ইটস অ্যা হার্ড রেইন গোন আ ফল!
বব ডিলানের অতি বিখ্যাত একটা গান। তবে গানটা আমার ভালো লাগে জোয়ান বায়েজের কন্ঠেই। অসাধারন এক কম্বিনেশন ছিল, বব ডিলানের কালজয়ী কবিতা যা গানের সুরে এক ঝাঝালো প্রতিবাদে লেখার প্রতিভা আর জোয়ান বায়েজের কন্ঠের জাদু সব মিলিয়ে এক অনবদ্য সময় ছিল তখন। একদিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিভীষিকা আরেকদিক শহুরে আমেরিকান তরুনদের প্রতিবাদী সব গান সাথে ফোক রিভাইবাল ও হিপ্পী হবার নেশা। এই গানটাও ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে এক অসাধারণ বিশিষ্ট গান। শুধু পশ্চিমেও না,আমাদের এখানেও এক অসাধারণ সময় ছিল ষাটের দশক। বিক্ষোভ- বিপ্লব- প্রেমিক- শিল্পী সবার জন্যই ও সবকিছুর জন্যই শ্রেষ্ঠ এক সময়। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ইস জন্ম যদি হতো দেশ বিভাগের সময়। পুরো ষাটের দশক জুড়ে থাকতাম তরুন। কিছুতে অংশ না নিলেও চোখ দিয়ে দেখতাম সেই সময়কে, অনুভব করতাম সেই দশককে। কি ভালোই হতো। এতদিনে হয়তো কবরে চলে যেতাম, দেখতাম না এই ফেসবুক টুইটারের তথাকথিত সামাজিকতা। জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো। সব চেয়ে আসল কথা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখন যত কথা শুনি, দেশপ্রেম নিয়ে যত ছবক পাই সব প্রত্যক্ষ ভাবে অনুধাবন করা যেত। এই সুবর্ণ সু্যোগ না পাওয়ার বেদনা আমাকে সিক্ত করে। জন্ম হলো আমাদের এমন এক সময় যখন সব কিছুই ক্রমাগত তলিয়ে যাচ্ছে। এই ইন্টারনেট- মোবাইল- টেকনোলজী হাইস্পিড লাইফ আমার ভালো লাগে না। রাত জেগে জেগে তাই ইউটিউবে খুঁজে বেড়াই ষাট দশকের গান, সিনেমা, টিভি সিরিয়াল, কনসার্ট, ডকুমেন্টারী। সব দেখা হয় না তবে খুঁজে বেড়াই ভালো লাগা থেকে। বই হাতে নিয়েও প্রথমেই খুঁজে দেখি, লেখকের স্মৃতির চোখ কেমন প্রসারিত।
সময় চলে যাচ্ছে আগের মতোই। অমানুষ হচ্ছি দিনদিন। আগে অনেক কিছুই গায়ে লাগতো। এখন কিছুই লাগে না। মানুষের দুঃখ শোক স্পর্শ করে না আগের মতো। কেউ যদি মুখ ফুটে কিছু বলে তবে চেষ্টা করি নয়তো নাই। আগ বাড়িয়ে এখন আর কোনো উপকারে আমি নাই। বাংলাদেশে উপকারী গাছ অর্জুন হওয়া মানেই হলো আপনার ছাল থাকবে না। আর যার উপকার কিংবা অপকার থেকে প্রতিকার করবেন, সেই মনে করবে আপনি ঠেকে গেছেন। এইসব ঠেকাঠেকি ভেতরে এখন চোখ বন্ধ করে হাটি। আগ বাড়িয়ে কাউকে ফোন করি না। সব কিছুতেই নিঃস্পৃহ থাকি। তবুও একটা বড় কাজ করলাম যেই কাজে আমি স্যাটিসফাইড। চায়ের দোকানদার বারেক সাহেবের খুব কাছের বন্ধু, যিনি সাত বছর আগেই গত হয়েছেন, তার স্ত্রী কোনোরকমে টেনেটুনে সংসার চালান। তার মেয়ের বিয়ে ছিল গত শুক্রবার। নানান বন্ধুর কাছ থেকে টাকা তুলে, নিজেরা মিলে তাঁদের আশার চেয়েও বেশী টাকা সেই মেয়ের মায়ের হাতে তুলে দিয়েছি। যদিও প্রত্যাশা ছিল আরো বেশী দেবার, কিন্তু লোকজন সব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী, ডায়লগ আর ঘোষনা দেবার সময় আছে টাকা দেয়ার সময় ফোন অফ। আমি আর পুলক মানুষকে বোঝাতে পারলাম না যে আপনাকে টাকা দিতেই হবে এমন কোনো কথা নাই, যখন বলেছেন দিবেন তখন কেন গড়িমসি? গরীব মানুষ হলেও ভদ্রমহিলার আত্মসম্মানবোধ মুগ্ধ করার মতো। তিনি আমাকে বলেছেন, 'মামা নিজেরা যা পারেন তাই দেন আপনাদের কারো কাছে চাইতে হবে না। আমার মেয়ের জন্য আপনারা ছোটো হবেন কেন?' আমরা নিতান্তই ক্ষুদ্র মানুষ তাই আমরা নিজেরা নিজেরাই ব্যাবস্থা করেছি। যা দিয়েছি তাতেই উনি খুশী, আমরা খুব একটা খুশী না। কারন এই জীবনে এত এত টাকা নষ্ট করছি, অথচ এইসব সময় টাকা বেরই হয় না কিংবা থাকেও না। তাই আমাদের কোনো আত্মপ্রসাদও নেই। কিছুই করা হলো না নিজেকে নিয়ে ভাবা ছাড়া।
গান এখন শুনছি খুব 'চতূষ্কোণ' সিনেমার। অনুপমের সুর আর কথায়। একটা গান আছে 'বোবা টানেল'। ধারনা করি টানা ১০০ বার খালি এই গানটাই শুনছি।
https://www.youtube.com/watch?v=pLrk4OIqPPo
মাইন্ডব্লোয়িং একটা গান। বুকের ভেতর হু হু করে দেয়। বাসা থেকে বেরও এখন হই কম। পিসিতে বসে থাকি আর বই পড়ি, পিঠ ব্যাথা হলে রাতের দিকে যাই চায়ের দোকানে। বুয়া আসুক না আসুক, ঘরেই দিবস যাপন। বুয়ার অবশ্য জ্বর তাই আজ আসে নি। দুপুরে খেতে হলো আলমাহবুবে বিরিয়ানী। বিরিয়ানী এত খাই যে টায়ার্ড লাগে। আল মাহবুব রেস্তোরায় সাদা ভাত মাছ ডাল কিংবা চিকেন কারী খেতে লাগে দুশো টাকা, আর চিকেন বিরিয়ানি একশো দশ টাকা আর কাচ্চি একশো বিশ! আশি - নব্বই টাকা বাচাতে গিয়ে আমি সারাজীবন বিরিয়ানি নামক অখাদ্যটা কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে গেলাম। তবে অনেকের হোটেল রেষ্টুরেন্ট নিয়ে এলার্জি আছে কিন্তু আমার ভালোই লাগে। মধ্যম সারির কোনো হোটেল বন্ধুকে নিয়ে বসে থাকতে ও আড্ডা জমাতে। হোটেল একটা আলাদা ভুবন। সেই ভুবনের স্থায়ী বাসিন্দা বয় ও মেসিয়ারদের পারস্পারিক বন্ধুত্ব ঠাট্টা মশকারি, দেয়ালে দেয়ালে টেবিল চেয়ারে গন্ধ এইসবে খুব মন টানে। আমার কলেজ জীবনের সেকেন্ড ইয়ার পুরোটা কেটেছে হোটেলে বসে বসে। তখন পকেটে টাকা থাকতো না, সিঙ্গারা চা খেয়েই বসে থাকতে হতো। ভাবলেই বন্ধু কামরুলের কথা মনে পড়ে। আহা কি দারুন গল্প আড্ডায় মেতে উঠতো ছেলেটা। কামরুলের জীবনে এত গল্প ছিল খালি শুনতাম আর শুনতাম। আমার জন্য কামরুল কত সময় যে নষ্ট করেছে তার হিসেব নাই। তবে সেই কামরুলেরও এখন ফোন ধরার সময় নেই, চাকরী- টিউশনী- এম্বিএ ক্লাস সব মিলিয়ে ভীষন ব্যস্ত। তা নিয়ে আমার অবশ্য কোনো কমপ্লেইন নেই। কারন এই জীবনে কামরুলের সাথে যে সময় অলস দুপুর কাটিয়েছি সমুদ্রতীরে আমড়া খেতে খেতে কিংবা ব্যস্ত হোটেলে টেবিল দখল করে চা খেতে খেতে তা রোমান্থনেই আমি মুগ্ধ। সবার জীবনে এত ভালো সময় আসে না, আর আসলেও মনে রাখতে পারে না। হোটেলের কথা আসলেই আমার ফিরোজ নামের এক ছেলের কথা মনে পড়ে। তখন বন্ধুরা চিটাগাংয়ে ডিলাইট নামের এক সস্তা হোটেলে বসে আড্ডা মারতাম। ফিরোজ নামের একটা ছেলে ছিল, সমবয়সী হবার কারনেই হয়তো ছেলেটা আমাদের খুব ভালোবাসতো। খুব খাতির করতো গেলে। একদিন সন্ধ্যায় ছেলেটার কঠিন জ্বর। সেদিন খুব বৃষ্টি। আমি আর কামরুলই শুধু গিয়েছি। মোঘলাই খেতে। ছেলেটাকে দেখে খুব মায়া লাগলো। মাথা নিচু করে টেবিলে বসে আছে। হোটেল বন্ধ হলে সেখানেই সে শোয়, তাই শোয়ার কোনো জায়গা নেই। আমাদের পরিচিত এক ফার্মেসীওয়ালা ছিল তার কাছে নিয়ে গেলাম সে মেডিসিন দিল। তার আবদার সে বাড়ী যাবে যেভাবেই হোক, কিন্তু টাকা নাই। তার বাড়ী কই? জানলাম বরিশাল। কামরুলের পকেটে টিউশনী থেকে পাওয়া গরম গরম ১০০০ টাকা ছিল। নয়শো টাকা সেখান থেকে দিয়ে দিল। ফিরোজ আর কি মুগ্ধ, নিজের বন্ধুর কীর্তিতে আমি স্তব্ধ। মনে হচ্ছিলো হুমায়ূন আহমেদের বই থেকে উঠে আসা মানুষ। আমি জানি কামরুলের সারা মাসের হাত খরচ সে দিয়ে দিলো এক মিনিটের সিদ্ধান্তে। আর আমাকে দিলো অমর সেই ডায়লগ, মাস ঘুরলেই আমার টাকা আসবে, মাত্র ৩০ টা দিনেরই তো ব্যাপার।
একে খন্দকারে বই নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে। খুশী হবার মতো ব্যাপার হলো, এখনও একটা বই দেশের সব চাইতে বড় ইস্যু হবার ক্ষমতা রাখে। তবে আমি হতাশ সমালোচনা পদ্ধতির। বই পোড়ানো কিংবা নিষিদ্ধ করার দাবী তোলা মানেই হলো বইয়ের কথা গুলোকে জনমনে সত্য বলে স্বীকার করা। অথচ বইটার দৃষ্টিভঙ্গিতেই গলদ। না পড়েই বলছি, নানান জনের মুখে শুনলাম তিনি মুক্তিযুদ্ধটাকে একটা আপদমস্তক সেনাবাহিনীর অর্জন ও ব্যাপার হিসেবে দেখছেন। যুদ্ধটাতো সবার। কয়েকজন রাজাকার আর আলবদর ছাড়া সবাই মুক্তিযুদ্ধের সাথেই ছিলেন, সমগ্র জনগোষ্ঠীর অর্জন আর ত্যাগেই তো ভাস্বর আমাদের একাত্তর। আমাদের আবেগের জায়গাকে মিলিটারী পোষাক কেউ পড়াবে তা আমি চাই না। একটা বই লিখছে প্রতিবাদে আরো ১০ টা বই লিখবেন, গালাগালি করার কি দরকার? আর অবান্তর এক আলোচনা জয় পাকিস্তান বলা না বলা নিয়ে। বঙ্গবন্ধু সেদিন তা বলেছেন কিনা আমি নিশ্চিত নই। তবে আহমদ ছফা কোথায় জানি লেখেছিলেন, 'সেরকম কিছু বলে থাকতে পারেন, কিন্তু তা গুরুত্বপুর্ন না আমাদের কাছে গুরুত্বপুর্ন ছিল সেই ভাষনের স্পিরিট'। আপনি মানেন না মানেন বঙ্গবন্ধুর মত জাতীয় নেতাকে অস্বীকার করা মানে বাংলাদেশকে অস্বীকার করা। দেশ চালনায় তিনি ব্যর্থ হতে পারেন হয়তো কিন্তু তিনিই স্বাধীনতার স্থপতি। তাই অহেতুক বিতর্ক করে ফায়দা নাই। আর ইমানদার আওয়ামীওয়ালাদের এত প্রেমে অন্ধ থাকাটাও বিপদ, বঙ্গবন্ধু যত বড় মানুষই হন না কেন- তিনি মানুষই। মানুষের অনেক প্রতিকুলতা থাকে উনারও ছিল। বাঙ্গালী মাত্রই সবসময় এক আপোষের ইতিহাস। তাই কেউ যদি দুটো কথাও বলে তা সইতে পারার শক্তি থাকা জরুরী। ইতিহাস যার যা পাওনা তা কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দেয়, তা যত সময় যাবে ততই ক্লিয়ার হবে!
টেকনোলজী হাইস্পিড লাইফ আমারো ভালো লাগে না, তবু আটকে আছি এই বিরক্তিকর লাইফে। এক লেখায় কত কি বললা! এমন লেখা পড়তেও কত আরাম! লিখে যাও আজীবন।
কি খবর আপু?
আপনার ব্লগে নিয়মিত আসা কমেন্ট করায় খুব ভালো লাগে। অনেক অনেক শুভকামনা!
সময় চলে যাচ্ছে আগের মতোই। অমানুষ হচ্ছি দিনদিন। আগে অনেক কিছুই গায়ে লাগতো। এখন কিছুই লাগে না। মানুষের দুঃখ শোক স্পর্শ করে না আগের মতো।
এ্যাত মিলল ক্যাম্নে?
মিলবেই তো,আফটার অল বন্ধু বলে কথা!
মারাত্বক, হ্যাটস অফ
(Y) (Y) (Y)
মন্তব্য করুন