ধূসর গোধূলিঃ বিপ্রতীপ...
স্কুলে আসার পর থেকেই উৎসবের আমেজে থাকে অয়ন। বন্ধুদের সাথে হেসে খেলে আনন্দে মেতে থাকে পুরোটা সময়। স্কুলের মাঠের পাশের একটা পাকুড় গাছ। গাছটা ছায়া দিয়ে কেমন ঢেকে রাখে মাঠটা। এটার নিচে একটা লোক প্রতিদিন আইসক্রিম বেঁচে। ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে লোকটা মিহি করে বরফ কেটে একটা ছাঁচের মধ্যে পুরে কেমন লম্বা আইসক্রিম বানিয়ে ফেলে, তারপর তাতে লাল, সবুজ রঙ লাগিয়ে দেয়। আজ বাবার থেকে পয়সা নিয়ে কিনেছিল ও, খুব মজা খেতে।
অয়ন শুনেছে, স্কুলের উল্টোদিকে চলে যাওয়া উঁচু রাস্তাটা অনেকদূর এগিয়ে গিয়ে সোনাপুর থেকে কলাবতী বাজারের পাকা রাস্তাটার সাথে মিশেছে। এই রাস্তা ধরে কলাবতী বাজারে যাওয়া যায়। ওদিকটায় কখনও যায়নি ও। আজ তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে গেল। মিরাজ আর সুবলকে ডেকে বলতে দুজনেই সানন্দে রাজী হয়ে গেল। তিনজন মিলে নতুন রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল অজানার পথে। স্বাধীনতার এমন আনন্দ ও পায়নি কোনদিন, বাঁধনহারা মনটা খুশিতে নেচে ওঠে অয়নের। রাস্তার দুপাশেই অসংখ্য বুনো ঝোপ, লতাগাছে পরিপূর্ণ। এগুলোকে বলে রায়ড লতা, এরা এমনভাবে বেড়ে ওঠে যে একসময় মূল গাছটাকে ঢেকে ফেলে পুরোপুরি, অনেকটা স্বর্নলতার মত। অয়ন দেখেছে কারো হাত-পা কেটে গেলে এই লতার রস লাগিয়ে দিলে ভাল হয়ে যায়। অযত্নে বেড়ে ওঠা বুনো ঝোপ আর ঘাসের মধ্যে অবহেলায় ফুটে আছে রঙ বেরঙের ফুল! কলাবতী, ঘেটু, আকন্দ, ছোট ছোট সাদা উচুন্টি, চোরকাঁটা, কাঁটায় ভর্তি বুনো বেগুন আরও নাম না জানা কত বুনোফুল! রাস্তা থেকে জমির দিকে পানিতে শুয়ে থাকা লতানো গাছে ফুটে আছে প্রচুর ঢোল কলমি। তিনজনে হাঁটতে হাঁটতে একসময় দেখে রাস্তাটার শেষ মাথায় একটি বাঁশের সাঁকো। একটি এক-বাঁশের উঁচু বাঁকানো সাঁকো, ধরণিটা এতটাই উপরে যে অয়নরা ওটার নাগালই পাবে না। দমে যায় ওরা, ওপাড়ে তাকিয়ে দেখে দূরে পাকা রাস্তা ধরে সাঁই সাঁই করে ছুটে চলেছে গাড়ি। সাঁকোর গোড়ায় কড়ই গাছটার নীচে বাঁশের মাচায় কিছুক্ষণ বসে ওরা, তারপর ফিরে চলে যেপথে এসেছিল সেদিকেই।
কাজ শেষ হয়ে গেলে স্কুল থেকে বের হলেন সাত্তার মাষ্টার। দরজায় তালা লাগিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। মনে মনে ভাবেন, সকালবেলায় ছেলেমেয়েদের কোলাহলে মাঠটা সরগরম হয়ে ছিল আর এখন কেমন নীরব! কচি কচি মুখগুলোর মাঝে সময়টা খুব ভাল কাটে মাষ্টারসাবের। মানুষ গড়ার এই কাজটা করতে পেরে বেশ আনন্দিত তিনি। আবার মাঝে মাঝে ভাবেন সবাই কি মানুষ হয়? তাই যদি হত তাহলে সমাজটা সত্যিই অন্যরকম হত। মাঠের পাশের পাকুড় গাছটার নিচে এসে দাঁড়ান কিছুক্ষণ। এখানে এসে দাঁড়ালে কেমন শান্তি লাগে মনে। আজ পঁচিশ বছর ধরে এই গাছটার সাথে সম্পর্ক তার। ঠিক পঁচিশ বছর না, আরও বেশী। ছেলেবেলায় যখন এই স্কুলে পড়তেন তখন থেকেই। প্রতিদিন স্কুল থেকে বের হয়ে গাছটার নিচে কিছুক্ষণ দাঁড়ান তিনি, যেন শান্তির পরশ বুলিয়ে নেন গায়ে। তারপর ধীরে ধীরে গাছের নিচে রাখা সাইকেলটা নিয়ে এগিয়ে চলেন বাড়ির দিকে।
কোটাখালী খালের পাড় ধরে সাইকেলে চেপে বাড়ি ফিরছেন মাষ্টারসাব। তালুকদারের হাঁটের কাছ দিয়ে যাবার সময় প্রতিদিনের মত আজও চোখে পড়ে বখাটে ছেলেদের জুয়ার আড্ডাটা। এদের কেউ কেউ তার স্কুলের ছাত্র ছিল একসময়। প্রথমদিকে এদের অভিভাবকদের জানিয়েছিলেন তিনি, কাজ হয়নি কোন। অবশ্য কাজ হওয়ার কথাও নয়। ভাল বীজের জন্য ভাল গাছও দরকার, এ সত্যটা অনুধাবন করার পর আর কখনও এদের ব্যাপারে কিছু বলেননি তিনি। তার নির্মোহ জীবনে কোনকিছুর বাড়াবাড়ি ছিলনা কখনও। নিজের প্রাপ্তিটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন সবসময়। এখন তার চিন্তা ভাবনা কেবলমাত্র অয়নকে ঘিরে, একমাত্র চাওয়া তার ছেলেটি যেন মানুষের মত মানুষ হয়।
বিকেলের কোমল আলোয় নদীর দিকে থেকে ছুটে আসা ঠান্ডা বাতাসে দোকানের সামনের কৃষ্ণচূড়ার তলায় বসে দাবা খেলায় মগ্ন সাত্তারমাষ্টার আর হামিদ শেখ। পাশের চেয়ারে দর্শকের ভূমিকায় বসে জগানন্দ, ইসমাইল মোল্লা, হেলালউদ্দীন, জয়নাল হাওলাদার, হরিপদ, কাজেম। কেউ কেউ দুজনকেই নানারকম পরামর্শ দিতে ব্যস্ত।
-মাষ্টার, এইবার তোমার মন্ত্রী সামলাও। সাত্তার মাষ্টারের উদ্দেশ্যে বলে হামিদ শেখ
-এই নাও, বলে একটা সৈন্যকে সামনে এগিয়ে দেয় মাষ্টার
-এইবার চেক, মন্ত্রীকে বামদিকে সরিয়ে রাজা বরাবর নিয়ে এসে বলে হামিদ শেখ
-হাতির চালে তুমি সবসময়ই দুর্বল, তোমার চোক্ষেই পড়লো না এই জায়গাডা আমার হাতির পাহাড়ায় আছে! নাও, এইবার মাত!
-নাহ! তোমার লগে খেলতে অইলে হাতির চালডা আমার ভাল কইরা শিখতেই অইব
-এই হামিদ, এহন সবাইরে চা খাওয়াও, জগানন্দ বলে ওঠে।
হামিদ শেখ হরিপদর দোকানের ছেলেটার উদ্দেশ্যে সবাইকে চা দিতে বলে গল্পে মশগুল হয়ে পড়ে। এঁদের সবার নিয়মিত আড্ডার জায়গা এটাই। মাঝে মাঝে ওদের সাথে এসে যোগ দেয় সাত্তার মাষ্টারের স্কুলের অন্য মাষ্টাররা। উজানগাঙের উপর দিয়ে আসা প্রাণ জুড়ানো ঠান্ডা বাতাসে এইখানটাতে কিছুটা স্বস্তি পান এঁরা। সন্ধ্যার পর বইয়ের দোকানে বেচাকেনা তেমন একটা থাকেনা, তাই এঁরা পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ আর গল্পকথায় কাটিয়ে দেন সময়টা। বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে আলোচনায়। কথায় কথায় রাত হয়ে গেলে উঠে পড়েন সবাই। সাত্তার মাষ্টার দোকান বন্ধ করে ফিরে চলেন বাড়িতে। অনেকদিন পর আকাশে তারার দেখা পাওয়া গেল আজ। নদীর পাড় ধরে হাওয়া খেতে খেতে কাজেমের সাথে এগিয়ে চললেন।
-আর তো পারা গ্যালো না মাষ্টার, কাজেম মাঝি বলে উঠলো
-ক্যান, কি অইছে?
-ঘাডের ভাড়া বাড়াইয়া দিছে বাদইল্যা, কাইল থেইকা হগগলে নাও বাওয়া বন্ধ কইরা দিবো
-এইডা তো কোন সমাধান না, নাও বাওয়া বন্ধ করলে তোমার না অয় চলবো, কিন্তু অন্য সবাইর কি অইব?
-হেইডাই তো চিন্তা করি মাষ্টার! এত্তোদিন ধইরা সুখে দুক্ষে একলগে আছিলাম, অগো প্রত্যেকের অবস্থা জানি। খুব কষ্ট অইয়া যাইবো।
-তারচাইতে অগো লগে বইয়া দ্যাহো কোন সমাধান করতে পার কিনা।
-অইগুলান তো মানুষ না, তুমি হুনোনাই কয়দিন আগে কি অইছে?
-হ, হুনছি। নিজেও তো দ্যাখতাছি। কি করবা দিন বদলাইয়া গ্যাছে, ভাল মানুষের ভাত নাই এহন
-ঠিকই কইছ মাষ্টার, তাই ভাবতাছি এইগুলান থেইকা দূরে থাকুম। পোলাডা একলা দোকান সামলাইতে পারতাছে না। অরে কিছুডা সময় দেওন দরকার।
-হ, কালামের দোকানডা বেশ ভালাই চলতাছে। তুমি সময় দিলে অর সুবিধাই অইব। তয় এইগুলার বিরুদ্ধে সবার রুখে দাঁড়ানোটা জরুরী অইয়া পড়ছে। কাইল বিহালে আইও, সবার লগে আলোচনা করতে অইব।
-ঠিক আছে মাষ্টার, দ্যাহো কিছু করতে পারো কিনা
কথায় কথায় কাজেমের বাড়ির সামনে এসে পৌছায় দুজনে। কাজেম বিদায় নিলে সোজা পথে এগিয়ে চলেন মাষ্টারসাব। পাঁচ ব্যাটারীর টর্চের উজ্জ্বল আলোতে অন্ধকার দূর হয়ে কাঁচা রাস্তা এবং আশপাশের অনেকটা জায়গাই পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। কিছুদূর এগিয়ে মসজিদের কাছাকাছি যেতেই তাঁর হঠাৎ মনে হল মফিজ মিয়ার দীঘির পাড়ে একটা ছায়ামুর্তি যেন সরে গেল গাছের আড়ালে। টর্চটা নিভিয়ে দিয়ে হাঁটার গতি কিছুটা কমিয়ে দিলেন তিনি। একটু এগিয়ে গিয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন, যেখানে মফিজ মিয়ার বাড়ি থেকে সরু পথটা এই রাস্তার সাথে মিশেছে। আকস্মাৎ দীঘির পাড়ের দিকে টর্চের আলোটা ফেলতেই দেখলেন পথের একপাশে বাবলা গাছটার নীচে বিভার ঘরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে একজন মানুষ।
-কেডা অইহানে? মাষ্টারসাব চড়া গলায় বলে উঠলেন
লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, বোধহয় চেনার চেষ্টা করে কন্ঠস্বরটি কার। একটু পরই নিচুস্বরে একটা পুরুষ কন্ঠের জবাব শোনা যায়, আমি ছার
-আমি কেডা? আবার বললেন মাষ্টারসাব
মানুষটি এবার আস্তে আস্তে রাস্তার দিকে এগিয়ে আসে, কাছাকাছি আসতেই তিনি দেখেন লোকটা হারু মেম্বারের ছেলে গিয়াস।
-তুই এইহানে কি হরস?
-কিছুনা ছার, এই পথ দিয়াই আইতেছিলাম
-এইডা তো তোগো বাড়ির পথ না, এই বাগানে এতরাইতে তোর কি কাম?
-সাজুগো বাড়ি গেছিলাম, এহন বাড়ি যামু।
মাষ্টারসাব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন, তারপর বলেন-আচ্ছা ঠিক আছে, যা।
গিয়াস তাঁকে পাশ কাটিয়ে উল্টাদিকে চলে যায়। মাষ্টারসাব আরও কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থাকেন ওখানে, ওর পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার পর ফিরে চলেন নিজের পথে।
চলবে.......
আগের পর্বগুলো (ধারাবাহিকভাবে) -
• ধূসর গোধূলিঃ সবুজ জমিনে বর্গী...
• ধূসর গোধূলিঃ স্বপ্নের অপমৃত্যু...
• ধূসর গোধূলিঃ আলোর নীচের অন্ধকার...
• ধূসর গোধূলিঃ পঞ্চম পর্ব
• ধূসর গোধূলিঃ মৌমাছি
• ধূসর গোধূলিঃ চেনা পথের গল্প...
• ধূসর গোধূলিঃ হারানো দিনের ডাক...
• ধূসর গোধূলি - চতুর্থ পর্ব
• ধূসর গোধূলিঃ দুরন্তপনা
• ধূসর গোধূলিঃ মায়া
• ধূসর গোধূলিঃ কোটাখালীর বাঁকে
• ধূসর গোধূলি - তৃতীয় পর্ব
• ধূসর গোধূলিঃ কাকতাড়ুয়া
• ধূসর গোধূলিঃ স্বপ্ন ডানায় চড়ে
• ধূসর গোধূলিঃ পূর্বকথন
• ধূসর গোধূলিঃ দ্বিতীয় পর্ব
• ধূসর গোধূলিঃ প্রথম পর্ব
ব্লগে পূর্বে প্রকাশিত "ধূসর গোধূলি" গল্পটি ছিল অনেকটাই অসম্পূর্ণ। সম্পূর্ণ লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ব্লগে দেয়ার ক্ষেত্রে আগের কিছু পর্বের লিংক দেয়া হল।
এটা ধীরে ধীরে একটা মহীরূহ হয়ে উঠছে। দুই মলাটের ভেতরে দেখতে চাই এই লেখাটাকে।
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। দারুন লিখে চলছেন।
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। দারুন লিখে চলছেন।
মন্তব্য করুন