ধূসর গোধূলিঃ ২৩ - জলে ভাসা জীবন...
কয়েকমাস পরই ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। নির্বাচনের সময় যত কাছে এগিয়ে আসছে মানুষের মধ্যে আগ্রহ যেন ততই বাড়ছে। বিকেল থেকে কলাবতী বাজারের সর্বত্র সরগরম হয়ে থাকে। সবার মুখে একই আলোচনা- ভোট। সম্ভাব্য প্রার্থী আর তাদের ব্যক্তিগত ইমেজ নিয়ে আলোচনা সমালোচনায় মুখর হয়ে থাকে বিভিন্ন বয়সী লোকজন। প্রার্থীদের নামের ঘোষনা যদিও এখনও আসেনি তবে এসব খবরগুলো যেন বাতাসের আগে ছড়ায়। শোনা যাচ্ছে এবারের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বর্তমান চেয়ারম্যান বশিরুল্লাহ পাটোয়ারী আবার দাঁড়াবেন। উজানপুরের সাঈদ খানের নামও শোনা যাচ্ছে। মেম্বর পদে খালেক তালুকদারের পাশাপাশি অন্য যে নামটা বেশী আলোড়ন তুলছে সে হল হারু মেম্বরের ভাই মজনু। মজনুর নামটা আসার সাথে সাথেই সচেতন হয়ে উঠেছে খালেক মেম্বর। এই মুহুর্তে সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ- তার ভাই বাদল। ওর কারণে গ্রামের লোকদের মধ্যে তার নিজের অবস্থান খুব বেশী ভাল নয়। মজনুর সাথে বাদলের রেষারেষি তাকে বেশ সংকটেই ফেলে দিয়েছে। সে মনে মনে ফন্দি আঁটতে থাকে কি করে মজনুকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা যায়।
উজানগাঙের পাড়ে বটতলার হাটের আরও কিছুটা সামনে এগিয়ে নদীর পাড় ঘেঁষে খালেক তালুকদারের স’মিল। স’মিলের পাশেই ছোট একটা ঘর তুলে নিয়েছে বাদল। এই ঘরটাকেই ওরা ব্যবহার করে আড্ডার স্থান হিসেবে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর থেকে শুরু করে অনেক রাত অবধি এখানে বসেই তাস-জুয়ার আসর চলে ওদের। বাদলের সাথে এখানকার প্রতিদিনের নিয়মিত সদস্য হল মজনু, গিয়াস, মনা, জব্বার, রইস, পলাশ, সাজু আর কাসেম। তবে ঘাটের বিরোধ নিয়া বাদলের সাথে একটা দূরত্ব হবার পর মজনু, গিয়াস, সাজু, পলাশদের এদিকে দেখা যায়না আর।
খালেক মেম্বর তার বর্তমান মেম্বারের পদটা যে কোন মূল্যে ধরে রাখতে বদ্ধ পরিকর। সে কারণেই এবারের নির্বাচনে জয়লাভের পথ পকিষ্কার করতে সবরকম চেষ্টা করে চলে। স’মিলের ছোট ঘরে আলোচনায় ব্যস্ত বাদল আর খালেক মেম্বার।
-ভাল কইরা খবর নে তো সত্যি মজনু এইবার ভোটে খাড়াইব কিনা, বাদলের উদ্দেশ্যে বলে খালেক মেম্বার।
-তুমি কোন চিন্তা কইরো না, অর দৌড় আমার জানা আছে। অর ব্যবস্থা আমিই করতাছি
-হ, তোর উপর ভরসা কইরা আরও ভরাডুবি হউক! তোর লইগাই মজনুর প্রতি গ্রামের মানুষের আগ্রহ বাড়ছে, না অইলে অরে ডরানোর কোন কারণ আছিলনা। কি দরকার আছিল নদীর ঘাট নিয়া এত বাড়াবাড়ি করনের?
-তুমি যদি কও তয় অরে সরাইয়া দেই?
-হ, কি বুদ্ধির ঢেকি! এহন এমন কাম কইরা ষোলোকলা পূরণ কর আর কি!
-তইলে এহন কি করবা?
-ওর লগে খাতির জমা। আবার আগের মতই স্বাভাবিক অইয়া যাবি, যেন কিছুই অয়নাই
-তারপর?
-সময়মত কমু তারপরে কি করতে অইব।
-আইচ্ছা, বলে ভাইয়ের কথায় সম্মতি প্রকাশ করে বাদল।
হেমন্ত এসে আসন গেড়েছে প্রকৃতিতে। বিকেলগুলো কেমন দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। দুপুরের পর থেকেই ছায়ারা যেন ছুটে পালাতে থাকে। গোধূলির লালাভ আভাগুলো ছড়িয়ে পড়ে দিগন্তজুড়ে। শেষ বিকেলে অয়ন বাবার লাইব্রেরীর সামনে বসে আছে। হঠাৎ ওর দৃষ্টি চলে যায় বহুদূরে। বটতলার নদীর ঘাট ছাড়িয়ে আরও দূরে। ওখানে নদীর পাড়ে ভিড়িয়ে রাখা অনেকগুলো নৌকা। ও অবাক হয়ে ভাবে, ওখানে এত নৌকা এলো কোথা থেকে? মন্টুমামাকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল- ওইগুলান বাইদ্যার নাও। অয়নের কৌতুহল বেড়ে যায়। বাবা এসে ওর পাশে বসতেই ও জিজ্ঞেস করে,
-আইচ্ছা বাবা, অতগুলান নৌকা অইহানে কি করে?
-ওরা অইহানে কয়েকদিন থাকবো
-ক্যান, অইহানে থাকবো ক্যান?
-বেদেদের কোন ঘরবাড়ি নাই, নৌকাতেই বসবাস করে ওরা। এক জায়গায় বেশিদিন থাকেনা, নৌকা কইরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুইরা বেড়ায়। যখন যেখানে নৌকা ভিড়ায় সেখানে সাপ ধরে, সাপের খেলা দেখায়, কখনও চুড়ি-ফিতা বেঁচে, দাঁতের পোকা তোলে। এভাবেই ওরা জীবিকা নির্বাহ করে।
-ওরা সাপ ধরে! ডর লাগে না? অয়ন বলে
-না, ওরা ছোডবেলা থেইক্যাই এইকাম করে, তাই অগো ডর লাগেনা।
-অগো কাছে গ্যালে কি ডর দেহাইবো?
-না, তা ক্যান? ওরা তো খারাপ মানুষ না। সাপ ধরে, সাপের খেলা দেখাইয়া ওরা জীবন ধারণ করে।
-বাবা, আমি মন্টুমামার লগে অইহানে যামু?
-যাও, তয় সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিইরা যাইও
-আইচ্ছা, বলে অয়ন মন্টুর সাথে উজানগাঙের পাড়ে ভিড়িয়ে রাখা বেদে নৌকাগুলোর দিকে এগিয়ে চলে।
মাষ্টারসাব কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন নদীর পাড়ে ভিড়ানো বেদে বহরের দিকে। মনে মনে ভাবেন, কি অদ্ভুত এদের জীবন! যুগ যুগ ধরে এরা যাযাবর জীবনধারণ করে আসছে, কোথাও স্থায়ী আবাস মেলেনা। বিষধর সাপ নিয়ে খেলা করাই কেটে যায় সারাটা জীবন। কখনও সাপের কামড়ে মারাও যায় কেউ কেউ। কোন অভিযোগ নেই কারো বিরুদ্ধে। গাঁয়ের পথে পথে মাথায় সাপের ঝুড়ি আর কাঁধে কাপড়ের পুটুলি নিয়ে হেঁটে বেড়ায় বেদে মেয়েদের দল। কেউ কেউ তাদের শিশু সন্তানকে পিঠে ঝুলিয়ে নিয়ে বেড়ায়। ওদের কাজ মূলত সাপের খেলা দেখানো, কখনও কখনও শিঙা টানা, দাঁতের পোকা বের করা- এ ধরনের ছোটখাট কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করে ওরা। যদিও বেশীর ভাগ মানুষই জানে এগুলোর কোন ভিত্তি নাই, অনেকে নিছক মনোরঞ্জনের জন্য এদেরকে ডাকে।
এই যূথচারী মানবগোষ্ঠীর যাযাবর জীবনেও থাকে নানা ঘাত প্রতিঘাত। বিভিন্ন এলাকায় সমাজপতি কিংবা বখাটেদের খপ্পরে পড়ে এদের হারাতে হয় অনেক কিছুই। বেদে বহরের তরুণী বেদেনীদের সৌন্দর্য্যর মাদকতায় অনেক তরুণের মাথা ঘুরে যায়। আর তখনই বেদে মেয়েরা এদের লোলুপ দৃষ্টির শিকার হয়। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়না। নদীর পাড়ের স-মিলের ছেলেগুলোর দৃষ্টি পড়ে এই বহরের মেয়েদের উপর। গতকালই বেদে বহরের বৃদ্ধ সর্দারকে দেখা গেল স-মিলে এসে খালেক মেম্বরের কাছে নালিশ জানাতে। -বাবুরা, আমরা দুই দিনের লইগ্যা তোমগো ঘাটে আছি। দয়া কইরা আমগো মেয়েছেলেদের দিকে নজর দিও না। খালেক মেম্বার বাদলকে ডেকে শাসিয়ে দেয়। নির্বাচনের আগে আর কোন রকম ঝামেলা যাতে না হয়।
বটতলার হাট পার হয়ে নদীর তীর ধরে কিছুদূর এগিয়েই অয়ন দেখতে পায় উজানগাঙের পাড়ে বেশ কিছু রঙ বেরঙের নৌকা ভিড়ানো। এ নৌকাগুলো দেখতে অন্যরকম। ওরা যে ছৈওয়ালা নৌকায় চড়ে, সেরকম না। প্রতিটা নৌকার সামনের দিকে দরজা লাগানো। নৌকার সামনের খালি জায়গাটুকুতে চুলা বসানো আছে, সেখানে রান্নায় ব্যস্ত পুরুষ মানুষরা। মহিলাদের দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলা করছে ডাঙায়, তাদের অনেকের পড়নে নেই কোন জামাকাপড়। কিছুক্ষন পর বেশ কিছু মহিলা মাথায় গোল ঝুড়ি নিয়ে ফিরে আসে নৌবহরের দিকে। ওদের কথা বলার ধরনটাও অন্যরকম। অয়ন মন্টুমামাকে জিজ্ঞেস করে,
-মামা, অগো মাথার টুকড়িতে সাপ আছে?
মন্টুমামা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। তারপর ওকে জিজ্ঞেস করে, সাপ দেখবি?
-না, আমার ডর লাগে। যদি কামড় দেয়?
মন্টু হাসে। বলে- এই সাপে বিষ নাই। অগো বিষদাঁত ভাইঙ্গা দেওয়া অইছে।
-তবুও, আমি দেখুম না। ওরা সাপ ধরে ক্যান?
-সাপ না ধরলে ওরা খাইবো কি? এইডাই তো অগো কাম।
-ওরা খুব গরীব না?
-হ, খুব গরীব।
অয়ন অনেকক্ষণ রাস্তার ধুলাবালির মধ্যে উলঙ্গ বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। ওদের জীবনযাত্রা দেখে ছোট্ট অয়নের মনেও প্রশ্ন জাগে-মানুষের জীবন এত কষ্টের কেন?
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। আগুনরঙা গোধূলির পশ্চিম আকাশটাকে ক্রমশ ঢেকে দিচ্ছে হালকা কুয়াসা আর অন্ধকারের দেয়াল। নদীর পাড় ধরে ওরা আবার ফিরে এলো, বাবার দোকানের সামনে আসতেই দেখল চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসছে। অয়ন মন্টুমামার সাথে দ্রুত বাড়ি ফিরে চলল। কলাবতী বাজার ছাড়িয়ে নদীর পাড় ধরে এগিয়ে এসে বাড়ির দিকের সরু রাস্তায় ঢুকতেই গাঢ় অন্ধকার এসে গ্রাস করলো ওদের। নিস্তব্ধ অন্ধকারে ঘাসে ছাওয়া মেঠোপথের মাঝে মাথার সিঁথির মত মাটির পথটা আবছাভাবে দেখা যায়। মন্টুমামা টর্চের আলোটা ছড়িয়ে দিতেই নিমেষে উজ্জ্বল আলোটা সামনের পথটাকে চোখের সামনে ভাসিয়ে তোলে। আলো নিভে গেলে আবার সব অন্ধকার। মামার হাত ধরে অয়ন হেঁটে চলল। কিছুটা শীত শীত লাগছে। হঠাৎ ও দেখতে পায়- সরু সাদা মেঠোপথটার মাঝখান দিয়ে কালো একটা কিছু এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। অয়ন মন্টুমামার হাতটা শক্ত করে ধরে বলে ওঠে- মামা! দ্যাহো, অইডা কি? মন্টু টর্চ জ্বালায়। টর্চের চোখ ধাঁধানো আলো গায়ের উপর পড়তেই বিড়ালটা রাস্তার মাঝখান থেকে দৌড়ে পাশের ঝোপের মধ্যে হারিয়ে যায়।
চলবে....
ছবিঃ কাইয়ুম চৌধুরী
পিছন ফিরে দেখা (আগের পর্বগুলি) -
০১• ধূসর গোধূলিঃ শ্রাবন মেঘের দিনে ০২• ধূসর গোধূলিঃ দীর্ঘশ্বাস
০৩• ধূসর গোধূলিঃ পূর্বকথন ০৪• ধূসর গোধূলিঃ স্বপ্ন ডানায় চড়ে
০৫• ধূসর গোধূলিঃ কাকতাড়ুয়া ০৬• ধূসর গোধূলিঃ ক্লান্ত দিনের শেষে
০৭• ধূসর গোধূলিঃ কোটাখালীর বাঁকে ০৮. ধূসর গোধূলিঃ মায়া
০৯• ধূসর গোধূলিঃ দুরন্তপনা ১০• ধূসর গোধূলিঃ আপন ভূবনে ফেরা
১১• ধূসর গোধূলিঃ হারানো দিনের ডাক ১২• ধূসর গোধূলিঃ চেনা পথের গল্প
১৩• ধূসর গোধূলিঃ মৌমাছি ১৪• ধূসর গোধূলিঃ বিষন্ন ছায়াপথ
১৫• ধূসর গোধূলিঃ আলোর নীচের অন্ধকার ১৬• ধূসর গোধূলিঃ স্বপ্নের অপমৃত্যু
১৭• ধূসর গোধূলিঃ সবুজ জমিনে বর্গী ১৮• ধূসর গোধূলিঃ বিপ্রতীপ
১৯• ধূসর গোধূলিঃ খেলা ২০• ধূসর গোধূলিঃ বন্ধন মুক্তির ডাক
২১• ধূসর গোধূলিঃ আজ গাশ্বীর রাত ২২• ধূসর গোধূলিঃ তারুণ্যের জয়গান
ব্লগে পূর্বে প্রকাশিত "ধূসর গোধূলি" গল্পটি ছিল অনেকটাই অসম্পূর্ণ। সম্পূর্ণ লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ব্লগে দেয়ার ক্ষেত্রে আগের কিছু পর্বের লিংক দেয়া হল।
ধন্যবাদ শান্ত।
অনবদ্য আপনার লেখার হাত। পড়ি আর মুগ্ধ হই।
ধন্যবাদ মীর, কিন্তু কমেন্টের অবস্থা দেখে তা মনে হয় না
মন্তব্য করুন