আগুনের কথা বন্ধুকে বলি.........
আজ বিকেলে এক ছোট ভাইয়ের সাথে এ আর রেহমানের কনসার্ট নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো, আমার জাতীয়তাবাদী মন অনেক বয়ান শুনিয়ে দিলো চামে। ছোটভাই টেনশন ছাড়া বলিলো- সমীকরন অতি সহজ, আপনে কবীর সুমন বা অঞ্জন দত্ত আসিলে শার্ট প্যান্ট পাঞ্জাবী বেইচা যেমন দৌড় দিতেন, আমি মেটালিকা আসলে মোবাইল সেট বেচে দিয়ে হলেও দৌড় লাগাতাম, আর যাদের এ আর রেহমান দিওয়ানা সাথে হিন্দি মনস্ক মন তারাও দোড় লাগিয়েছে। তারা বাংলা গানের আর কি শুনবে, যে যারে ওউন করে আর কি! আমিও এই যুক্তি মেনে নিলাম খুশী মনে। আসলে আমরাই আমাদের মত করে স্বদেশী বিদেশী কত কি নিজের বলে ওউন করি। নিজেদের পছন্দ অপছন্দের ভিত্তিতে এক দেয়াল বানিয়ে ফেলি। যা ভালো লাগে না, তা কত খারাপ তা প্রমানে নেমে যাই, আর যা ভালো লাগলো তাকে যত পারা যায় মহান বানাই। আমিও তার বাইরে কেউ নয়!
তবে অনেকের জীবনেই পছন্দ অপছন্দের কিছুই আসে যায় নাই। যখন যে যা বলে তাই করে ফেলে। নিজের ভাবনা সেই কাজের সময় আনেই না। নিজের হাজার অনিচ্ছা সত্তেও সেই কাজ করে যায় অন্যের ইচ্ছাতেই। যেমন কাল আবীর এক বন্ধুকে আড়ংয়ের মোড় থেকে ধরে আনলো আমার জন্যে। চায়ের দোকানে এসেই আমাকে ফোন তোর জন্য সারপ্রাইজ আছে, শীঘ্রই হাজির হ। আমি কি জানি করছিলাম, সব বাদ দিয়ে হাটা দিলাম। গিয়ে দেখি এতো জনি বসা। আজব দুনিয়া, এ কি করে এখানে? জনির সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল গত দশ বছরের মধ্যে ২০১০ এ। চিটাগাং ঘুরতে গিয়েছিলাম এক সন্ধ্যায় এসে কিছুক্ষণ ছিল। লোকজন বেশী ছিল, কিমা পুরি ও চা খাওয়া হয়েছিল কিন্তু আড্ডা জমে নি সেদিন। ভুল বললাম, আরেকবার দেখা হয়েছিল ২০১৩ তে, এক বন্ধুর জানাযায় গিয়েছিলাম নেভাল হেড কোয়ার্টারে, সেদিন কথা হয় নাই কারন মুড অফ সবার। কাল যখন দেখা হলো- আমার প্লেসে চায়ের দোকানে, মন দিয়ে কথা শুনলাম। আমি পুরা বেকুব হয়ে গেলাম কথা বলতে গিয়ে। এ কোন জনির সাথে আমি কথা বলছি, এককালে যার কন্ঠ ছিল সতেজ প্রানবন্ত তার কণ্ঠস্বর কেমন জানি অন্যরকম, যার ছিল সুঠাম স্বাস্থ্য এখন দেখি চিকন, এককালে যার ছিল উড়োজাহাজের মতো ইগো সে দেখি মাটির মানুষ, এককালে যার মেজাজ থাকতো বেশীর ভাগ সময়ই চড়া তার মেজাজ দেখি শান্ত নদীর মতো শীতল, এককালে যে ভারতের সাপোর্টে ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা কথার তুবড়ি ছোটাতো এখন দেখি তাঁর খেলাধুলা নিয়েই কোনো ইন্টারেস্ট নাই। আমি একটু কথা শুনেই জিগেষ করলাম, 'কি রে জনি একি দশা তোর, পুরো দেখি মাইর খায়া গেলি, এ কোন জনির সাথে কথা বলছি আমি?' ও সামান্য হেসে বললো 'দোস্ত তোর আমার আব্বাকে জিগেষ করিস কেমন ছিল তাদের ত্রিশ বছরের সার্ভিস লাইভ, নেভীর সার্ভিসের ক্রমাগত কার্য আর অবগতির চক্করে ডিউটির উপর থেকে থেকে জীবন পুরো তেজপাতা! এই আট বছর তোরা যত আনন্দে থাকছোস, আমরা ঠিক সেই পরিমান মেজাজ খারাপ করা সময় পার করেছি। আট বছরে জব করে একটা সুতাও নিজের জন্য কিনতে পারি নাই। এখনো বাপ যা কিনে দেয় তাই। তার ভেতরে আব্বার অবসরের পর উনি কিডনী সমস্যায় ভুগছেন, বড় বোনের ব্রেনে এক জটিল রোগ হলো, ছোটবোন স্কুলে যায় কি যে এক সময় গেল, সব কর্তব্য আমার উপরে, আমি কি করবো তাই বাপের মতোই অনার্স পড়া বাদ দিয়ে নেভীতে ঢুকে গেলাম। এখন অবশ্য বোনের সমস্যার সমাধান, তারা জামাই বউ দুজনেই ব্যাংক অফিসার, বাবা অসুস্থই, আর বোন ইন্টার দিলো। আমি কথা শুনেই অবাক, আমি যখন শেষ দেখি তখন ওর ছোট বোন ক্লাস ওয়ান না টুতে পরে, মাঝখানে চলে গেল দশ এগারো বছর, কি দ্রুত সময় হারিয়ে যাচ্ছে সব!
চা খাচ্ছিলাম আর ওর গোল্ডলিফ খাওয়া দেখছিলাম। কথা বলছে আর একটার পর একটা খালি সিগারেট ফুকছে। অনেক নেভী অফিসার বন্ধুও আমাদের আছে তাঁদের ব্যাপারে খোজ নিচ্ছিলাম। দুই তিনজন বিয়ে করেছে এইসব নিয়ে আলাপ। আমি অবশ্য কেন জানি ওদের সহ্য করতেই পারি না। তাই গত সাত আট বছরে একবারের জন্যেও এঁদেরকে ফোন দেই নাই। দেখা হলে হাই হ্যালো, না হলে নাই! কিন্তু তসলিমের সাথে আমার কমিউনিকেশন ঠিকই বিদ্যমান। কারন তসলিম কারো সাথেই দেখা করে না, নন কমিশন্ডে ঢূকার পর, আমি নিজে উপযাচক হয়ে যোগাযোগ রাখি। কারন তসলিম হলো আমার একদম বাল্যকালের বন্ধু, একটা সময় সেই বারো তের বছরের দিনগুলোতে আমার অনেক সময় কাটছে গাছের তলায় আমি আর তসলিম গল্প করেই চলছি এই করেই। তবে সামনা সামনি বসে আর আড্ডা মারি না কারন তারা খালি মিরপুর ১৪ তে আসতে বলে আর আমার ঐদিকে যেতেও ভালো লাগে না। যদিও আমার জন্মস্থান ওখানেই। জনির কাছ থেকে তসলিমের ব্যাপারে খোজ নিলাম, তারা দুইজনই এখন আছে নেভাল হেডকোয়ার্টারে, নেভীর উপরে মেজাজ খারাপ হয় প্রায় সময়ই, দুই বন্ধু একত্রিত হয়ে পেটিস আর চা খেয়ে নেভীর গোষ্ঠী উদ্ধার করে যার যার রুমে ফিরে আসে। এদের দুইজনেরই আবার ডিগ্রী কমপ্লিট ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে, আমি তা শুনে হলাম অবাক। বলে ফেললাম তোদের যে স্ট্যামিনা একদিন অনেক বড় হবি। জনি নিরাশ কন্ঠে বলে উঠলো 'বড় হয়ে আর কি হবে, চাকরী চাকরী করে করে অবসরে যাবো, তারপর গার্মেন্টসের সিকিউরিটি ইনচার্জ হবো এই তো'। আমি বলি- 'ধুর কি যে কস না। তোদের জীবনটাও কত অসাধারণ, আমাদের পিতাদের মত চাকরী করবি, মফস্বলের এক মেয়েকে বিয়ে করবি, সুন্দর সংসার হবে, তোর ছেলে আমাদের মত মাঠে সারাদিন ধাবরে বেড়াবে, এক গাদা ভ্যালুস মাথায় ঢূকিয়ে দিবি সন্তানের, সন্ধ্যার পরে বাসায় ফিরলে কোনোদিন দিবি মাইর খিচকে, এক মধ্যবিত্তের নিয়মকানুনে দারুন পরিবেশে তোর ছেলে মেয়ে আমাদের প্রিয় স্কুলে পড়বে। কি দারুন হবে ভাব একবার'! খালি আমাদেরই ঠাই হবে না। জনি হেসে উঠে, হ দোস্ত বাপের এক্সপিরিয়েন্স আমার এক্সপিরিয়েন্স মিলিয়ে পায় ৪০ বছর চলছে নেভীতে। ভাব কি অসাধারণ একটা ব্যাপার। তবে যতই অসাধারণ হোক তোদের মত জীবন আর পেলাম কই? তোর বিসিএসের খবর শুনে কি যে খুশি হইছি। আমার আর কোনো বন্ধু এমন নাই বিসিএসে, আমি বললাম আগে জয়েনিং হোক, তোকে দাওয়াত করে খাওয়াবো। জনি খুব সুন্দর সঞ্জীবের কাভার করতো, ঘুরে ফিরে সেই 'আগুনের কথা বন্ধুকে বলি' গানটাই গাইতো কেনো জানি। আমি মুগ্ধ হয়ে সেই টেনে ইলিভেনেই বলতাম- এই গান সঞ্জীব চৌধুরীর পর তুই ই বেস্ট। আড্ডা দারুন জমছিল কিন্তু ওর বনানীতে যেতে হবে তাই ছেড়ে দিলাম। রিকশায় তুলে দিয়ে আমি আর আবির বলছিলাম, জীবন কত বিচিত্র। একটা বার ভাব, এরোগেন্সের সম্রাট জনি কোনোদিন ভাবছিলো যে তাঁর জীবন এমন হবে। তবে খারাপ কি, চলছে তো ভালোই, গোছানো একটা মধ্যবিত্ত বিচ্ছিন্ন জীবন ওদের, এই দেশে বেচে যে আছি আমরা তাই তো বোনাস! এখানে বেশীর ভাগ মানুষেরই ইচ্ছা অনিচ্ছা পছন্দ অপছন্দের কোনো দাম নাই, এইসবের দাম আছে আমাদের মতো নার্সিসিস্ট বিষণ্ণ বিলাসী সুখী মানুষদের কাছে!
শুরুর আর শেষের কথাগুলি ভাল্লাগছে অনেক..
নতুন লেখার জইন্য থ্যাঙ্কুস।
আমি ফার্স্ট!
ব্লগ লিখো না কেন? নাকি নেটের সমস্যা এখনো বিদ্যমান!
এখন তো সারাদিনই এবি তে অনলাইন। লেখা মাথায় আসে না কিছু, তাই আর সবার লেখা পড়ি আর সময় সময় কমেন্টাই!
এবির প্রতি তোমার এই ভালোবাসা জাতি যুগ যুগ মনে রাখবে
তাই ঠিক। নিজের কথাগুলোই বল বলে তোমার লেখা পড়তে এত ভালো লাগে।
আপনারা পড়েন বলেই তো লেখা
জীবনের স্রোতে কত কিছু যে ঘটে তার ইয়ত্তা নেই। তবু জীবন চলে জীবনের মতই। কারো জন্য থামার অবকাশ তার নেই।
ঠিক কথা!
মনে হচছে নিজেকে দেখলাম তোমার লেখায়
মুগ্ধ হলাম কমেন্টটা দেখে!
মন্তব্য করুন