ইউজার লগইন

monga

মঙ্গা
-শাশ্বত স্বপন

শাশ্বত সকাল, না-ঠিক যেন শাশ্বত নয়, একটু অন্যরকম, গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পিচঢালা পথটাকে চকচকে মসৃণ করে দিয়েছে। কোন ধূলো-বালি নেই, আসলে শুধু এই গুড়ি গুড়ি শব্দহীন বৃষ্টি এই পথটিকে মসৃণ করেনি, গতকালের কালবৈশাখী ঝড় এই এলাকার কাচা মাটির ঘর-বাড়ি, গাছ-পালা, দোকান-পাট, বিদ্যুতের খুঁটি সহ অনেক কিছু ভেঙ্গে দিয়ে গেছে, সেই সাথে রাস্তার ধূলা-ময়লা সব পরিষ্কার করে দিয়েছে।যেমন শহরে ইট-পাথরের বাড়িতে কাজের বুয়ারা শশব্দে প্রথমে ঝাড়ু দেয়, তারপর পানি দিয়ে মেঝে মুছে দেয় —এ যেন সে রকম কোন কাজ।হাজার বছরের চিন্তাধারা নিয়ে গড়ে ওঠা আমার মা, তিনি হয়তো বলবেন, স্বয়ং শিব দেবতা ত্রিশঙ্কু বাজিয়ে দামাল নৃত্যে গত রাতে এই পথ দিয়ে কোথায় যেন চলে গেছে। চৈত্র-বৈশাখ এ্রলেই সে এরকম উদোম নৃত্যে মেতে উঠে আর চারদিকে ধ্বংশ লীলার চিহৃ রেখে যায়। প্রতিবেশি দাদী বলবে, আরে ইস্রাফিল শিঙ্গা ফু দিয়ে এ এলাকার পাপ-ময়লা পরিষ্কার করার জন্য এই হাঁক ডাকে। পূরাণের শিবকে দূর্গা, কালী, নারদ বা কোন দেব-দেবীকে দিয়ে থামানো যায়, ইস্রাফিলকে কে সিঙ্গা থামাতে বলবে? আর উত্তর বঙ্গের এই অণ্চলে বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট নানা ঝন্ত্রণার দেব-দেবী বা ফেরেসতারা যুগ যুগ ধরে জোঁকের মত লেগেই আছে, আর যেন তাদের কোন কাজ নেই।

নির্ঘুম চোখ, গাড়ি থেকে নামতেই চিকচিকে রাস্তাটির দিকে তাকিয়ে অচেনা সকাল মনে হচ্ছে। এ যে আমার পরিচিত কোন জনপথ নয়। নিরব কান্নায় ক্লান্ত বুড়িমারীর পথ, যেন আলাদা হয়ে যাওয়া স্বামী-স্ত্রীর আইনগত সংযোগ পথ; যেন সন্তান বড় না হওয়া পর্যন্ত এ সম্পর্ক স্বাক্ষরিত কোন করুন পদাবলী।এই অংশ আমার, আমাদের—এখানে এই এলাকায় সারা দিন-রাত থাকতে পারব, ঘুরতে পারব, কেউ বাঁধা দেবে না। কিন্তু ঐ অংশে যেতে হলে পাসপোর্ট, ভিসা লাগবে। ১৯৪৭ সালের আগে এসব লাগতো না, এখন লাগে, পূর্ব পুরুষের জমি টুকরো টুকরো হয়ে আজ এ অবস্থা। এ যেন, দাদার জমি, মরার আগে বা পরে পিতারা ভাগ করে নদী-নালা-খাল-বিল-পাহাড়-পর্বত-জমি-জমা সহায় সম্পদ, সব টুকরো করে যে যার ভাগে যত পেল নিল। কারো ভাগে নদী কম, কারো ভাগে পাহাড়, কারো ভাগে খনিজ। স্ত্রীরা-পুত্র-কন্যা-নাতী-নাতনী—সবাই চেয়ে চেয়ে দেখল, ছোটরা কাঁদল, বড়দের কেউ কাঁদল, কেউ নিরবতা নিয়ে নিজের জীবদ্দশায় লাভের হিসাবটা ঠিক করে নিল; ভবিষ্যতে কি ভয়ানক সর্বনাশ হতে পারে--তা ভাবল না।বুড়ীমারীর বুক চিড়ে আঁকা-বাঁকা দাগ টানা হল। সবাই তাকিয়ে দেখল, কারো কিছু বলার নেই, ভাই হয়ে গেল ভিন দেশী, যে বোনকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল পশ্চিমের কোন ভিন গাঁয়ে, তার অজান্তে সেও ভিন দেশী হয়ে গেল।যে রাম খেলা করত ইউনুছের সাথে, সেও পর হয়ে গেল, এমন পরই হলে বাকী জীবনে আর কোন দিন দেখাও হয়তো হবে না। লোভী, ক্ষমতা লিপ্সা কিছু নেতার জন্য এ হিংসার আগুন তুসের আগুণের মত চিরকাল ভবিষ্যৎ বংশধরের বুকে তিস্তা, ধরলার ধারায় প্রবাহিত হবে। সে সব নেতারা আজ কেউ বেঁচে নেই, তাদের দেওয়া তুষের আগুন তিস্তা-ধরলার ধারায় বয়ে চলেছে…।

লালমনির হাটের শুধু পাটগ্রাম ঘুরেই আমার কাছে মনে হয়েছে, ১৯৪৭ সালে দেশ নয়, যেন কোরবানীর গরুর মত বা কালী পূজার পাঠা বলি দেবার মত মাংস, লিভার, কলিজা, নাড়ী-ভুড়ি, চামড়া ইত্যাদি অংশগুলোকে টুকরো করে করে দেশকে নানা গোত্রের, নানা জাতের, নানা বর্ণের, নানা মতের মানুষকে খুশি করে কি ভয়ানক ছেলে খেলা আমাদের অর্বাচীন পূর্ব পুরুষেরা করে গেছে। শুধু ধর্মকে পুজি করে কি খেলাই না খেলেছে তারা। আজ যা ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশে দেখতে পাই। তখনকার চাইতে দেশ বিভাজন বিষয়টা বর্তমানে আরো বেশি প্রকট, তাই বলে কি এই দেশগুলো আরো ভাগ হযেছে। পররাষ্ট্র-সমরাষ্ট্র-অর্থনীতি ঠিক রেখে অধিকতর স্বায়ত্বশাসন দিয়ে দেশগুলো কি এক থাকতে পারত না?অবশ্যই পারত। হায়রে পূর্বপুরুষ, বিট্রিশের কুপরামর্শে কি সর্বনাশই না করেছে । আজ সবাই মিলে ভারত থেকে নেওয়া বিট্রিশের হস্তগত সম্পদ চাইবে কি, নিজেরা ঝগরা করে বিট্রিশ রাজের কাছে বিচার প্রার্থনা করে।

আজ ভুড়িমারী বন্দরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে পারি, কোন প্রয়োজন ছিল না এদেশ ভাগ; তিন বিঘা করিডোরে দাড়িয়ে সারা ভারতবর্ষের মানুষকে বলতে ইচ্ছা করছে, এটা নোংরামী; তিস্তা বেড়ী বাঁধে দাঁড়িয়ে বলতে চাই, হে ওপারের ভাই-বোনেরা, আমাদের পূর্বপুরুষ নিজের স্বার্থে যা করেছে, ভুল করেছে।তোমরা দেখ, আমাদের কি কষ্ট, বর্ষাকালে তোমরা তোমাদের বাঁধ খুলে দেও, আমরা পানিতে ডুবে ফসল নিয়ে মরি; বর্ষা শেষে তোমরা বাঁধ আটকে দেও, আমরা আমাদের ফসল ফলাতে পারি না্। দেশ বিভাজন না হলে আজ তিস্তার নদীর এ অবস্থা হত না, উত্তরবঙ্গ মরুভূমির মত হাহাকার করত না।শুকনো মৌসুমে চাতক পাখির মত তোমাদের পানে চেয়ে থাকতাম না । আমাদের অবস্থা তোমাদের মতই থাকতো। আজ দুর থেকে ভাই রাম, তোমার সোনালী ফসল দেখতে পাই, আর আমি ইউনুস, দেখ পানির জন্য ফসল ফলাতে পারছি না। সুখ-দুঃখ নিয়ে আমরা একই ছাদেই থাকার কথা। দেশ বিভাজন আমাদের জন্য মঙ্গা নামক অভিশাপ এনে দিয়েছে।

সকাল থেকেই হিমু কাকে যেন খুঁজছে।নানা জনকে জিগ্গাসা করেও কোন কাজ না হওয়ায় সে তার হোটেলের রুমে চলে এল। এ এলাকার পাটগায়ের তার বাড়ি। পূর্ব পুরুষ থেকেই এই এ্রলাকায় তাদের বাস। তবে ভুরিমারী বন্দরের ঐ ধারেও তার আত্নীয স্বজন আছে।দেশ বিভাজন তাদের পূর্বপুরুষদেরও আলাদা করে দিয়েছে। তার আত্নীয়দের মধ্যে যারা দরিদ্র তার প্রায়ই বিএসএফ-বিজিবিকে ম্যানেজ আসা-যাওয়া করে।কিছু গোপন ব্যবসাও করে। ধনী আত্নীয়রা পাসপোর্ট ভিসা নিয়ে দশ বছরে দু’একবার আসে। হিমুর প্রজন্মের সন্তানরা এখন আর আসা-যাওয়া করে না, তবে দরিদ্র আত্নীয়,যেমন, হিমুর দাদার বোনের নাতীদের ছেলে-মেয়ে বা তাদের বাচ্চারা প্রায়ই আসে। তবে ঠিক বেড়াতে না, অন্য কাজে, হিমুরা ঐ পারে যায় অন্য কাজে।

হঠাৎ হোটেলের নিচ থেকে ডাক আসে, হিমু, নিচে নাম, আমি রবীন্দ্র। বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে হিমু তাকে দেখে খুব খুশী হল, রবীন্দ্র দা, কেমন আছেন? রবীন্দ্র আশে-পাশে তাকিয়ে ছোট একটা বোতল হিমুকে দেখিয়ে বলল, ভাল না, ব্যবসা ভাল যাচ্ছে না ভাই।
এই রবীন্দ্র হিমুর দূর সম্পর্কের আত্নীয়।ওর দাদার বোনের কোন নাতী তূল্য কন্যা, কুচবিহারের কোন হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করেছে, রবীন্দ্র সেই কন্যার নাতী। আত্নীয় পাল্লায় সে সম্পর্কে হিমুর ভাই তুল্য। না, এই সম্পর্কে সে এখানে আসেনি, এসেছে ব্যবসার কাজে।

পোস্টটি ৩ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

শাশ্বত স্বপন's picture

নিজের সম্পর্কে

বাংলা সাহিত্য আমার খুব ভাল লাগে। আমি এখানে লেখতে চাই।