উৎসবের দিন রাত!
উৎসব যাই হোক আমার গত কবছর ধরে এসব দিনগুলোতে কিছুই ভালো লাগে না। এক বন্ধু বলে বসলো, তুই ক্রিকেটার ট্রেসকোথিকের মত অবসাদ গ্রস্থতায় আক্রান্ত। আমিও মেনে নিলাম যা বলিস তাই। আজ ফেসবুকে সকালে স্ট্যাটাসও লিখলাম যে- আজকাল আমি কোনো উৎসবেই বের হই না, বাড়ীতে থাকলে বাড়ী আর ঢাকায় থাকলে আটপৌরে চায়ের দোকানেই সাধারন একটা দিন পালন। এইটার একটা কারন আমার মনে হলো আজ যে স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে ঢের বেশী ফ্রি টাইম আমি জীবনে পেয়েছি ও পাচ্ছি। তাই একদিনের আনন্দ আমার মনে খুব একটা রেখাপাত করে না। কারন ওরকম দিন রজনী প্রতিমাসেই একাধিকবার আসে। আর আরেকটা কারন হতে পারে গার্লফ্রেন্ড থাকা না থাকা, সাধারণত যাদের গার্লফ্রেন্ড আছে তারাই এখন এসব উৎসবের দিনকে রঙ্গিন করতে উঠে পড়ে লাগে। আর আমার ইদানিং কালের বন্ধুরাও আমার মতোই বোরড, তাঁদেরও কোথাও যেতে ভালো লাগতো না। আর যাদের লাগতো তারাও বের হয় শুধু সকালেই। আর বলে উঠে শান্ত ভাই ই ঠিক কাজ করে, কোথাও যায় না। যে গেঞ্জাম রাস্তায়। এরেই বলে সঙ্গদোষে লোহা ভাসে। আমি অবশ্য এইসব উৎসব দিন হারানো নিয়ে বেশী কিছু চিন্তা করি না। কারন ডলি সায়ন্তনীর একটা গান, যা পারভীন আপুর বড় ভাইয়ের আপলোডে ইউটিউবে শুনেছিলাম, লাইনটা খুব ইন্টারেস্টিং-- চিন্তার চেয়ে চিতার আগুন ভালো। তাই ওতো ভেবে লাভ নাই, বেশী কিছু আশা করেও কিছু নাই, কারন এইদেশে আমাদের জীবন যাপনই এমন বোরিং। কেউ তা স্বীকার করে আমার মতো চুপ থাকে পর্যবেক্ষণ করে, আর কেউ কেউ সব কিছু ভুলে উৎসব আনন্দে মেতে উঠে!
আজও কাটলো সেরকম একটা দিন। কাল রাত বারোটা থেকে শুরু হয়েছে অত্যচার। খোজ নাই খবর নেয় না এমন সব মানুষেরা টেক্সট পাঠানো শুরু করলো। টেক্সট দেখে অবাক হয়ে মোবাইল দিলাম এক ঢেল, পড়লো গিয়ে বিছানায় আর খোজ নেই নাই তার। প্রিয় মানুষদের খালি আমি জানালাম শুভেচ্ছা, তাও সবাইকে না। টেক্সটে শুভেচ্ছা বিনিময় এখন এত বেশী লেইম হয়ে গেছে, আর গৎবাঁধা কিছু কথায় ঠাসা দেখলেই মেজাজ বিগড়ায়। ঘুমালাম অনেক দেরীতে, বই পড়ছিলাম আর নির্ভানা শুনছিলাম। নির্ভানা শুনলেই আমার মন খুবই উদাস হয়। কোথাকার কোন ফিরিঙ্গি গায়ক কার্ট কোভেনের জন্য মনটা বেদনাসিক্ত হয়। এক বিখ্যাত মানুষ হাসান হাফিজুর রহমান, যখন আকস্মিক মরনের পর তাঁর লাশ মস্কো থেকে আনা হয়ে ছিলো বিমানে। তখন সবাই বলছিলো, হাসান তোমার এত তাড়া ছিল কিসের? আমারো মনে হয় কার্ট কোভেনের কিসের এত তাড়া ছিল যে এত অল্পবয়সে সুইসাইড করে মারা গেল। ঘুমোলাম সাড়ে তিনটায়। উঠলাম সাড়ে আটটায়। কারন এক বন্ধুর আগমন সে আমার জন্য সময় রেখেছে তিন ঘন্টা, সকালের নাস্তা করাবে, অনেক কাজ তার, রাতে চলে যাবে চিটাগাং। আমিও কাঁচা ঘুম থেকে উঠে মেজাজ ঠান্ডা রেখে নাস্তা খেলাম ও গপ্প গুজব করলাম। নাস্তা করলো আমার পছন্দের খাবার দিয়েই, খাসীর পায়া আর পরোটা সাথে স্ট্রং লিকারের চা। খেয়েদেয়ে চায়ের দোকানে আসা, ধারনা ছিল বন্ধুকে আড্ডার ফাঁদে ফেলে দুপুর অবধি রাখবো, তা আর হলো না। সাড়ে এগারোতেই চলে গেল, আজিমপুরে অনেক কাজ নাকি তার। আমি বললামঃ যা গোরস্থানে গিয়ে মরে আমাকে খবর দিস। সবাই জানে এসব আমার ভালোবাসার কথা। সাড়ে বারোটার দিকে শান্ত ভাইয়ের বাসাতে গেলাম, কারনে দোকানে বসা যাচ্ছে না রোদে ভস্মীভূত। গিয়ে পাবলিকের ডিমান্ডে খালি চ্যানেলের এ মাথা থেকে ওমাথা ঘোরা, আর হিন্দি গানে থামা। পহেলা বৈশাখেও আমাদের হিন্দি প্রেম প্রবাদ প্রতিম, অনেক জায়গাতেই দেখলাম উৎসবে আনন্দে ব্যাপক সাউন্ডে হিন্দি আইটেম গান শুনছে ও শুনাচ্ছে। আমাদের তারকাদেরেও হিন্দি প্রেম আরেক কাঠি সরেস। টিভি অভিনেত্রী কাম মডেল শখের এক ইন্টার্ভিউ পড়ছিলাম ইত্তেফাকে। সেখানে তার প্রিয় সিনেমা, প্রিয় টিভি প্রোগাম দু জায়গাতেই সব হিন্দি ব্যাপার স্যাপার। অভিনেতা অভিনেত্রীদের নাম বলাতেও শুধু সুবর্না মোস্তফার ঠাই হয়েছে আর সব ইন্ডিয়ান নয়তো কিছু হলিউড। টেলিভিশনে একজন বড় তারকার রুচি ও প্রীতি যদি এই লেভেলের হয় তাহলে দর্শক তাঁদের দেখবে কেন? বাংলা চ্যানেল গুলোতে দেখার মতো আছে শুধু সংবাদ, সংবাদে সেই চার বছর আগেও যা দেখছি এখনও সেই একই। কোনো কিছুতেই নতুনত্ব নেই। চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায় কি বলবে এখন রিপোর্টার, খালি যমুনাতে মিল্কী হত্যাকান্ডের বিচার নিয়ে দারুন এক রিপোর্ট দেখে মুগ্ধ হলাম। ইন ডেপথ রিপোর্টিং যাকে বলে তাই দেখিয়েছে। খেলা দেখলাম ইনডোর ক্রিকেট, গাজী টিভিতে, বালের খেলা। ক্রিকেটের কোনো মা বাপ নাই সেখানে। আর কি জঘন্য ধারাভাষ্যকার, শারাফাত নাই কিন্তু তাঁর বংশধরেরা কোনো কিছুতেই কম না। মুন্নী সাহার এক অনুষ্ঠান বিশ মিনিট দেখলাম, কলকাতার অর্কের ইন্টারভিউ মুলক, নাম- ভরসা থাকুক বাংলা গানে। কলকাতার অর্ককে আমি চিনি আগে থেকেই, তাঁদের ব্যান্ডগ্রুপ 'ফিডলারস গ্রীনে'র গানও শুনি ইউটিউবে। কিন্তু মুন্নী সাহা প্রথমত তাঁর বেশীর ভাগ কথাই শুনে বুঝে নাই কারন সেই লেভেলের মিউজিক ইন্টেলেকচুয়ালিটির উনার নাই। আর আমার মনে হয়েছে, অর্ক ডিসাইড করার কে যে বাংলা গানে ভরসা থাকবে আমাদের, নাকি থাকবে না। কারন বাংলা গান ও বাংলা ভাষা শেষমেষ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের হাতেই ভবিষ্যৎ। আমরা শুনি বলেই এসব টিকে থাকবে, নয়তো কলকাতার বাংলা গান এখন আর সেই সুদিন নাই যে নেতৃত্ব দিবে। তাঁদের অনেক ভালো গান আছে আবার প্রচুর গান আছে যার গান খারাপ না কিন্তু কন্ঠে হিন্দি উচ্চারনের বাটখারা লাগানো। আমাদের দুঃসময় থাকলেও এত খারাপ দিন এখনও আসে নি। বাংলা গানকে বাঁচিয়ে রাখলে রাখবে বাংলাদেশই, কারন যেই রাজ্যে কবীর সুমনের মত মানুষের মুল্য নাই, সেখানে আরেকটা কবীর সুমন আর আসার সম্ভাবনা নাই। আর আমার এক ভাই কলকাতা থেকে ফিরে বলছিলো-- পশ্চিম বাংলার বেশীর ভাগ শিক্ষিত মানুষের আলাপ আলোচনা ও হাকডাক শুনলে মনে হবে বাংলা ভুলে গেছে একযুগ আগেই, তাই বাংলা গানের ভরসা থাকবে এদেশের কারনেই। এমনকি কলকাতার বাংলা গানকেও বাঁচিয়ে রাখবো আমরাই!
শান্ত ভাই আসলো বাসায়, সিরাজগঞ্জের কোন দোকানের দই নিয়ে, দিলাম এক খাওয়া। মিস্টি দই খেতে আমার খারাপ লাগে না, তবে সমস্যা হলো সুযোগ থাকা সত্তেও কিনে খাই না। কেউ সাধলে খাই। বাসায় ফিরলাম, বুয়া কথা দিয়েছিল আসবে, তাই কোথাও দাওয়াত খেতে যাই নি। বাসায় এসে দেখি তিনি আসেন নাই। গোসল ও নামায শেষে দিলাম এক ঘুম। উঠে দেখি সন্ধ্যা। বের হয়ে গেলাম আবার দোকানেই। আশে পাশেই দেখি তিনটা অনুষ্ঠানের স্টেজ। কি হয়, তা না গেলেও শুনা যায় মাইকের গগনবিদারী আওয়াজ। এক স্টেজে চলছে হিন্দী গানের সাথে নাচ, আরেকটাতে এক শিশু গাইছে বাংলা গান। কোনোটাই শ্রবন যোগ্য না। আবার আরেক সাইডে চলছে হাসির চুটকী টাইপের নাটক। আমি খুব অবাক হলাম আগে শুনতাম- পাড়া মহল্লায় আগে কত ভালো ভালো রুচিশীল মানুষের বাস ছিল, তারা রুচিশীল অনুষ্ঠানের ট্রাই দিত, হয়তো এত টাকা র্যাফেল ড্র জুয়ার এইসব ছিল না, তাই বাজেটও ছিল কম কিন্তু সবই হতো স্বেচ্ছাপ্রনেদিত ভালো লাগা থেকে। এখন সব কিছুই এত জঘন্য তাতে রুচির নির্মাণ হবে কি করে? সচেতন ভাবেই আমার মনে হয় আমাদের সাংস্কৃতিক প্রতিভা ও রুচি দিনে দিনে অধঃপতিত হচ্ছে, তাহলে এত মানুষ যে এত সচ্ছল জীবন যাপন করছে তাতে কি কোনো লাভই হচ্ছে না? এইসব ভাবতে ভাবতেই শান্ত ভাইয়ের আগমন। সবাইকে নিয়ে গেল সিপিতে, তিন চারটা স্পাইসি চিকেন আর সসেজ খেয়েছি পশুর মতো, তারপর ৪০০ গ্রাম করে কোক, ফান্টা, খেতে খেতে টায়ার্ড। চায়ের দোকানে ফিরলাম, লোকজনের হাট হলো, সবাই ফিরছে, খোশগপ্পো হলো আমি খালি শুনে টুনে বাসায় এসে পড়লাম। ব্যস, এই করেই শেষ দিন। ফেসবুকে বসেই মনটা খারাপ হলো, এক বন্ধু একটা স্টেটাস শেয়ার করেছে- সেন্ট মার্টিনে ডুবে মরা এক আহসানুল্লাহর এক ছেলের। মনটা বিষণ্ণ হলো, ভাবলাম এত ঝলমলে সবার উৎসব উদযাপন সব ম্লান হয়ে যাবে এক ঘটনার আকস্মিকতাতেই। তাহলে আমার ধারনাই ঠিক, বেশী কিছু আশা করাটাই জীবনের সব চাইতে বড় ভুল। কারন জীবন খুবই ঘটনাবহুল ছোট একটা ব্যাপার, যার অনেক কিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রনের অনেক বাইরে!
বাহ! চমত্কার দিন গেল আপনের।
মোটামুটি গেছে আর কি!
কত চমৎকার করে লিখলা! কত কিছু বললা একই লেখায়! তবে শেষে এসে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। এমনি উদাস লাগছে বেশী
কত চমৎকার করে লিখলা! কত কিছু বললা একই লেখায়! তবে শেষে এসে মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
থ্যাঙ্কস এ লট আপু!
আরো কিছু ভাবছিলাম লিখবো বলে, লেখা হলো না আর!
নব বর্ষে জীবন আরো দারুন হোক
তুমিও ভালো থাকো!
মন্তব্য করুন