মেজর হায়দার ও তাঁর বিয়োগান্ত বিদায়ঃ ব্লগ বুক রিভিউ
অনেক দিন বই পুস্তক নিয়ে পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখি না। লিখি না বলে পড়া বন্ধ নাই বই, ইচ্ছে করেই লেখা হয়ে উঠে না। আমার ব্যাক্তিগত অভিমত- ভালো বুক রিভিউ লিখতে পারি না, তাই লেখায় এই অনীহা। তবে বই নিয়ে লিখতে কার না ভালো লাগে। ফেসবুকের বইপড়ুয়া গ্রুপেও কখনও লিখতে যাই না, কারন ওখানে কত পারু খা- পড়ুয়া মানুষরা থাকে, সেখানে আমি বই নিয়ে কাকেই বা কি জ্ঞান দিবো। তাই খারাপ হোক ভালো হোক আমার বই নিয়ে লেখার জায়গা তো ব্লগেই। নিজের ইচ্ছে মতো মতামত দেই, বই নিয়ে ডিটেইলসে আলোচনায় যাই কম, ভালো লাগা মন্দ লাগাই আসল কথা। আমি সেই পছন্দ অপছন্দের একচোখা চোখ দিয়েই দেখি লিখি পড়িও।
প্রথমা পাবলিকেশন্সের অন্যতম সেরা বই বলে মনে হলো বইটা। এমন কি তাঁদের রক্ষী বাহিনীর সত্য মিথ্যা বইটার চেয়েও অসাধারণ একটা বই। বইটা সবাই কম বেশী পড়ে ফেলেছে। আমি পড়লাম নিজে কিনে এই মেলায়, অনেক দিন পর। মুক্তিযুদ্ধে একজন গেরিলা কমান্ডারের অসাধারণ সাহসিকতা ও হুট করেই সাতই নভেম্বর আকষ্মিক খুন হওয়া এক যোদ্ধার অপূর্ব জীবনের গল্প। বইটার সব চেয়ে সুবিধার দিক হলো লেখক জহিরুল ইসলাম, মেজর হায়দারের কোনো আত্মীয় ছিলেন না। লেখক ছিলেন মেজর হায়দারের গেরিলা বাহিনীর একজন বিখ্যাত ছাত্র। ইতিহাসের দায় মেটানোর স্বার্থে তিনি বিশাল কৃষিবিদ হয়েও লিখতে বসেন এই প্রামান্য গ্রন্থ। তিনি সমানে ইন্টারভিউ নিয়েছেন, লেখা সংগ্রহ করেছেন, মেজর হায়দারের পরিবারের জীবিত সদস্যদের বাড়ী বাড়ী ঘুরেছেন, সব কিছু ক্রস চেক করে তিনি লিখেছেন এই বইটা। এই বইটা বাংলাদেশের প্রত্যেকটা তরুনের পড়া উচিত, কারন বাঙ্গালীর পক্ষে যেই মাত্রার সাহসী হওয়া সম্ভব তা মেজর হায়দাররা হয়েছিলেন ১৯৭১ এ, আমাদের এই জেনারেশনের ধারনা জন্ম থেকেই বাঙ্গালী জাতি এমন সুবিধাবাদী, সেই অঞ্চলেও এইসব বীরেরা জন্ম নিয়ে ছিল। এই বইটায় সেক্টর টুয়ের গেরিলা অপারেশন ও ট্রেনিং নিয়ে দারুন সব অভিজ্ঞতার বর্ননা দেয়া। আর সেই গেরিলাদের এক অসাধারণ শিক্ষক ছিলেন তখনকার ক্যাপ্টেন হায়দার। বইয়ের বর্ণনাতেই আছে কি মমতা আর অসীম ধৈর্য নিয়ে তিনি তরুন গেরিলাদের প্রস্তুত করতেন। পাকিস্তান থেকে কঠিন গেরিলা ট্রেনিংয়ের সব বিদ্যা নিংড়ে দিয়েছেন ছাত্রদের। যে সেনাবাহিনীর চাকরী জন্য উনি পাকিস্তানের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন বাপ মাকে ছেড়ে, সেই চাকরী থেকে তিনি কত কঠিন পথে পালিয়েছেন এক মিনিটের সিদ্ধান্তে, দেশপ্রেমকে সঙ্গী করে শুধু। ওসমানী সাহেব উনাকে এত স্নেহ করতেন, যে নাম ধরে ডাকতো না, সব সময় 'মাই ডিয়ার সান। বইটায় লেখক দেখিয়েছেন কি ব্যাপক পরিশ্রম করে তিনি সেক্টর টুয়ের গেরিলা কমান্ড বলেন, বাংলাদেশ হাসপাতাল বলেন, আর ট্রেনিং শিবির ব্যাবস্থাপনা বলেন সব কিছু নির্মাণেই তাঁর ব্যাপক ভুমিকা রেখে গেছেন। তাঁর বোন খেতাব প্রাপ্ত ডাক্তার সেতারা বেগম সহ তাঁর আত্মীয় পরিজন যাদেরকেই পেরেছেন এই যুদ্ধে শরীক করেছেন। বইয়ের পাতায় পাতায় আছে সমস্ত প্রতিকুলতাকে হারানোর গল্প, আর গেরিলাদের সাফল্যে শিশুর মতো আনন্দে মেতে উঠার গল্প। বিজয় দিবসের দিনেও তিনি অন্যতম সংগঠক আত্মসমর্পণের, তাঁর সেই পাকিস্তান থেকে কেনা লাল জ্যাকেট পরিহিত ভারতের জেনারেলদের সাথে দৃঢ় ভাবে হেটে যাওয়া ছবি ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। আমার নিজের এক ভাবনা আসছে বইটা পড়ে, যে সবাই বলে বাঙ্গালীর ভিতরে লিডারশিপ দেয়ার কোয়ালিটি নাই, কথাটা পুরাই মিথ্যে। মুক্তিযুদ্ধের একেকজন সেক্টর কমান্ডারদের যে অসাধারণ লিডারশীপ কোয়ালিটি ছিল আমরাই তাদেরকে মেরে তা ধ্বংস করেছি। বইটায় কয়েকজন গেরিলার ভাষ্য আছে তাতেই বোঝা যায় যে খালেদ মোশারফ, হায়দার, হুদা, তাহের, জিয়া শাফায়াত জামিলরা কি অকুতোভয় দেশ প্রেমিক কমান্ডার ছিলেন। এমন কি বিজয়ের পরেও টালমাটাল পরিস্থিতিতে মেজর হায়দার যেভাবে তাঁর বিগ্রেড ও ঢাকা শহরকে সামলেছেন তা অকল্পনীয়। বইটা পড়েই জানলাম তিনি টিভি রেডিও সব জায়গাতেই ছিলেন সেই অল্প কয়দিনের জন্য মুক্তিযোদ্ধা ও প্রশাসনের মুখপাত্র। গেরিলাদের মনের অবস্থা তিনি বুঝতেন খুব ভালো মতো। প্রত্যেকটা গেরিলা যোদ্ধার কাছে তিনি ক্যাপ্টেন। জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিন গুলোতেও পাবেন, ক্যাপ্টেন হায়দারের উপস্থিতি। রুমীর শাহাদাত বরন ও উনার স্বামী্র আকস্মিক মৃত্যুতে যখন শোকের সাগরে ভাসছেন, দেশ স্বাধীন হবার পরেও। তখন তিনি একদল গেরিলা নিয়ে ঢুকেন রুমীদের বাসায়। সান্তনা দেন না। বলেন আমার বডিগার্ড দরকার জামীকে আমার কাছে রেখে দেই কয়দিনের জন্য , সেই কথা শুনে শহীদ জননীর সন্তান জামীর মনটা ভালো হয়। যুদ্ধে না যেতে পারার যে যন্ত্রনা তা এক মুহূর্তেই ভুলে যায়। এইভাবেই মেজর হায়দার ঢাকার প্রত্যেকটা গেরিলার ছিলেন খুবই আত্মার ক্যাপ্টেন। ৭৩ সালে বিচিত্রাতে তাঁর এক গেরিলা ছাত্র এই নিয়ে লিখেছিলেন অসাধারণ এক স্মৃতিকথা, নাম, উই স্যালুট ক্যাপ্টেন হায়দার!
দেশের জন্য যিনি এইভাবে নিবেদিত প্রান সেনা কর্মকর্তা, সেই তিনি কুরাজনীতির শিকার হয়ে বদলী হয়েছেন কুমিল্লায় ও বান্দরবনে। বিয়ে থা করেন নি। কোনো কিছুতেই না থেকে শুধুমাত্র খালেদ মোশারফের কথিত কাছের মানুষ হবার সুবাদে খুন হয়েছেন এক সাথে। যে মানুষটা ছিলেন তীব্র জাতিয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক, ভারতীয় সৈন্যরা কবে যাবে তা নিয়ে উৎকণ্ঠিত, ভারতের অফিসারদের সাথে কথা বলতেন চোখে চোখ রেখে, তাকেই মারা হয়েছিল ভারতের দালাল খেতাব দিয়ে। তিনি যদি বাবার অযথা টেলিগ্রামে ঢাকায় না আসতেন তাহলে হয়তো তিনি বেঁচেও থাকতেন আরো কিছুদিন। বইয়ের ভেতরে আছে তাঁদেরকে মেরে নাকি কোন অফিসার জিয়াকে দিয়েছিলেন উপহার। সেই জিয়ারাই এখন মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক আর মেজর হায়দারদের মতো সাহসী গেরিলা কমান্ডাররা বিস্মৃতপ্রায় মানুষ। এই বইটা সবার পড়া উচিত, কারন এক জন মুক্তিযোদ্ধার দেশ স্বাধীনের পেছনে অবদান এবং সেই স্বাধীন দেশেই স্বজাতির হাতেই শহীদ হবার এক নির্মম ট্রাজেডীর অসাধারণ বয়ান!
এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম । বইটি হাতে পেলে অবশ্যই পড়তাম ! নিয়তির অভিশাপ হয়তো । নইলে আমাদের সব কিছুতে রাজনীতি ঢুকে থাকবে কেন ? আমাদের বেশিরভাগ প্রিয় মুক্তিযোদ্ধারা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়বেন কেন ? বঙ্গবন্ধুইবা তাজ উদ্দীনের মতো পরীক্ষিত সৎ বন্ধুকে সড়িয়ে মীর জাফরকে কাছে টানলেন কেন ? অনেক কেনর উত্তর নাই । মোর অর লেস্ আমরা আমাদের শ্রদ্ধ্যেয় অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে কলঙ্কিত করেছি, আজও করছি । বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকি এখন রাজাকার !
জিয়া ক্ষমতায় ছিলেন, কাদা তার গায়ে বেশি লাগবে, এটা স্বাভাবিক । কিন্তু খালেদা-হায়দাররাই বা কি করতে চেয়েছিলেন সেদিন ! কেনইবা প্রিয় মুক্তিযোদ্ধা খালেদ ৪ থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতা সংহত করার কোনো চেষ্টা নাকরে বঙ্গভবণে খুনিদের সাথে দরদকষাকষিতে ব্যাস্ত ছিলেন !
দেশ চেয়েছিলাম, পেয়েছি । কিন্তু এ কোন দেশ ? যেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে চুরি-চামারি, গুম-খুন-ধর্ষণ, লুঠ-পাঠ নিত্যদিন ! আর কত খালেদ-হায়দার-জিয়ারা নিহত হলে আমাদের শাপমোচন, পাপমোচন হবে ! বা আর কতদিন রাজনীতির বেশ্যারা জাঁকিয়ে রাজত্ব করবে !
কিভাবে নেবেন জানিনা । ক্ষোভ ছিল, ঝেড়ে দিলাম । ভুল হলে ক্ষমা করবেন । ভাল থাইকেন ।
আপনার মতামত সাদরেই গ্রহণ করলাম, থ্যাঙ্কস এত ভালোবেসে পড়ার জন্য!
ভাল রিভিউ হয়েছে, বইটি পড়তে ইচছে করছে
রেখে দিবো নি, দেশে আসলে নিয়ে যায়েন!
কতকিছু পড়তে বাকি, জানতে বাকি। কবে পড়বো এগুলা কে জানে? বরাবরের মতোই লেখা ভালো হয়েছে।
থ্যাঙ্কু ম্যাঙ্কু!
মন্তব্য করুন