১৪৬০ দিন
বছরের প্রথম পোষ্টটা হোক স্মৃতিচারন মুলক, তাই এই লেখার সুত্রপাত। ১৪৬০ দিনের মর্মার্থ অতি সরল, ৪ বছরকে ৩৬৫ দিয়ে গুন দিলেই এই সংখ্যা পাওয়া যায়। তার মানে হলো ১৪৬০ কিংবা ১৪৬৫ দিন ধরে আমার এই ব্যাচেলর লাইফের মেস জীবন চলিতেছে সাড়ম্বরে। শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালের ২৮ কিংবা উনত্রিশ ডিসেম্বরে- সেই দিনটার কথা খুব মনে পড়ে। আম্মু আব্বু চলে যাবে জামালপুর, বাসার নিচে ট্রাক সেখানে জিনিস নিয়ে চলছে ও লোড হচ্ছে, আমি নরমালই ছিলাম, করম আলীর দোকানে চা খাচ্ছি সাথে নিচে নেমে জিনিসপত্তের নামানো দেখছি। কাজ সব শেষ হয়ে গেল, আব্বু আম্মুর ট্রেন বিকেলে তাই সব গুছিয়ে আড়াইটাই বের হলো। বিদায়ের সময় আমার সেকি কান্না, তা আর দেখে কে! আমার কান্না দেখে আম্মুরও কান্না, বারবার মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর আমার কোথা থেকে এত চোখের পানি আসলো তা ভাবতেই ভাবতেই সিএঞ্জি পাওয়া পর্যন্ত এসে পড়লাম। রাস্তায় সবার সামনেই কাঁদছি, কিছুতেই মানাতে পারছিলাম না যে চিরস্থায়ী ভাবে আম্মু আব্বুর সাথে এক বাসায় আর থাকা হবে না। রাতে ঘুম আসে না খালি মনে হয় আমি এখন কি করবো? এই গল্পটা আমি আগেও বহুবার বলেছিলাম, এখনও বললাম। আমার আবেগময় জীবনের খুবই সিগনেচার গল্প এটা। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না এই গল্পের কথা এতদিন পরে লিখতে বসে এখনো চোখে পানি এসে যায়!
সময় আর কিছু পারুক না পারুক অনেক কিছুই সহ্য করার ক্ষমতা দিয়ে দেয়- না চাইতেই। আমিও সময়ের ব্যাবধানে মানিয়ে নিয়েছি একা থাকা, তবে ব্যাচেলর লাইফে মানুষ যেইসব কাজ অবধারিত ভাবে শিখে তার কিছুই আমি তেমন শিখি নাই। বাজারে যাই না একেবারেই, না হয়েছে নিজের টাকায় চলা না পেরেছি নিজের তেমন বৈষয়িক উন্নতি। এখনো বুয়া না আসলে আমার রান্না করে খাওয়ার সাধ্য নাই, ঘর দোর পরিস্কার করতে এখনো মামা না থাকলে বুয়াই ভরসা, কাপড় ওয়াশ করতে হয় বাধ্য হয়েই কিন্তু ধবধবে পরিস্কার হয় না, কাজ চালানোর মত করে হয়ে যায়। খুব কড়া ইস্ত্রি করে লন্ড্রিতে সেই ভাজে ভাজে এক ধরনের উষ্ণতায় পরিপাটি ভাবে একঘেয়ে দিন চলে যায়।
যখন মেস লাইফ শুরু করি তখন আমার অনার্স চলছিলো, বাকী ছিল দুই-তিন সেমিষ্টার সাথে ইন্টার্নশীপ। ২০১১ র জানুয়ারীতেই শেষ হয়ে যায়, সার্টিফিকেট ও ট্রান্সক্রিপ্ট এইসব করে করে শেষ হয় এপ্রিলে। তারপর গেল ছয় সাত মাস বসে থাকা জীবন, এমবিএর এডমিশন অন্য কোথাও নেয়ার শখ ছিল, ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইভিনিং এমবিএতে টিকে গেলাম। ব্যস শুরু হলো আরেক বসে থাকার জীবন। সন্ধ্যায় ক্লাস সপ্তাহে দুই তিনদিন থাকতো আর বাকী সময় চায়ের দোকানেই পড়ে থাকা। করমআলী গেল, দেলোয়ার গেল, নান্নু গেল এখন চলতেছে বারেক সাহেব অধ্যায়। কত বড় ভাই ছোট ভাই আসলো গেল সম্পর্ক হলো আবার তারা হারিয়ে গেল চোখের সামনেই। টিকে গেলাম শুধু আমি আর পুলকই। কত অজস্র বার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর যাবো না, না গিয়েও থেকেছি অনেক কিন্তু ১৫-২০ মিনিট হেটে আবার চলে গেছি নিয়মিত চায়ের দোকান। এত বিশাল সময় চায়ের দোকানে থেকে পরোক্ষ ধুমপানে ধোয়া গিলেছি, দেদারসে টাকা ভেঙ্গে অন্যকে খাইয়েছি কিন্তু নিজে সিগারেট ধরি নাই, অনেক অপশন থাকা সত্তেও একদিনের জন্য হলেও এলকোহল ছুয়ে দেখি নাই, আরো অনেক খারাপ হবার উপায় ছিল যেগুলোর ধারে কাছেই যাই নি, মোটামুটি ভাবে একধরনের সিনসিয়ার সৎ বেকার জীবন চালিয়েছি, এইসব আমার এক ধরনের অহংকার, জানি না তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত। কারন হতে পারে বাবা মা ভাইয়ের কাছে ভালো থাকতে চাই সব সময়, নিজের যে গাধা রেপুটেশন আছে তাই নিয়েই দিন চলে গেছে।
এই চার বছরে আমার আরেক ভালো লাগার জায়গা হলো বই পড়া, পাবলিক লাইব্রেরী কিংবা নিজের বাসায় বই পড়া হয়েছে প্রচুর। অনেকে সময় পায় না পড়ার, কিন্তু আমার সময় ছিল অফুরন্ত তাতে বই একটা গুরুত্বপুর্ন অনুসঙ্গ, কিনে পড়েছি চেয়ে ও ধারে পড়েছি, সারাদিন বইয়ের দোকানে বসে গিলেছি এই ভাবেই গেছে বই পড়া। ইদানিং কালে বই পড়ার মনোযোগ কমেছে তবুও বইয়ের প্রতি ভালোবাসা এখনো অমলিন। পড়ছি ও লোকজনকে পড়াচ্ছি বই নিয়ে বয়ান দিচ্ছি আড্ডায় এই করেই চলছে দিন। ছোটবেলা থেকে আমার জেনারেল নলেজে খুব আগ্রহ ছিল আর সাথে ছিল পত্রিকা পড়ার নেশা। এই চার বছরে অজস্র লিটল ম্যাগ, সিনেমা পত্রিকা ও নরমাল সাময়িকী সব পড়া হয়েছে। গত একমাসে মন ভালো থাকার জন্য পত্রিকা পড়া বাদ দিলেও, দীর্ঘদিন অনলাইনে চারপাচটা ও কিনে একটা দুইটা নিউজপেপার না পড়লে আমার দিন মাটি মাটি লাগতো। এক ধরনের পড়াশুনার ভেতর দিয়েই বলা যায় দিনগুলো কেটে গেছে!
মেস লাইফে এই দিন গুলোতে মামার অবদান তো অনস্বীকার্য। মামা না থাকলে এরকম সুখে থাকা মোটেও সম্ভব ছিল না। আগে কোনো এক পোষ্টে এ নিয়ে বিস্তারিত বলেছিলাম সে কথায় আর যাবো না। তবে মামা যে ভালোবাসা স্নেহ আসকারা দিয়ে মাথায় তুলে রাখছে তা নিয়ে ভাবলে বিস্ময় লাগে। আমার চিটাগাং থেকে কাজে আসা সব বন্ধুরই আশ্রয় আমার বাসা, মামা কোনো ধরনের বিরক্তি ছাড়া তা মেনে নিছে। গত তিন বছর ধরে আমরা একই বাসায় আছি যার রুম একটাই তার ভেতরেই আমার যাবতীয় মেহমান দারির অত্যাচার মামা সহ্য করে গেছে। বন্ধুরা আসলেও বাকীতে চায়ের দোকান তাদের সেবার কমতি ছিল না। আমার এইসব কর্মকান্ডে এমন নামই কামিয়েছিলাম বন্ধুরা বলতো- যে কোনো রকমে ঢাকাতে পোছলেই হলো, শান্ত তো আছেই। আমি যখন বাড়ীতে তখন কেউ আসলে বলতো তুই নাই অন্যের বাসায় উঠছি, ঢাকা শহরকে কেমন জানি পানসে লাগে! এইসব কমপ্লিমেন্টই জীবনের সেরা প্রাপ্তি!
দীর্ঘদিনের এই বেকার জীবনে এমবিএ চলছে তার মতোই, আরো এক সেমিস্টার বাকী। চাকরী তেমন একটা খুঁজি নি, যাদের কাছে খুজেছি তারা দিতে পারে নাই। এই নিয়ে খুব হাপিত্যেষ ছিল, ব্যাংকেও তেমন এক্সাম দেই নাই, মাস্টার্স নাই বলে। খুবই টানাটানিতে এখনো কাটে দিন। কিন্তু একটাই অর্জন বলার মতো তা হলো এই বছরের একুশে নভেম্বর জানতে পারি যে- বিসিএসে টিকছি রিটেন ভাইভায়, চুড়ান্ত নিয়োগে গেজেটে প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত এখনো অনিশ্চিত তবুও এই ভরসাতেই গত এক মাস একটু ভালো দিন যাচ্ছে। অনেক লোকজনরেই দেখি আজকাল আমারে খুব মুল্য টুল্য দেয়, আমি তাদের সাথে খুব একটা পাত্তা দেই না। যাদের সাথে সঙ্গ আড্ডা জমে তাদের সাথেই চলছে। তবে পরিধি আস্তে আস্তে ছোট হচ্ছে এইটাই চিন্তার। কাউকেকেই তাই বেশী ফোন দেই না, মাঝে মাঝেই আমাকে একা একা থাকতে হয়।
মামার বিয়ে হলো দু মাস চলছে। বিয়ে এক ধরনের সমস্যায় ফেলে দিয়েছে আমাকে। মামা শুক্রবার থাকেই না, অফিসের ব্যস্ততায় রাতে আসে কথা হয় কম আবার ঘুম থেকে উঠে দেখি মামা নাই। কি জামানা আসলো, আগে মামার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপে কথাই ফুরাতো না, এখন ফুরসতই পাওয়া যায় না। আল্লাহর কাছে দোয়া করি -বিয়াশাদী যেন না করি জীবনে, এরকম প্যারা খাওয়ার জীবন আমার না। যা আছি দুর্দান্ত আছি! গত চার বছরে আমার ক্রমশো দুরত্ব বেড়েছে ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের সাথে, তাদের খোজ খালি আমি নিতাম ও সেধে আড্ডা দিতাম তা এখন অফ রাখছি। কারন এক হাতে তালি বাজে না আর তারা সব ভয়াবহ একাকী জীবন চালায় আমার ওইসবে পোষে না। কারন এখনো সেই দুর্দিন আমার আসে নাই যে একা একাই ব্যাস্ত থেকে সবাইকে ভুলে যেতে হবে। আমি এখনো সেইম মাত্রার পুজিবাদী মানুষ না।
এই চার বছরের শেষ দুই বছর কেটে গেছে ব্লগ লিখতে লিখতেই। রাত নাই দিন নাই নিজের দিনলিপির চর্বিত চর্বন খালি লিখে গেছি। কেউ পড়ুক কিংবা না পড়ুক আগ্রহের কমতি রাখি নাই এ নিয়ে। আল মাহবুবে ঝাল ফ্রাই আর নান খাওয়ার পরে যে আনন্দ পাই ঠিক সেই মাত্রার আনন্দ পাই ব্লগ লেখায়। এই ব্লগ লেখার সুবাদেই কিছু বন্ধুর দারুণ ভালোবাসা পেয়েছি যাদের কাছে ঋণের শেষ নাই, ফেসবুকে মেসেজ দিয়ে জোর করে অনেককে লেখা পড়িয়েছি মাকসাদ একটাই আরো কিছুজন জানুক এই আমাকে নিয়ে। নিজের খ্যাতি চাই নি, চেয়েছি নিজের গল্প জানাতে এই অজনপ্রিয় ঝিমিয়ে পড়া ব্লগে! জামালপুর, চিটাগাং যেখানেই থাকি বারবার ফিরে এসে এই ব্লগ লেখা টাকেই নিজের মহৎ কর্ম হিসেবে উদযাপন করেছি!
বন্ধু বিয়েতো একসময় না একসময় করাই লাগবে, যতই তারে প্যারা মনে কর সে তোমার পিছু ছাড়বে না !
তুমি যত বই পড়ছ, এত বই এই বয়সে খুব কম মানুষকেই পড়তে দেখছি। তাই কি পারো আর কি পারো না এসব নিয়ে তুলনা করে কী লাভ ? কয়েকদিন পর (ইনশাল্লাহ) সরকারী আমলা হবা, জীবনে আর কিছু কী দরকার আছে !
আইছে! আগে নিজে বিয়ে করেন মিয়া!
দোয়া রাইখেন ভাইজান
আপ্নের লেখা পড়লে যতটা রিলেট করতে পারি আর আপন লাগে,
আমার ছোট্ট ব্লগ জীবনে আর কোথাও এমন দেখি নাই!
অনেক ভালো লাগলো পড়তে।
অনেক ভালো থাকেন, সুপ্রিয় শান্ত ভাই।
থ্যাঙ্কস এ লট বর্ণ, আমিও তোমার ফ্যান!
মিয়াভাই আমরা যারা এই ব্লগটারে প্রিয়ব্লগ মনে করি, তারা কি জনের কাতারে পড়ি না?
যাউক্গা লেখা সিরাম হইসে, ডাবল লাইক
অবশ্যই পড়ে ভাইজান, আপনারা আছেন বলেই তো লেখা। বিশেষ করে আপনার লেখার আমি একজন প্রথম শ্রেনীর ভক্ত!
থ্যাঙ্কু বস। ভালো থাকেন!
তোমার বই পড়ার অভ্যাসটা ঈর্ষা করার মত! এই অভ্যাসটা ধরে রেখো।
অবশ্যই ভাইয়া, বই পড়া জীবন কল্পনা করতে পারি নে!
দিন দিন পরিধি ছোটই হয়ে যায়। এই অনুভূতিটা কার কাছে কেমন আমি জানি না, তবে আমার আছে কষ্টের।
ব্লগ লেখার আনন্দ তোমার আজীবন থাকুক এটা মন থেকে চাই।
ধন্যবাদ আপু, আজকেও দারুণ কাটলো দিন!
খুব ভাল
ধন্যবাদ!
মন্তব্য করুন