বইমেলা থেকে পাঠ প্রতিক্রিয়া- অয়নান্ত সূর্যের দিন
ঘুরে ফিরে ফেব্রুয়ারী এলেই বাংলা বই নিয়ে হন্তদন্ত শুরু হয়ে যায়, মানের প্রশ্ন আসে, সাপ্লাইয়ের সমস্যা ধরা পড়ে, প্রাপ্তি ও দোকানের সংখ্যা নিয়ে হা হুতাশ উঠে, দাম নিয়ে চক্ষু চড়ক গাছ হয় অনেকের, লেখকের রয়েলিটির প্রসঙ্গ আসে, দেশে কত জন লোক বই পড়ে আর কত লোক মেলায় আসে ঘুরতে, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত চারিদিকে শুনতে হয়। আমার কাছে বই হলো প্রতিদিনের জিনিস, প্রতিমাসে সংগ্রহের জিনিস, জীবন যাপনের প্রতিটা বাকে নিজেকে ঋদ্ধ করার জিনিস। আমার এই সীমিত অর্থের দিন যাপনে প্রতিমাসেই বই কিনে সংগ্রহ করি, ধার নেই ও পড়ি। অথচ এই দেশে মাত্র এক মাসেই বই নিয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা হয়, এক মাসের কয়েকদিন সামান্য কিছু মানুষ অল্প কিছু বই কিনে, ভুষিখোর লেখকেরা বস্তায় বস্তায় বই লেখে, তা কখন মেলায় আসে আর কখন চলে যায় তার হিসাব কেউ রাখে না, এক মাসেই টিভি চ্যানেল ও পত্রিকা গুলোতে বই প্রেম ভাতের ফেনের মত উতলে উঠে, সব শেষ হয়ে শুধু থেকে যায় শুক্রবার পত্রিকার পাতায় সাহিত্য সাময়িকীতে আন্দালীব রাশদীর বংশধরেরা!
তবুও সেই এক মাসেই আমি বই মেলা নিয়ে লিখি, আজ লিখতে বসলাম অবশ্য স্পেসিফিক বই নিয়ে। মেলা থেকে অর্থমূল্যে সংগ্রহিত একটা বই নিয়ে সামান্য কিছু কথা বলবো। রিভিউ না মোটেও এটা, কারন রিভিউয়ের নামে আমি যা লিখি তা মোটেও যুতের কিছু হয় না। আর রিভিউ লেখার মতো বিদগ্ধ সাহিত্য সমালোচনার তাত্ত্বিক জ্ঞান কিংবা ভাষার দক্ষতা আমার নাই। মোদ্দা কথা আমার লেখক হবারও কোনো খায়েশ নাই। কারন হাল আমলের লেখক হতে হলে প্রেস্টিজের পাংচার করে, নিজের অপদার্থ টাইপ লেখাকে বাংলা সাহিত্যের মহান নজির বানিয়ে, ইনিয়ে বিনিয়ে ফেসবুকে মোবাইলে লোকজনের কাছে কেনার জন্য প্রলুব্ধ করতে হয়। তারপর যদি মোটামুটি বেচা কেনা হয় তাহলে তো কথাই নাই, প্রকাশক রয়েলিটি বিহীন আরেকটা বই করার প্রতিশ্রুতি রেখে লেখককে সাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আর লেখলেখি ব্যাপারটা এত সহজ না, আপনার শ খানেক বন্ধু বান্ধব আপনার বই কিনলো তাতেই আপনি নিজেকে লেখক ভাবা শুরু করলেন, এরচেয়ে ছোটোলোকি চিন্তাভাবনা দুনিয়ায় বিরল। আমার মতামত হলো আপনি যদি শখের বসেও লিখেন তাহলেও আপনাকে আগে সিরিয়াস পাঠক হতে হবে, সিরিয়াস ভাবে লেখার ভাষাটা জানতে হবে আর তার চেয়েও বড় ব্যাপার আপনাকে পরিশ্রমী কান্ডজ্ঞান সম্পন্ন ও পর্যবেক্ষক মননশীল মানুষ হতে হবে। এগুলা কোনো ব্যাপারই আমার ভেতরে নাই। আমি শুধু পাঠক হয়েই বেঁচে থাকতে চাই, লেখক হবার কোনো মনোবাসনা আমার অন্তরে কখনোই উকি দেয় না। আশাকরি দিবেও না। তাই লেখক হবার যাবতীয় অপ্রাপ্তি আমি ব্লগ লিখে মিটিয়ে দেই!
যে বইটা নিয়ে বলছি আজ, সেই বইয়ের লেখক আগে আমার ততটা পরিচিত ছিল না, তবে লেখকের আত্মীয় আমার খুবই ঘনিষ্ট বন্ধু। এইসব সম্পর্কের একটাই উৎস তা হলো এই এবি ব্লগ। এবি ব্লগ না থাকলে আমি চিনতাম না ভালো ভাবে লীনা আপুকে, লীনা আপুকে না জানলে হয়তো তাঁর ভাই মোস্তাক শরীফের ' সেদিন অনন্ত মধ্যরাতে' কিনে পড়া হতো না। আর সেই উপন্যাস না পড়া থাকলে, এত আনন্দ নিয়ে তাঁর পরের বই গুলো পড়া হতো না। 'সেদিন অনন্ত মধ্যরাতে' আমার খুব পছন্দের একটা উপন্যাস। চিটাগাং শহরেও অনেক বন্ধুকে জোর করে পড়িয়েছি আর বাসায় মামাকে আল্টিমেটাম দিয়ে পড়িয়ে ছিলাম বইটা। অসাধারণ একটা উপন্যাস, আসলে নিজের কোনো বই ভালো লাগলে তা সবাইকে পড়াতে আমার এক ধরনের সুখ। আমার চাপাচাপিতে কত লোক যে ছফা-ইলিয়াস-মাহমুদুল হক পড়লো সেই হিসেব কখনো করি নাই। গত বারের বইমেলাতেও উনার তিনটে বই আমার সংগ্রহে আসে। সেবার 'যাও উত্তরের হাওয়া' কিংবা 'কত আকাশ কত মৃত্যু' পড়েও দারুণ মুগ্ধ হয়েছি। পড়ার সাথে সাথে জানিয়ে দিয়েছি সবাইকে সেই মুগ্ধতার গল্প। এবার লেখকের বই এলো 'অয়নান্ত সূর্যের দিন'। সম্ভবত ষোলো তারিখে বইটা আমার মেলা থেকে কেনা হয়, উনিশ তারিখে এ সারা সকাল দুপুর জুড়ে বইটা পড়ে শেষ করে দেই। বলতে দ্বিধা নাই, 'সেদিন অনন্ত মধ্যরাতে' কিংবা 'কত আকাশ কত মৃত্যু পড়ে' যত মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়েছিলাম, সেই তুলনায় কিছুটা কম মুগ্ধ হয়েছি এই বইটা পড়ে। হয়তো এক্সপেক্টেশন আরেকটু বেশী ছিল তবুও যা পেয়েছি তাও অসাধারণ। অ্যার্ডন থেকে বইটা বের হয়েছে, দাম কমিশন বাদে ২৭৫ টাকা। লেখকের গদ্যশৈলী অসাধারণ, প্রকাশনার মান খুব ভালো,ভাষা ও কাহিনী নির্মাণ দারুণ। উপন্যাসের প্রধান 'কাবেরী' চরিত্রটাকে তিনি বুনন করেছেন সততার সাথে, লেখকের বর্ননা ভঙ্গি পাঠককে চমৎকার ভাবে কাছে টানে, সব মিলিয়ে একটি আকর্ষনীয় উপন্যাস। এক কথায় আমার খুব ভালো লেগেছে। হতে পারে আমি উপন্যাস অন্য অনেকের মত বেশী বেশী কিংবা ভুড়ি ভুড়ি পড়ি নি, তবুও লেখকের এই বই আমাকে মুগ্ধ করেছে যথারীতি। এবারের মেলা থেকে কেনা একটা বই যা পড়ে আমার মনে হয়েছে ভালো একটা বিনিয়োগ করলাম কি সময়, কি অর্থের। কারন আমার উপন্যাস কম পড়ার একটা প্রধান কারন হলো পড়া শেষে মনে হয় সময়ের অপচয় করলাম! এই উপন্যাস পড়ে বরং আমার মনে হয়েছে আরেকটু সময় নিয়ে পড়লে ভালো হতো!
বেশ ভালো লাগলো লেখাটা।
"আর লেখলেখি ব্যাপারটা এত সহজ না, আপনার শ খানেক বন্ধু বান্ধব আপনার বই কিনলো তাতেই আপনি নিজেকে লেখক ভাবা শুরু করলেন, এরচেয়ে ছোটোলোকি চিন্তাভাবনা দুনিয়ায় বিরল। আমার মতামত হলো আপনি যদি শখের বসেও লিখেন তাহলেও আপনাকে আগে সিরিয়াস পাঠক হতে হবে, সিরিয়াস ভাবে লেখার ভাষাটা জানতে হবে আর তার চেয়েও বড় ব্যাপার আপনাকে পরিশ্রমী কান্ডজ্ঞান সম্পন্ন ও পর্যবেক্ষক মননশীল মানুষ হতে হবে।"
......দারুন কিছু কথা এবং পুরাই আমার মনের কথা!
"এগুলা কোনো ব্যাপারই আমার ভেতরে নাই। আমি শুধু পাঠক হয়েই বেঁচে থাকতে চাই, লেখক হবার কোনো মনোবাসনা আমার অন্তরে কখনোই উকি দেয় না। আশাকরি দিবেও না। তাই লেখক হবার যাবতীয় অপ্রাপ্তি আমি ব্লগ লিখে মিটিয়ে দেই!"
.... এটা একটু self contradictory হয়ে গেলো না? আপনার যেহেতু লেখক হওয়ার কোনো বাসনাই নাই, সেই ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তির ব্যাপারটা অযৌক্তিক; ইচ্ছা আছে, বাসনা আছে, কিন্তু কোনো কারণে হয়ে উঠছে না, তাহলেই সেটা অপ্রাপ্তি....আপনার যেহেতু বাসনাই নাই, কাজেই অপ্রাপ্তির প্রশ্নটা উঠছে না, আর যদি অপ্রাপ্তি থেকেই ব্লগিং করে থাকেন, বলতে হবে সূক্ষ্ম একটা বাসনা তবে মনের কোণে অবশ্যই উঁকি মেরে আছে ........
শুভ কামনা ।
ভালো পয়েন্ট ধরছেন ভাইয়া, আপনে যে আমাকে মোটামুটি চিনে ফেলছেন এই কমেন্ট তার প্রমান, লিখবো ব্লগে যখনই সময় পাই। ভালো থাকেন ভাইয়া, ভাবীকে নিয়ে!
বইটা আমি কিনেছি!
থ্যাঙ্কস ভাই!
রোদ্দুর গানটা শুনসেন? ফ্রম “অভিশপ্ত নাইটি”। শুনে দেখতে পারেন। আমার ভালো লাগে গানটা।
প্রিয়, রোদ্দুর গানটা শুনতে শুনতে কান পচে গেছে, এত বেশী ভালো লাগছিলো!
মন্তব্য করুন