরছ, তারা সরাসরি আমাদের দল করে না।
- এই এলাকার এত উন্নয়নের পরও যারা সরকারী বিরোধী--তারা আমাদের দলের বা মতের না হয়ে পারেই না। তারা ইসলাম কায়েমে অবশ্যই সহযাত্রী হবে।
-এহসান, সরকার বিরোধীদের মধ্যে ইহকালের ভোগবাদী, সুবিধাবাদী--আরো অনেক আছে। তর্ক করো না। এটা তর্কের সময় না। গো বেক--। খোদা হাফেজ
-সরি ভাই, খোদা হাফেজ
এহসানুল কাদির বাপ্পি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র। মহান মিশনে কাজ করে--বাঁচলে গাজি, মরলে শহীদ। বড় ভাইয়েরা কোরান-হাদিসের আলোকে এত চমৎকার করে বুঝিয়েছে যে, বাপ্পি মৃত্যু নিয়ে কোন চিন্তা করে না। এখন আখেরাত তার হাতের মুঠোয়।
শহরের মানুষ খুব খারাপ, হরতাল-অবরোধ মানতে চায় না। জালেম, কাফের সরকারের বিরুদ্ধে তারা সব পথে নামছে না। সবাইকে পথে নামানোর জন্য, শত শত সাথী ভাইদের হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য, ইসলাম কায়েমের জন্য বাপ্পিরা এমন মহান মিশনে নেমেছে যা সফল হলে সবাই ইসলামের ছায়াতলে শান্তিতে থাকবে।
গত কয়েকমাস মিরপুরে সে তার অসুস্থ্ বাবাকে একবারও দেখার সময় পায়নি। এমন কাজে আছে সে--তা শেষ না করে সে বাসায় কিভাবে ফিরে। বড় আপা ফোন দিয়েছিল, আজ সে তার বাচ্চাদের নিয়ে আব্বাকে দেখতে যাবে। গতকাল বড় ভাই এক সাথীকে দিয়ে দশ হাজার টাকা তার মেসে পাঠিয়েছে। টাকাটা হাতে পেয়ে সে সোজা কামরাঙ্গির চরে শিখাদের বাসায় হাজির।
-আপা, হাতে সময় নাই, তিন হাজার টাকা রাখ। আয়েশা আর হোসেনের জন্য খেলনা কিনে দিস আর আব্বার জন্য একটা পান্জাবী, একটা লুঙ্গি কিনে দিস। টাকা বাঁচলে কিছু ফল কিনিস। আব্বা, আঙ্গুর খেতে খুব ভালবাসে।
-বাপ্পি, আজ একটা মেয়ে ফ্লেক্সির দোকান থেকে আমাকে ফোন করে তোর ফোন নম্বরটা নিয়েছে। গ্রাম থেকে মেয়েটি আমার ফোন নাম্বার যোগার করেছে। এতদিন বিদেশে ছিল। সে তার নাম বলেনি, তবে কন্ঠস্বর খুব চেনা চেনা মনে হয়েছে। কিরে, তোর কোন বান্ধবী নাকি?
-তুই আমাকে না বলে নাম্বার দিলি কেন? সময় খারাপ। পুলিশের সোর্স কিনা, কে জানে। আর কাউকে নাম্বার দিস না।
-তোর ফোন বন্ধ ছিলো, মেয়েটি তোর খোঁজ-খবর নিল। সব শুনে কাঁদলে লাগল। মায়া ধরে গেল। নারে, সে তোকে খুব ভালবাসে। তোর বিয়ের বয়স হয়েছে।
-আমি আসি আপা। খোদা হাফেজ
ধোলাই খালে মানুষ খুব বেশি। সে চেয়েছিলে এখানেই কাজটি করবে। কিন্ত তার বড় ভাই নিউমার্কেটের রাস্তায় কাজ করতে বলল। সারাদেশে তাদের কাজের জয়জয়কার, সরকার পতন হবেই। কিন্তু তার সাথীদের কাছে শুনতে হচ্ছে, সব কাজ তারা করছে না, সরকারী দলের লোক, তাদের আন্দোলনের সাথী অন্য দলের সাহসীরাও এসব কাজ করছে। তবে কারো দ্বারা কোন নেতা বা নেতার আত্নীয় স্বজন বোমায় মরছে না, পুড়ছে না। সব সাধারন মানুষ। বাপ্পির বিরক্ত লাগে, তবে খুব বেশি খারাপ লাগে না। ওরা তো তার আপন না। বড় ভাইরা কেন যে নেতা বা নেতার আত্নীয় মারার আদেশ দেন না, তা তার বোধগম্য না। অনেক সময পার হয়ে গেল, পুলিশের টহল গাড়ি বারবার আসে, সেই সাথে আছে সাদা পোষাকের গোয়েন্দা, সরকারী দলের লোক। সে তার ঝালমুড়ির ব্যবসা গলায় ঝুলিয়ে খরিদ্দার হাকতে লাগল।
রাত আটটা, ভয়ানক শীত পড়েছে, হরতাল-অবরোধে রাতে গাড়ি আর মানুষের সংখ্যা বেশ কম। এক টোকাইকে এক ডোঙ্গা ঝালমুড়ি খেতে দিয়ে ঝালমুড়ির ঝুড়িটা ফুটপাতের এক পাশে রেখে বাপ্পি গেল,‘ এই পিচ্চি, এইটা দেখিস, আমি প্রস্রাব করে আসি।’ কয়েকটা গাড়ি হাত ছাড়া হয়ে গেল। বড় ভাই বারবার ফোন দিচ্ছে, কাজ হল কিনা। বাপ্পি অস্থির হয়ে গেল, তার মাথা ঘুরছে, পা চলতে চাইছে না, হাতদুটো বেশ ভারি লাগছে, ম্যাচের কাঠি জ্বলছে না। আগে এতগুলো কাজ করেছে এমন লাগেনি। আজ কেন এমন লাগছে। আজ যে তাকে কাজটি করতেই হবে। উপর থেকে চাপ আছে। আজিমপুরগামী একটি গাড়ি আসছে, তার আগে পিছে দু’চারটা রিক্সা ছাড়া কোন গাড়ি নেই, আশে-পাশে পুলিশ নেই, পেছনে দৌঁড় দিয়ে পালাবার মত নিরাপদ পথ আছে।
বাপ্পি এরপর কি করেছে তা তার মনে নেই। কিভাবে বিডিআর দিকে পালিয়ে গিয়ে ঘুরে ফিরে ধোলাইখালে চলে এসেছে, তা সে মনে করতে পারছে না। এতক্ষণ মোবাইল বন্ধ ছিল, সময় দেখা হয়নি। ফোন চালু করতেই বড় ভাইয়ের ফোন নাম্বারটা বেজে উঠল--।
-এহসান, মারহাবা, মারহাবা, মহান কাজ করেছ, বড় কাজ করেছ। উপরের সবাই খুব খুশী। সাবধানে থেকো, রাতে জুবায়েরের মেসে আসিও, ওখানে দশ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিব।
-ভাই, আজ খুব ভয় লেগেছে
-দোয়া পড়, বারবার পড়
ফোনে কথা শেষ হতেই স্ক্রিনে দেখল রাত এগারটা। জুবায়ের এর মেসে গিয়ে খেয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করল। একাত-ওকাত করে, নানা দোয়া-দরুদ পড়েও তার ঘুম আসছে না। এত পরিশ্রম করেও তার ঘুম আসছে না কেন? রাত দুইটা বাজে। দোয়া-দরুদে সে ভরসা করতে পারল না। ঘুমের দুইটা ল্যাক্সিল ট্যাবলেট খেয়ে নিল। বন্ধ ফোনটা আবার চালু করল।এত সময় আব্বা-মা-আপার কথা ভুলেই ছিল। আব্বা অসুস্থ, নিশ্চয় কেউ জেগে আছে। আপা তো সকালে গেছে, দু’একদিন থাকবে। আব্বার সেবার জন্য আপা অবশ্যই জেগে থাকবে।আপাকেই ফোন দেওয়া যাক। বার কয়েক চেষ্টা করে দেখল, আপার ফোন বন্ধ। নিজের উপর বিরক্ত হয়ে ফোনটা বিছানায় ছুড়ে মারতেই একটা ম্যাসেস আওয়াজ বেজে উঠল। ম্যাসেস পড়তে তার ইচ্ছা হল না। সারাদিন কোম্পানীর ফালতু সব ম্যাসেস আসে। সে আবার ঘুমাতে চেষ্টা করল। ঘুম আসছে না। ফোনটা নাড়া-চাড়া করতেই স্ক্রিনের বাতি জ্বলে উঠল। টু আনরিড ম্যাসেস। অনিচ্ছা সত্বেও সে পড়তে লাগল, প্লিজ, ওপেন ইউর ফোন, ভেরী আর্জেন্ট…। ২য় ম্যাসেসটা পড়তে লাগল, ইউর সিস্টার ইন হসপিটাল…। বাপ্পির সারাদেহ কেঁপে উঠল, এক লাফে বিছানা থেকে উঠে কাঁপতে কাঁপতে ম্যাসেস সেনডার এর ফোন নাম্বারটা বের করে ফোন দিল,‘ প্লিজ কে ভাই, আমাকে ম্যাসেস পাঠিয়েছেন?’ আমার বোনের কি হয়েছে? অপর পাশ থেকে বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা, ‘বাপ্পি..!’ কানের ভিতর একটা বোমা ফুটে উঠল, একটা নারী কন্ঠ, যেন হাজার বছরের পরিচিত, অতি আপন একটা কন্ঠস্বর।
-কে!
-বাপ্পি, অনেকবার ট্রাই করেছি। ফোন বন্ধ ছিলো। তারাতারি ঢাকা মেডিকেলে চলে আস
-কে!
-পেট্রোর বোমায় আঘাতে তোমার বোন মৃত্যু শয্যায়, তোমার ভাগ্নি মারা গেছে। ভাগ্নের অবস্থা ভাল না।
বাপ্পির মাথায় যেন, এবার বজ্রপাত হল। চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। পাশের রুম থেকে আন্দোলন, আন্দোলন, সংগ্রামের সাথী মামুন এসে তাকে জড়িয়ে ধরল।
-ভাই, একটু ধৈর্য্য ধরেন, বড় ভাইরে একটা ফোন দিই-
-না
-ভাই, আপনাকে চেনে এমন কেউ কি দেখেছে?
-মনে হয় না
-আরেকটু ভাবুন, এটা গোয়েন্দাদের ফাঁদ কিনা?
-বোনের মিরপুরে যাবার কথা ছিল।অসুস্থ আব্বার কাছে দুই একদিন থাকবে। বোন কি আজিই নিজের বাসায় রওনা দিয়েছে। মিজান ভাইকে একটা ফোন দাও।
-চট্রগ্রাম উত্তরের সহসভাপতি মিজান ভাই? সে তো ভাই বিকালে ঢাকায় এসেছে, একসাথে মধুবাগে চা খেয়েছি।
-বল কি, তাহলে আপা তো মিরপুর থেকে বাসায় আসবেই। ফোন দাও।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বার্ণ ইউনিট। দাঁড়ি কামিয়ে জিন্সের প্যান্ট পড়ে, পকেটে এক প্যাকেট গোল্ডলিফ সিগারেট নিয়ে পলাতক আসামী কানা মিজান সম্পূর্ণ পুড়ে যাওয়া মৃত কন্যার কাছে এসে হাউ-মাউ করে কাঁদতে লাগল। ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে সে পুলিশের কাছে তার পরিবারের বর্ণনা দিতে লাগল। বাপ্পি বিস্ময় দৃষ্টিতে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল বোন-ভাগ্নে-ভাগ্নির দিকে। কষ্ট-জ্বালা-যন্ত্রনায় কাঁদতে না পেরে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। জ্ঞান ফিরে তাকিয়ে দেখল সকাল হয়ে গেছে। সব মনে পড়তেই এবার হাত-পা-মুখ পুড়ে যাওয়া বোনের কাছে গিয়ে কাঁদতে লাগল, আপা, আপারে, আমি এই বোমা মেরেছি, আমি অনেক পাপ করেছি। ও পুলিশ ভাই, আমারে ফাঁসি দেন। পিছন ফিরে তাকাতেই কল্যাণীকে দেখে সে নির্বাক হয়ে গেল। আবার জ্ঞান হারাল। জ্ঞান ফিরে তাকাতেই সে দেখল, তার হাত বেডের সাথে হ্যান্ডকাপ দিয়ে বাঁধা। একটা আদুরে হাত, যা তার কাছে চিরচেনা, কাঁথে-মাথায়-মুখে আদর করতে লাগল। কল্যাণী কাঁদছে, ‘আমার ভাইকে তোমরা মারলে কেন?’ কল্যাণী, তোমার ভাই নয়, আমরা ধর্মের নামে অনেক ভাই-বোনকে মেরেছি, ইসলাম কায়েম করার জন্য, হেন কোন কাজ নাই-যা করিনি। তুমি আমাকে ফেলে চলে গেলে কেন? আমাকে তোমাদের দেশে নিয়ে যাও--।
পড়লাম, ঠিকাছে কিন্তু অনেক বানান ভুল
মন্তব্য করুন