সেই ফুলের দল!
মনটা ভালো কারন একের অধিক। প্রথমত, মামার গৃহে প্রত্যাবর্তন অনেকটা সুস্থ হয়ে। যদিও ডাক্তার বলেছে রেস্টে থাকতে দু সপ্তাহ, তার আগেই মামা অফিস শুরু করেছে আজ থেকে। যদিও আমাদের এই গৃহ সুস্থ মানুষের জন্যই বসবাস আশংকাজনক, তবুও মামাকে দেখে আমি খুব শান্তি পাচ্ছি। খুব মিস করেছি মামাকে, আসলে আমাদের জীবনে কারো শুন্যতা ছাড়া বোঝা কঠিন যে মানুষটাকে আমরা কত ভালোবাসতাম। আমি অবশ্য এদের বাইরে, আমি থাকতে থাকতেই বুঝে যাই মানুষটা আমার খুব প্রিয়। তবে মানুষ এইসব নিয়ে ভাবে কম। যখন যার সাথে থাকে তখন তার সাথেই অন্তরঙ্গ হয়; সময় শেষে আর মনেই রাখে না। আমার ভার্সিটির এক বন্ধু ছিল, ছিল মানে এখনো আছে খালি যোগাযোগটাই নাই তেমন। ভার্সিটিতে থাকতে মনে হয়েছে আমার এই বন্ধু ছাড়া আমার চলবে কিভাবে? প্রতিদিন কি পীরিতি, ক্লাসে না গেলে বাসায় আড্ডা দেই হররোজ, এখন দেখি দিব্যি চলে যাচ্ছে তাকে ছাড়াই, সে ড্রাগন এয়ারের মাঝারি সারির কর্মকর্তা, সময় কম তাই গত দু বছর ধরে দেখাই হয় না। এরকম আমার আরেকটা বন্ধু ছিল ভার্সিটিরই, আমাকে খুব মানতো ও আমার কথা খুব শুনতো। তার বিপদে আপদে জান কোরবান করে ঝাপিয়ে পড়াই ছিল আমার কাজ। কিন্তু সেই বন্ধুও মিরপুরে থাকে আর যোগাযোগ নাই কথাও হয় না। অনেকদিন পর দেখা হয়েছিল দেখি কথা খুঁজে পাচ্ছে না, হাই হ্যালোর বাইরে। আমি নিষ্কৃতি দিলাম। এইভাবেই একসময়ের সব চাইতে আপন বন্ধুরা অনেক দুরের। তবে আমার স্কুল কলেজ কিংবা চায়ের দোকানের বন্ধুরাই মনে হয় থেকে যাবে না চাইতেই। তাও ভরসা পাই না, তাই এখন আমি সবার সাথেই বন্ধু হবার চেষ্টা করি, হোক রিক্সাওয়ালা থেকে চায়ের দোকানদার সবার সাথেই আপন আপন ভাব নেই। এমন একটা ভাব যেন আমার চেয়ে সহৃদয়বান মানুষ জগতে বিরল।
দ্বিতীয় কারনটাও হঠাৎ করে পাওয়া। অনলাইন এক বাংলা নিউজ সাইটে দেখলাম, কবীর সুমন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে এবার, জাতিস্মর সিনেমার জন্য। এছাড়া আরো তিন ক্যাটাগরিতে এই সিনেমা পুরষ্কার পেল এবার। মনটা ভালো হয়ে গেল। যাক জীবন সায়ান্হে এসে কবীর সুমন তার রিসেন্ট কাজের জন্য কিছু একটা রিকগনিশন পেল। বাংলা গানে কবীর সুমনের অবদান নিয়ে আমি জানি আগামীতে দিস্তে দিস্তে লেখা হবে যখন উনি থাকবেন না। যেমন মহিনের ঘোড়াগুলির গৌতম চক্রবর্তী ওরফে মনি দার কথাই ধরেন। তিনি চলে যাবার পরেই সবাই উপলব্ধি করলো তাঁদের গানের শক্তি ও সৃজনশীলতার জায়গাটা। রুপংকরও এবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার পেল, এ তুমি কেমন তুমি গানটার জন্য সেই একই মুভির। রূপঙ্কর একবার আফসোস করে বলেছিল, বাংলা গান গেয়ে আসলেই কোনো দাম নেই। এরচেয়ে সস্তা দু চারটা হিন্দি গান গাইলে এই বাংলাতেই বেশী মানুষের মুল্যায়ন পাওয়া যায়। আশা করি এবার তার আফসোস কাটবে। আমার সৈয়দ শামসুল হকের একটা কথা মনে পড়ে গেল-- যখন দেশ পত্রিকায় আমার কবিতা ছাপায়, তখন চারিদিক থেকে ফোন আসছে, সবাই প্রশংসায় আটখানা কিন্তু আমি যে গত ৩৩ বছর ধরে কবিতা লিখছি ঢাকার কত কাগজে কবিতা ছাপা হয় কখনো দু চারটা ফোনও আসে না, আসলে আমরা মুখিয়ে বসে থাকি ভিনদেশীদের মুল্যায়নের আশায়।
আহসানুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছেলে সেন্টমার্টিনে মারা গেল। তা নিয়ে সবারই মন উদাস আমিও তার ব্যাতিক্রম না। মানুষের আকষ্মিক মৃত্যু আমাকে খুবই নাড়া দেয় মনে হয় আমিও মারা যাবো। এইভাবে হাহাকার হবে, এক দুইদিন পরে সবাই স্বাভাবিক, মাঝখান থেকে এই অসাধারণ দুনিয়ার আলো বাতাস থেকে বঞ্চিত হবো একা আমি। সাব্বির ছেলেটাকে আমি চিনি না, তবে তার পারসোনাল ফটো দিয়ে বানানো ভিডিও আজ আমার দুপুরটাকে স্পয়েল করেছে। চোখ থেকে পানিও আসলো। তবে বিকেলে ঘুম থেকে উঠে মনে হলো ভিডিওটা না শেয়ার করলেই ভালো হতো। একজন মৃত মানুষের জলজ্যান্ত পারসোনাল ভিডিও এইভাবে সবাই দেখা খুব একটা শোভন ব্যাপার না। তার যে প্রেমিকা সেতো বেঁচে আছে, এই ভিডিওটা তার আহত হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করার জন্য যথেষ্ট। আমার ভাইয়াদের আমলেও খুলনা ভার্সিটিতে এর চেয়ে বেশী ছেলেমেয়ে মারা গিয়েছিল খুলনার কটকায়, তখন ফেসবুক ছিল না তাই এতো শোকের মাতম হয় নি, একদিন কাগজের বড় হেডলাইন হয়েই ব্যাপারটা হারিয়ে গেছে দেশের হাজারো ইস্যুর সমুদ্রে। কিন্তু যাদের আপন মানুষ হারায় তারাই বুঝে কি কষ্ট, মানুষের এরকম আকষ্মিক দুর্ঘটনা গুলো খুবই বেদনার। সংখ্যাতত্ব দিয়ে তা মাপা যাবে না, কারন আমি মরলেও সংখ্যাটা মাত্র ১ই, কিন্তু তাতেই আমি হারিয়ে যাবো এই মহাকাল আর এই মহাজীবন থেকে, আর রেখে যাবো পাহাড়ের মতন কষ্টের বোঝা আপনজনদের কাছে!
তাই মন ভালো থাকার দুটো কারনেও শেষমেষ মন ওতো বেশী ভালো থাকে না। এক লেখক বলেছিলেন, সাহিত্যিকদের মন খারাপ করতে নেই। আমি সাহিত্যিক কিংবা লেখক কিছুই না তাই অধিকাংশ সময়তেই আমার মন খারাপ থাকে। ধারনা করি এই জিনিস এই দেশে প্রায় সবারই হয়। কেউ তা মেনে নেয়, কেউ তা অস্বীকার করে। শিরোনামটা এক গান থেকে নেয়া, মহীনের ঘোড়াগুলির এই গানটা আমার ভীষন প্রিয়। গানটা শুনলেই কিছু মানুষের জন্য মনটা বেদনায় ভরে উঠে। বেঁচে থাকলে এরকম অন্তহীন বেদনার ভেতর দিয়েই যেতে হয়!
সেই ফুলের দল-- মহীনের ঘোড়াগুলি
রাবেয়া কি রুখসানা, ঠিক তো মনে পড়ে না / অস্থির এ ভাবনা, শুধু করে আনাগোনা।
ফেলে আসা দিন তার মিছে মনে হয় / নামে কিবা আসে যায় ...
সোহাগে আদরে জানি রেখেছিল কেউ এই নাম।
আব্বা না আপা নাকি, কারো মনে পড়ে তাকি / তোমরা তা জানো নাকি, সময় দিয়েছে ফাঁকি।
অভিমানী সে মেয়েটি গেছে হারিয়ে ... / বুকে ভরসা নিয়ে ...
সীমান্ত পেরিয়ে সে এসেছিল ছেড়ে তার গ্রাম।
জানি সে কোথায়, এই শহরের কোনো বাগানে সে হয়ে আছে ফুল
প্রতি সন্ধ্যায়, পাঁপড়ি মেলে দিয়ে সে আবার ভোরে ঝরা বকুল।
সেই মেয়েটির মতো, আরেকটি মেয়ে সে তো, সন্ধ্যা-প্রদীপ দিত / যত্নে গান শোনাত।
হালকা পায়ে বেড়াত বেণী দুলিয়ে / কে যে নিলো ভুলিয়ে ...
খেলার সাথীরা তার খুঁজতে আসে না আর রোজ।
লক্ষ্মী নামের মেয়ে, আজ ও তার পথ চেয়ে / ফেলে আসা তার গাঁয়ে মা কাঁদে মুখ লুকিয়ে
সন্ধ্যেবেলায় শাঁখ বাজে না তো আর ... / এতে আছে কি বলার।
আজ ও কেউ জানে না তো কোথায় সে হয়েছে নিখোঁজ ....
জানি সে কোথায়, এই শহরের কোনো বাগানে সে হয়ে আছে ফুল
প্রতি সন্ধ্যায়, পাঁপড়ি মেলে দিয়ে সে আবার ভোরে ঝরা বকুল।
লক্ষ্মী-রুখসানারা, আরও যত ঘরছাড়া / ত্রস্ত ও দিশেহারা, তখন-ই জাদুকরেরা
নিমেষে বানিয়ে দেয় বাগানের ফুল / ঠিক নির্ভুল।
এভাবে মেয়েরা সব একে একে ফুল হয়ে যায় ...
নতুন বাগানে এসে, নিজেকে না ভালবেসে / ফুলের দলেরা শেষে কথা বলে হেসে হেসে
পদ্ম, গোলাপ, জুঁই, চম্পা চামেলী / ওলো টগর, শেফালী।
পোড়ার মুখীরা তোরা ফুল হয়ে রয়ে গেলি হায় ....
নস্টালজিক হয়ে পড়লাম কেনো জানি !
অনেক ভালো লাগলো লেখাটা ছোট ছোট বেশ কিছু কারণে।
ভালো থাকেন, আরামে থাকেন।
থ্যাঙ্কস ভাইয়া, আপনাদের ভালো লাগায় মুগ্ধ হই!
আমরা সংখ্যাই দেখে যাই কেবল, নিজেকে সংখ্যা হিসেবে দেখি না কখনো।
সেটাই, সবারই সময় ফুরিয়ে আসছে!
এই বিষয়টা আমাকে খুব কষ্ট দেয়।



মামা ফিরে আসছে, তোমার তো আনন্দ আর আনন্দ।
কাল যখন শুনলাম কবির সুমন পুরস্কার পেয়েছে, তখনই মনে হলো যে শান্ত নিশ্চয়ই খুবি খুশী হয়েছে।
মানুষের আকস্মিক মৃত্যু বড়ই বেদনাদায়ক। আপনজনদের দুনিয়টাই নিশ্চয়ই শূণ্য হয়ে যায়।
আমার পছন্দ অপছন্দ নিয়ে এত ভাবেন আপনারা, অবাক হই!
ভালো থাকেন আপু।
আমার ছোট বোনের ক্লাসমেট সবগুলা। সাব্বির, উদয় আর বাপ্পী ওর সবচে ভালো তিনজন বন্ধু। সাব্বির ছেলেটাতো অসম্ভব ভালো একজন ফটোগ্রাফার। ওর ছবি লন্ডনে প্রদর্শনীর জন্য সিলেক্ট হইসে। মনটা ভাল নেই।
তাই নাকি?
তাহলে তো তোমাদের মন বেশী খারাপ
রুপংকর এর গানটা জাষট অসাম। মুভিটা এখনো দেখা হয়নি, নামিয়েছি
শেষের গানটির কথাগুলো মণ খারাপিয়া --- শুনবো এখন
আপনাদের নববর্ষ বরন অনুষ্ঠান কেমন হলো আপু? তা নিয়ে পোষ্ট চাই!
এই লেখাটা দুইটা আলাদা লেখা হিসেবে পোস্ট করলে আরও ভালো হইতো।
সহীহ বলেছেন জনাব, কিন্তু আমার ওতো প্ল্যান আসে না, যাই ইচ্ছে হয় তাই লিখে ফেলে পোষ্ট দিয়ে দেই!
মন্তব্য করুন