জীবন আসলে বাঁধা পাকস্থলীতে!
আমার এক বন্ধু জন্মসুত্রে হিন্দু, বাস্তবে নাস্তিক সে চান্স পেলেই এক ডায়লগ দেয়-- খাওয়ার কোনো ধর্ম নেই। আমি কথাটা শুনে হাসি। খাওয়ার ধর্ম নাই কিন্তু আমরা পালন করি না করি, কিছুটা হলেও ধর্ম আচারের প্রতি বিশস্ততা আছে সবার। তাই আমার পক্ষে সব কিছুতে ধর্মের বিপক্ষে যাওয়া সম্ভব না। আর সামান্য ইন্দ্রিয়সুখের জন্য হারাম খাবার গ্রহণের কোনো মানে নাই। যা ভালো লাগে তাই খাই, না পেলে আফসোস নাই। মদ গাজা বন্ধুরা খায় তাকিয়ে শুধু দেখি। এক্সপেরিমেন্টেও টেস্ট করা হয় নাই। এডভেঞ্চার প্রিয় বন্ধুদের কাছে আমার সমন্ধে মুল্যায়ন, জীবনে তো কিছুই করলি না, পুরাই নিরামিষ। জীবন নিরামিশ হলেও নিরামিশ আমার ভালো লাগে। বাবা মা যখন ছিল তখন আমি এইসব সব্জী কব্জি কিছুই খেতাম না। এখন অবশ্য সব খাই, তিতা করল্লা উচ্ছে থেকে শুরু করে লাউ চালকুমড়া সবই গিলি। খেতে হয় এখন প্রয়োজনেই মুলত, বুয়ার যে রান্নার প্রতিভা তাতে যুতের খাওয়া এখন সব বাইরে কিংবা কারো বাসায় দাওয়াতে। আর বাড়ীতে গেলে। তবুও বুয়ার সেই- বেশি হলুদ তেল দেয়া রান্না খেয়ে খেয়ে ভুড়ি খালি বাড়ছে। অনেকে আমাকে বলে রান্না শেখো, আমিও ভাবছি কিন্তু শেখার আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নাই। কারন আমার হিসেব হলো ১০০ টাকা দিয়ে বাইরে খেলেই যেখানে কাজ কমপ্লিট, সেখানে ১২০ মিনিট রান্না ঘরে থাকা, রান্না করা, খাওয়া, বাসন মাজা এক বিশাল ঝামেলা। যেইসব মেয়েরা এখনও নিয়মিত রান্নাবান্না করে তাঁদের আসলে আমি সালাম জানাই। কারন এই গরমে চুলার ধারে বসা, ভালো রান্না করা, না ভালো হলে খোটা শোনা ব্যাপক যোগ্যতার ব্যাপার। আমার বন্ধুর মুখে এক গল্প শুনলাম সেদিন, যে তাঁর বন্ধু আর আরেক কলিগ স্বামী স্ত্রী, দুজনেই। খালি বাসায় থাকে ঘুমাতে। সকালে বের হয় বাইরে নাস্তা, দুপুরে অফিসে লাঞ্চ, আর রাতে খেতে হয় বাইরে নয়তো কারো বাসায় দাওয়াত নেয়, নয়তো বোনের বাসায় সেখানে গিয়ে যা পায় তাই খেয়ে আসে। এই করেই চলছে আধুনিক যুগের ব্যস্ত সংসার!
আমারও কয়েকজন বন্ধু আছে, যাদের কাছে গেলেই ভালো মন্দ খাবারের ঢামাডোলে পড়তে হয়। আমিও ভালোবেসে খেয়ে আসি। আসলে আমাদের মানুষকে সমাদর করার ওয়ে একটাই। সেটা হলো খাওয়াও বেশি আইটেম, জোর করে। কলকাতার লোকজন এই বঙ্গে আসলেই পত্রিকায় গল্প করে আমাদের আতিথেয়তার। আমি চিন্তা করলাম এর একটা কারন, আমরা সাধারন মানুষই আসলে বেশী খাওয়াই আর খাই। তাই ওদেশ থেকে কেউ আসলে মুগ্ধ হয় এত খানা খাদ্য কেই বা কারে খাওয়ায়, তবে আমাদের দেশে স্ট্রীট ফুড তেমন কিছুই না। স্ট্রিট ফুড মানেই এদেশে গরু ছাগলের পার্স পাতি দিয়ে বানানো হালিম, অজ্ঞাত উৎস থেকে সংগ্রহ করা বট ভাজি খেতে হয় পরোটা দিয়ে, আর চটপটি ফুচকা কিংবা টেস্ট ছাড়া ঝালমুড়ি এই তো। সাধারণ হোটেল গুলোতেও খাবার সব বুয়ার রান্না মতো কোনোরকম কিংবা জঘন্য। তা খেয়ে মানুষের বছরের পর বছর দিন কিভাবে কাটছে তাই ভাবি। তাই আমাদের পেটে গ্যাস্ট্রিক আর জিহবা স্বাদহীন। ভালো খানা খাদ্য ভালো হোটেল রেস্তোরায় যাবেন, দামও দিতে হবে বেশী। দাম নিয়ে প্রশ্ন করবেন, আপনাকে ক্ষেত ক্ষেত ট্রিট পাবেন। আপনার সঙ্গীরা আপনাকে বুঝাবে যে আপনি এখানে এইসব প্রশ্ন তুলতে পারেন না। আমার যুক্তি হলো খাচ্ছি নিজের টাকা শ্রাদ্ধ করে সামান্য মন্তব্য করতে পারবো না খাবার নিয়ে। এতো গার্লফ্রেন্ডের রান্না না, যে যাই বানাক খেয়ে বিশাল ভালো হয়েছে বলে সার্টিফিকেট দিতে হবে। তাই এখন আগের মতো দলবেঁধে বাইরে খাই না। খেলে সর্বোচ্চ চাপ খাওয়া কিংবা নাহারে গিয়ে গ্রীল খাওয়া। একা একা খাই কিংবা কাউকে খাওয়াই যখন তখন আল মাহবুবই ভরসা, তাঁদের কাছের মানুষ আমি তাই আদর যত্ন করে খাওয়ায়। আর খাওয়ারো কম দাম, চাইলে চার ঘন্টা বসে থাকো না অর্ডার দিয়েই, কেউ নেই বাঁধা দেয়ার।
এই জাতিরই খাওয়া খুব পছন্দের, যাই করেন তাই করেন খাওয়াবেন কিনা সেটাই মুখ্য। না খাওয়ালে লোক নাই, খাওয়ালে সবাই আছে। আমি খুব কম যাই বিয়েতে, যে অল্পকয়টাতে যাই দেখি মানুষের খাওয়ার প্রতি কি আকাঙ্ক্ষা। এসেই খাওয়ায় মত্ত। তাঁদের পাল্লায় পড়ে আমারও খেতে হয়। দেখি হেভি খানাদানা দিয়ে মুখে ডায়লগ ফুটে, এইসব রিচ ফুড ওতো খেতে পারি না। আহা কি অমৃত বচন। শুনলেই মন ভরে যায়। ১০ টা সেভেন আপ খোলার আওয়াজের মতো ঢেঁকুর দিতে দিতে যারা টেবিল ছাড়ে তারাই এসব বেশী বলে। কাল ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যু বার্ষিকীর মিলাদ সাথে তেহারী। দেখলাম বিএনপি আওয়ামীলীগ নাই, দল বেঁধে সবাই খাচ্ছে। বিকেলে সবাই খেল, রাতে শুনি খাবার ভালো হয় নাই। আরেক গ্রুপ ক্ষিপ্ত হয়ে তারা এই রবিবার দুই গরু মেরে মানুষ খাওয়াবে। এইযে খানা খাদ্য নিয়ে প্রতিযোগীতা ও জেদাজেদী আমাকে খুব পীড়া দেয়। আরো পীড়া দেয় বিয়ের সময়, আসার কথা ৫০ লোক আসে ১৫০, কুচকিকন্ঠ খেয়ে রায় দেয় ভালো জায়গায় বিয়ে হইছে। খানা খাদ্যে ত্রুটি হইলেই, মেজাজ খারাপ, রায় দেয় অসভ্য অসামাজিক ঘরের সাথে সম্পর্ক স্থাপন হলো। খানা দানার স্বাদ তো পুরাই বাবুর্চিদের দক্ষতা, অনেক নামকরা বাবুর্চিরও রান্না ভালো নাও লাগতে পারে, এক বেলা খানার উপরে এত মুল্যায়ন, দুনিয়ার আর কোনো জাতি করে বলে মনে হয় না।
খেতে আমারও ভালো লাগে সবার মতো। পরিচিত অপরিচিত কুন্ঠাবোধ করি না, খাওয়া তো খাওয়াই। গপগপ করে গিলি। আমার ছোটবেলার এক দোস্ত ছিল, সে বাসায় রাগ করলে খেতো না। তাঁর বাবা মা ব্যাপক সাধাসাধি ও নরম নরম কথা বললে দুই বেলা পর সে আবার খাদ্য গ্রহণ শুরু করতো। আমিও কত চেষ্টা করছি, রোল হইছে ১২৮, এক সাবজেক্টে ফেইল, বাসায় দিলো ব্যাপক ধোলাই । চেষ্টা করছিলাম না খেয়ে থাকতে, পারি না কোনোদিন পারিও নাই। ওতো রাগও আসে না যে আম্মুর উপরে রাগ করে খাওয়া বন্ধ রাখবো। রাগ চলছে, মাইর খেয়েছি, কাদতে কাদতে গলা শুকিয়ে গেছে, একটু ডাকলেই আবার খেতে বসে গেছি। আমার আম্মু বলতো, 'টিভি আর খাবার দাবার এইদুইটার উপর তোর রাগে করে কোনো লাভ নাই। কারন তোর সবচাইতে প্রিয়।' আমি মানি প্রিয়। তবে তাই বলে রোজা বাদ দেই না আবার নরমাল দিনেও প্রচুর না খেয়ে থাকছি। তবুও খাবার দাবারের উপরে কিছু নাই। আমি মামাকে আগে জিগেষ করতাম, মামা কি যে ভালো লাগতো যদি খিদে না পেত, মামা বলছিল খিদা যদি মানুষের না লাগতো তবে মানুষ আজীবন অসামাজিক আর বর্বর থেকে যেত, এত এত আবিস্কার কিছুই হতো না। আমি আসলে ওতো বুঝি না, আমি বুঝি জীবন আসলে বাঁধা পাকস্থলীতেই। তবে আমরা যে ভাবে পাকস্থলী ভেদ করে খানাদানাকে সব কিছুর মুল্যায়নের মাপকাঠি মনে করি। তেমন আসলেই কিছুই না। আমরা বাঁচার জন্য খাই মুলত, খাওয়ার জন্য বেঁচে থাকি না!
এই পোষ্ট উৎসর্গ করলাম পারভীন আপুকে, এই দুর্মূল্যের বাজারে উনি আমাকে প্রচুর বাসায় ডেকে নিয়ে খাইয়েছে। ঢং করেছি আসবো না তাও ফোন দিলেই হাজির। সাথে সাথে গাদা গাদা বই ধারে এনেছি উনার বদান্যতায়। আড্ডা+ খানাদানায় উনাকে বিরক্ত কম করি নি। উনার বাসার সব চাইতে প্রিয় হলো উনার বাসা আলাদা এক রুম জুড়ে বুকশেলফ। এত বই দেখলেই ভালো লাগে। অনেক বইয়েই হাত দেই, মিস্টি একটা গন্ধ, নব্বই কিংবা আশির দশকে কেনা হয়তো বইটা। ইয়া ডাউস সাইজের বইয়ের দাম আশি নব্বই টাকা, ছোট বইগুলো ২০-৩০ টাকা। আর মাথায় আমার যা যা বইয়ের নাম আসে, সব দেখি উনার বাসায়। অনেক বইতে দেখি লেখক কিংবা কবির অটোগ্রাফ। থ্যাঙ্কস আপু এত সুস্বাদের খানাদানা মাথা ও পাকস্থলীতে দুটোতেই দেয়ার জন্য। আপনে দীর্ঘজীবী হন, আপনার বুয়া দীর্ঘজীবী হোক। আর এইভাবে খাওয়াতে থাকেন আমাদেরকে!
ভালো লিখেছো বন্ধু। আমরা জাতি হিসেবে ক্ষুধার্থ। মধ্যযুগের শত শত দুর্ভিক্ষ ফেস করেছে এই জাতি, তাই বোধহয় খাবার প্রতি লালসা এখনও দূর হয়নি। তবে খাবার নিয়ে কুসংস্কার আমার নেই। হিন্দু বন্ধুদের বাড়ি গিয়ে কত শুকর খেয়েছি। তার হিসেব নেই। গরুর চাইতে হাজার গুণ বেশি সুস্বাদু। আর লাভ? আমার স্ত্রী জানে।
ভালো বলছেন ভাই!
পারভীন আপার জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা। <3
ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা
বিয়ে বাড়িতে যুগের পর যুগ এক মেন্যু সকলে খেয়ে যায় বিনা কথায় ---- অবাক লাগে আমার
আপু সেইম টু ইউ!
ভালো লিখেছেন ভাই!
থ্যাঙ্কস শরীফ সাহেব!
মন্তব্য করুন