এই মৃত্যুমুখী শহর যেন শুন্য মাপার কারখানা!
গত পোষ্টেই লেখা প্রসঙ্গে বলছিলাম বন্ধু কামরুলের কথা। ভাগ্য কি অসাধারণ, একদিন পরেই অফিসের কাজে কামরুলের ঢাকায় আগমন। হোটেলে না থেকে- আমার বাসায় থাকা। গত দুদিন তাই অত্যন্ত আনন্দে কাটছে। যদিও তার সময় মেলে কম, তাও যতটুকু তাই মেলা, রাতের বেলা দুই বন্ধু ছাদে বসে বসে গল্প করতে করতে কাটাই। কামরুলের সাথে আলাপের সব চাইতে বড় সুবিধা- ভনিতা করতে হয় না কোনো। এমনিতেও ভনিতা ব্যাপারটা আমার সাথে খুব একটা যায় না। তবুও কামরুলের সাথে তা আরো না। প্রশ্ন করি, জানতে চাই, সব ঘটনা দিন যাপনের কথা জানার চেষ্টা করি। শুনে হো হো করে হাসাই আমার কাজ। কামরুলের সব চাইতে বড় জিনিস হলো সে কোনো কাজই হেলায়ফেলায় করে না। যাই করুক সিরিয়াস, আড্ডা মারার সময়তেও সিরিয়াস হাস্যরস করতে করতেই আড্ডা। দুইটা বোন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ট শেষ করবে করবে, তাঁদের বিয়ে দিবে কিভাবে তা নিয়ে ইদানিং সে চিন্তিত। যা একদমই নতুন অভিজ্ঞতা আমার জন্য। কারন কামরুলকে আমি এই জীবনে কোনোদিন সাংসারিক ব্যাপারে সিরিয়াস দেখতে একেবারেই অভ্যস্ত না। কিন্তু এখন সে সংসার নিয়ে সিরিয়াস, এমন কি সামনে নিজে যখন বিয়ে করবে- তখন কি কি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে তা নিয়েও চিন্তিত। আমাকে নিয়ে তার ডায়লগ একটাই, তোর মতো জীবন আমাদের ব্যাচের ১৭০ জনের ভেতরে কারো হয় নি,তাই রিলাক্স থাক, এমনি থাক, সামনে তোর আরো সুদিন আসবে। আমি এইসব শুনে হাসি। আল মাহবুব হোটেলেও শুক্রবারের অলস দুপুরে দুজন অনেক সময় নিয়ে আলাপ করলাম। পাশেই দেখলাম আমাদের মতই দুই বন্ধু অল্পবয়সী, কলেজে পড়ে হয়তো। সিনেমায় যেমন মানুষ নিজের অতীত দিন আয়নার মতো দেখে। আমিও দেখলাম। আহা! কি শান্তি। সবাই বলে সময় বদলে যায়। আমি দেখি সময় সেই একই, সব জায়গাতেই কিছু আকাইম্মা মানুষ আড্ডা বাড্ডা মেরেই দিন কাটায়!
শুক্রবার সন্ধ্যায় আমাদের আরেক কাজ ছিল। পুলকের বড় বোন সব সময় বলে, তাদের আবৃত্তির শো তে আসতে। সব সময় আমি অতিথি টিকেট পাই, কিন্তু আসাই হয় না আলসেমিতে। শুক্রবারের সন্ধ্যাটা আসলে শাহবাগে গিয়ে স্পয়েল করতে মন টানে না। কারন শুক্রবার সবাই থাকে, আমার এলাকা ছেড়ে শাহবাগ যাবার কোনো কারন নেই। তাও আমি জেমস আর পুলক সিদ্ধান্ত নিলাম শুক্রবার যাবোই। উপলক্ষ্য আপুদের সংগঠনের দুই যুগ পূর্তি। তাঁদের শো এর নাম রাখা হয়েছে- 'অমৃত সমান'। ১৬ টি কবিতার আবৃত্তি হবে। রিকশায় ছিলাম আমি আর কামরুল। জ্যামে দেরি হয়ে গেল। তাই শোনা হলো না, হুমায়ূন আজাদের 'কখনো আমি'। দেখলাম পাঠ চলছে সব্যসাচী দেবের কবিতা- 'বেহুলা ভাসান' এর। এরপর একের পর এক আসলো--শামসুর রহমানের 'পুরান' সুবোধ সরকারের 'সীতা' 'রামবাবু', সব্যসাচী দেবের 'সীতা', জয়দেব বসুর 'রাধেয় অধিসুরত', সব্যসাচী দেবের 'কৃষ্ণা, শামসুর রহমানের 'ইকারুসের আকাশ', 'ইলেকট্রার গান,' 'ডোডোলাস,'। আব্দুল মান্নান সৈয়দের 'ইউসুফের প্রতি জুলেখা', 'জুলেখার প্রতি ইউসুফের স্বগোতক্তি', আবু হাসান শাহারিয়ারের ' একলব্যের পুনারুত্থান', কবিতা সিংহের 'ঈশ্বরকে ইভ'। একটা কবিতাও আমার আগে শোনা হয় নাই। তাই দারুন লাগলো। পুলকের বোনের আবৃত্তি তো দুর্দান্ত রকমের ভালো। ব্যাকগ্রাউন্ডে বেহালা, স্যাক্সোফোন, বাশী, গলার কাজ সব একাই দারুন করেছেন একজন। খুবই ভালো হয়েছে কাজটা। দর্শকও ছিল কম না। কিন্তু সবাই ব্যাস্ত মোবাইল নিয়ে। কেউ কেউ কানে হেডফোন নিয়ে। সেখান থেকে ভেসে আসছে হিন্দি গান। আমি কবিতা শুনতে শুনতে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। বিশেষ করে সুবোধ সরকারের রামবাবু কিংবা ইশ্বরকে ইভ পড়ার সময়। যোগ্য লোকদের মুখে ভালো কবিতা শোনার চেয়ে দারুন ব্যাপার আর হয় না। কবিতা আপনি নাই বুঝতে পারেন কিন্তু কবিতা পাঠ আপনার শিরায় শিরায় এক ধরনের মুর্ছনা সৃষ্টি করবে। যার রেশ থাকবে অনেকক্ষণ। কামরুল চিটাগাংয়ের এক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিল, নাম প্রমা, সেও মুগ্ধ।
আমি প্রচুর পুরোনো হিন্দি গান শুনি আজকাল। আর ফুলরিপ নামে একটা সাইট আছে ইউটিউবের লিংক কপি দিলেই নেমে যায়। কত্ত সহজ এখন জীবন। অথচ একটা সময় বিমা ভাই ইস্নিপ্সের লিংক দিতো। তা শোনার সাহসই করতাম না। রাশেদ ভাই ইস্নিপসের গান ডাউনলোড করার তরীকা দিয়েছিলেন ব্লগে। মনে হলো হাতে আলাউদ্দিনের চেরাগ পেয়েছি। সমানে গান নামাতাম। যতো সময় লাগে লাগুক। ছয় বছরের ব্যাবধানেই নেটে কি বিপ্লব। আমার মতো শান্ত চালায় ১ এমবিপিএসের লাইন। ইউটিউবে এখন আমার চলতেছে লতা মঙ্গেশকার আর মোহম্মদ রফীর গান শুনার পালা। সমানে শুনেই চলছি। আমি হিন্দি গান শুনতে থাকি সংশয় ছাড়া। দেশের সব বড় ব্যাবসা এখন চালাচ্ছে ভারতীয় রা, টিভিতে ভারতের সিরিয়াল দাপটে, আর হিন্দি গান শুনলেই দোষ। তবে সব গান ভালো লাগে না। যে গান ভালো লাগে, ইউটিউবে তার যতো ভার্শন আছে- যত কাভার আছে সব শুনি। ভারতের এই জিনিসটা খুব ভালো। নানান ছেলে মেয়ে কাভার করে ইউটিউবে ছাড়ে। তাঁদের সাবস্ক্রাইবও করে হাজার হাজার মানুষ। সুন্দরী মেয়েদের এডভান্টেজ বেশি, তাঁদের ঘরোয়া পোষাকে আড়ম্বরহীন গান ছেলেদের চিত্তে দোলা দেয়। অনেকে আবার আয়োজন করে স্টুডিওতে ভিডিও শ্যুট করে। সব ভালো হয় এমন না। তবে কিছু কিছু অনেক ভালো হয়। ভালো লাগে গানের প্রতি এদের ভালোবাসা দেখে। আমাদের দেশে লাখ চারেক টাকা খরচ করে দেশে বিদেশ ঘুরে গানের মিউজিক ভিডিও না বানিয়ে যদি মোটামুটি শিল্পীরা এইভাবেও গান গাইতে পারতেন তবে মন্দ হতো না। বাংলা গানের প্রচার বাড়তো। কন্ঠ কিংবা কানে এখন তিনটা চারটা গানই আসে। যেমন একটা হলো- লতা মঙ্গেশকারের আজিব দাস্তান হ্যায় ইয়ে ও লাগ যা গালে, মোহাম্মদ রফীর লাখো কি নিগাহোমে, হেমন্তের হ্যায় দিল আপনে আওয়ারা এইসব হাবিজাবি।আর চতুষ্কোন সিনেমার গান তো আছেই। এইসব শুনে শুনেই দিন চলে যায় বই পড়তে পড়তে। বাংলাদেশের জঘন্য খেলাও দেখি না, টিভিও খুলে বসি থাকি না। ফিরোজা বেগমের মৃত্যুর পর মনটা খারাপ হলো। নজরুল সঙ্গীত যদিও আমার ভালো লাগে না। তাও মনে করার চেষ্টায় ছিলাম, কি কি গান উনার কন্ঠে আমি শুনেছি আগে। আমার বন্ধু ছিল রাজু, রুয়েটে পড়তো, ওর যন্ত্রনায় আমাকে অনেক নজরুল গীতি শুনতে হয়েছে। কারন তার ধারনা আমরা ধর্মনিরপেক্ষ থাকতে চাই বলে নজরুল গীতি শুনি না। আমি ওর পাল্লায় পড়েই তখন অনেক নজরুল গীতি শুনেছি। তাকে বোঝাতে পারি নি নজরুল যত শ্যামা সঙ্গীত লিখছে ততও গজল লিখে নাই।
আমার এক বন্ধু আমাকে ফেসবুকে নক করলো। আমি সাধারনত যাদের সাথে কথা বলতে ভালো লাগে, তাঁদের ছাড়া কারো মেসেজের উত্তর দেই না। কি মনে করে তার মেসেজের উত্তর দিলাম। বন্ধুর সেট হারিয়েছে শুনলাম। সান্তনা দিলাম। বললো, 'এইসব নিয়ে ভাবি না সেট হারিয়ে যদি মনের দুঃখ হারিয়ে ফেলতে পারতাম তাহলে সব চাইতে ভালো হতো। কিন্তু তা তো সম্ভব না। আমি বললাম তোর কিসের দুঃখ এত? ব্রেক আপ হইছে নাকি? সে বললো হ্যা। ছয় বছরের প্রেমের। মেয়েটাকে আমি চিনি খুব ভালো মতোই। কার দোষ তা জানি না? জানতেও চাইলাম না। আমি প্রমাদ গুনলাম। আমার জীবনে কোনো দুঃখ নাই। খালি গ্লানি আছে। সব গ্লানি ধুয়ে মুছে যায় ইউটিউবে গান শুনতে শুনতে। আর নিজে চা বানিয়ে লাতিন আমেরিকান গল্প সমগ্র পড়তে পড়তে!
আমিও আকাইম্মা!
আমার চেয়ে তাও কম আছো!
আমিও আকাইম্মা!
অনেক কিছু করার ট্রাই নেই কিন্তু কিছুই হয়না। সবই ভেস্তে যায়। 
তুমার মতো কামেল লোক আমার খুব কম দেখা দোস্ত। কত কাজ কাম করে বেড়াও!
মন্তব্য করুন