"বম্বে টকিজ"
এখন আমার সময় কাটে বেশীর ভাগ 'পার্লজ্যাম' ব্যান্ডের গান শুনতে শুনতেই। টরেন্ট দিয়ে নামিয়েছিলাম, দিনে দিনে তার শুধু আসক্তি বাড়ছে। যদিও আমি অনেক পরে শুনছি পার্লজ্যাম, সবার শোনা শেষে অনেক আগেই। ভালো লাগছে। তার কিছু দিন আগে আরেক ব্যান্ডের গান খুব শুনলাম। কিছুই বুঝি না। কেরালার ব্যান্ড। তাইক্কাডুম ব্রিজ। আগে আমি মানতাম না কিন্তু এখন মানি সুরের কোন দেশ- কাল নাই। এক বিন্দু কথা না বুঝেও আপনি কোন গানের গভীর প্রেমে পড়ে যেতে পারেন। আমার এক পরিচিত ছেলে ছিল, সে হা করে কোরিয়ান চ্যানেলে পড়ে থাকতো, সেখানে গান হতো। তাই তাঁর ভালো লাগতো। কার যে কী ভালো লাগে, বলা মুস্কিল। যেমন পুলকের ভালো লাগে তামিল-তেলেগু সিনেমা। সিনেমা দেখতে দেখতে এখন সে মোটামুটি এইটি পারসেন্ট বুঝে যায় সিনেমায় কি বলা হচ্ছে। আমার আরেক বন্ধু ছিল, কিছুটা দূরের সে আগ্রহ নিয়ে ইরানী সিনেমা দেখতে দেখতে ফারসী ভাষা শিখে ফেলেছে প্রায়। লোকজনের এত প্রতিভা, আমার তেমন কোনো কিছুতেই পারদর্শিতা নাই। আমার ভাইয়ার খুব আশা ছিল, আমি অন্তত একটা নতুন ভাষা শিখবো, তা আর হলো কই? বাংলা ইংলিশ সবার মতোই এভারেজ দক্ষতা, আর হিন্দি সিনেমার নাইন্টি পারসেন্ট বুঝি দেখতে দেখতে। হিন্দি শেখা নিয়ে একটা মজার কথা বলি, ভার্সিটিতে আমার এক বন্ধু ছিল সে ইংলিশ মিডিয়ামের, তাই বাংলাই অতি বাজে কিন্তু নতুন গার্লফ্রেন্ড তার, সে আবার হিন্দিতে দিওয়ানা, খালি হিন্দিতে আলাপ করতে চায়, সে আমাকে নিয়ে গেল নীলক্ষেত, হিন্দি শেখার কোনো পুস্তক আছে কিনা। কিছু না পেয়ে শেষে ৩০ দিনে হিন্দি শিখুন বইটাই কিনতে হলো ৩০টাকা দিয়ে। আমি বললাম 'রাসেল তার আগে তোমার বাংলা শব্দ পড়া তো জানতে হবে'। সে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বাংলা শব্দ পড়তো আর তার হিন্দি উচ্চারন পড়তো। তার এই চেষ্টায় মেয়ে ইমপ্রেস হয়েছিল বলেই শুনেছি।
হিন্দি সিনেমা নিয়ে আমি লিখি মাঝে মধ্যে। এই নিয়ে নানান মানুষের টিপ্পনীও শুনি। এই টিপ্পনীর ভয়ে আমি আর কোনো পোষ্টই শেয়ার করি না ফেসবুকে। তাও যারা বদের হাড্ডি বন্ধু বান্ধব, তারা আমার আমরাবন্ধু ব্লগ একাউন্ট পাতা বুকমার্ক করে রেখেছে। পড়ে আর বলে- 'মুখেই খালি দেশপ্রেম, লেখোস তো হিন্দি সিনেমা নিয়ে রিভিউ'। আমি হিন্দি সিনেমার সাথে দেশপ্রেম হারানোর ব্যাপারটা বুঝি না। ডিস ক্যাবলে ভারতের চ্যানেল দেখে না কে? মেয়েরা হিন্দি সিরিয়াল দেখে, ছেলেরা আইপিএল দেখে, বাবা মা রা জিবাংলা দেখে, সবাই ভালো আছে। হাইক্লাস যুবক যুবতীরা ভাব নিয়ে যে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বা ফক্স ট্রাভেলার দেখে তাতেও তো হিন্দি বিজ্ঞাপনে সয়লাভ। এই সস্তার যুগে অনলাইনে কিংবা ব্রডব্যান্ডের সার্ভার ভর্তি হিন্দি সিনেমা, দেখে সবাই কিন্তু নাম হয় আমার। হোক নাম। আমি একবারই দেখি প্রতিটা সিনেমা, তারপর আর ফিরেই দেখি না তা। হিন্দি গানও শুনি না তেমন। এইভাবে করে করে গত দেড় বছরে এত হিন্দি সিনেমা দেখছি যে খুব কমই মিস হয়েছে। তা গুরু দত্ত থেকে নওয়াজউদ্দীন সিদ্দিকীর হোক, সিক্সটি পারসেন্ট সিনেমা আমার দেখা শেষ। এই গত সাতদিনই শুধু দেখা হয় নাই, কারন নেট জিপির মডেম দিয়ে চালাচ্ছি- যার স্পিড খুব লিমিটেড। তাও ফেসবুক আসে, ব্লগ চালানো যায়, দেশী পেপারের পেইজ নামে- এতটুকুই সান্তনা। ওলোর আনলিমিটেডের কাছে তা যদিও কিছুই না। কিন্তু জীবনে সব দিন তো আর বিরিয়ানী মিলে না, মাঝে মধ্যে ডাল ভাত খেতে হয়। আমি এখন ডাল ভাতের উপরে আছি।
যে সিনেমা নিয়ে আজ কথা বলবো। সিনেমাটা আমার খুব প্রিয়। বোম্বে টকিজ। ২০১৩ সালের সিনেমা। তেমন হিট না। ট্রিবিউট মুভি, হিন্দি সিনেমার ১০০ বছর উদযাপন উপলক্ষে। চারটা ভিন্ন গল্প, চারজন বিখ্যাত পরিচালক, এক সাথে একটা সিনেমা, যা মুলত সিনেমা নিয়েই গল্প। এই সিনেমাটা আমার অসম্ভব প্রিয়। শুধু করন জোহর বাদে বাকী তিন পরিচালক, দিবাকর ব্যানার্জী-জয়া আখতার-অনুরাগ ক্যাশপ, দারুন কাজ করেছেন। যা সারা বছরে ১০০ হিন্দি সিনেমার ভিতরেও পাওয়া সম্ভব না। করন জোহরকে আমার সারাজীবনই গে মনে হয়, আমার কথা রাখতেই সে হয়তো এই গে মুভিটা করেছে। সিনেমার দুই চরিত্র রান্দীপ হুদা আর সাকিব সালিম হঠাৎ করেই পুরোনো হিন্দি গানের আকর্ষনে প্রেমে পড়ে যায়। সাকিব আগে থেকেই সব জায়গায় স্বীকার করে সে গে, কিন্তু রান্দীপ হুদা রানীর সাথে সংসার, সে স্বীকার করতে সময় লাগিয়ে দেয়। এই পার্ট টুকুতে পথের মাঝে যে বাচ্চাটা গান গায় তার অভিনয় ও গানটা অমুল্য। 'লাগ যা গালে' গানটার নানান ভার্শন আমার শোনা, তবে এইটা মোষ্ট কিঊট ভার্শন, সাথে বাড়তি হিসেবে আছে, 'আজিব দাস্তান হ্যায় ইয়ে' তো বোনাস ট্রাক। এই পার্টটুকুর নাম ও এইটা। আমার সিনেমার প্রথমাংশটুকু মোটেও ভালো লাগে নাই। এরপরের পার্টটা বানানো, দিবাকর ব্যানার্জীর। সত্যজিত রায়ের বিখ্যাত গল্প, 'পটল বাবু ফিল্ম স্টার' থেকে নেয়া। গল্পটাতো সবারই জানা। নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকীর দারুন অভিনয় আর হিন্দি এডপটেশনে দারুন লেগেছে। অনিমেষ আইচের নাটক দেখছিলাম সত্যজিত রায়ের গল্প থেকে বানানো, আবুল হায়াতের দুর্দান্ত অভিনয় সেই স্মৃতি মনে পড়ে যায়। দিবাকর ব্যানার্জী খুবই পরিমিতি বোধের সাথে স্মার্ট ভাবে এই পার্টটা করেছেন। এরপরের পার্টটা সব চাইতে সুইট। জয়া আখতারের বানানো। নাম 'শিলা কি জাওয়ানী'। নাম শুনলে যা মনে হয় সিনেমাটা তার থেকে অনেক দূরে। ৭-৮ বছরের এক ছেলে যার বাবা (রনবীর শোরে), সে চায় ছেলেকে ফুটবলার বানাতে। বাচ্চা ছেলে অনেক কিছুই হতে চায়। টিভিতে ক্যাটরিনার নাচ দেখে তার নাচতে ইচ্ছে করে। তার কয়েক বছরের বড় বোন সেই ছেলের সব কিছুর একমাত্র দর্শক। ছেলেটা শিলার মতো নাচতে গিয়ে বাবার কাছে বকা খায়। এদিকে তার বোনের স্কুলের শিক্ষা সফরে যাবার জন্য টাকা লাগবে দু হাজার। তার বাবা মানা করে দেয়। ছোটভাই ক্যাটরিনার পোষ্টার লাগায় তার দায় সেই বোন টা নেয়। তাকে তার বাবা উপহার দেয় ক্যাটরিনার এক বার্বি ডল। টিভিতে ক্যাটরিনাকে দেখে, সে এক ইন্টারভিউতে বলছে, ক্যাটরিনা - তুমি যা হতে চাও তাই পারবে যদি তুমি আসলেই চাও। তারা দুই ভাইবোন ব্যাংক ভাঙ্গে, ১৭৫০ টাকা হয়। বোনের শিক্ষা সফরে যেতে দরকার আরো ২৫০ রুপী। সে টিকেটের বিনিময়ে ঘরোয়া অনুষ্ঠান বানায়, দশটাকা করে টিকেট, তাঁদের বাবা মা যখন বাইরে তখন, ভাইটা দারুন এক ড্যান্স দিয়ে সে এলাকার সব ছেলেমেয়েদের মুগ্ধ করে ফেলায়- যারা তাকে নিয়ে হাসতো। আমি তো বললাম, সিনেমাটা যখন দেখবেন, এই কিউট বাচ্চাটার অভিনয় আর নাচের এক্সপ্রেশনের প্রেমে পড়ে যাবেন। আমার চোখ দিয়ে পানি এসে গিয়েছিল মুগ্ধতায়। একটা সস্তা শরীর দেখানো হিন্দি আইটেম গানের কত ধরনের ইন্টারপ্রেশন হতে পারে তাতেই আমি অবাক হয়েছি। আর শেষ পার্টটা অনুরাগ ক্যাশপের বানানো। এই মুহূর্তে নতুন যুগের হিন্দি সিনেমার সব চাইতে বড় ডিরেক্টর- প্রডিউসার- রাইটার- থিঙ্কট্যাঙ্ক তিনি। উনি দারুন দারুন সব ছবির সাথে জড়িত, প্রডিউসিং করেন, স্ক্রীন রাইটার হয়, ভালো ছবি বানায় তাঁদের এপ্রিশিয়েট করেন, তা আসলে বিস্ময়কর। এই লোকটার নাম আমি অনেক আগেই শুনেছি, রাম গোপাল ভার্মার কোন ইন্টারভিউ পড়েছিলাম অনেক আগে, সেই সময়। তাঁর পার্টটুকুর নাম 'মোরব্বা'। আবেগময় এক ভালোবাসার গল্প। তাঁর বাবার খুব ইচ্ছে তাঁর বানানো মোরব্বা অমিতাভ বচ্চন এক কামড় হলেও খাবে। বাবা মৃত্যুশয্যায়। সে উত্তর প্রদেশের এক নিম্নবিত্ত খাদ্য বিক্রেতা ফেরীওয়ালা। সে যায় মুম্বাই। কাউকে চিনে না। টাকা নাই। অনেক কষ্টে অমিতাভ বচ্চনের বাড়ীর কাছে যায়। কিন্তু আশেপাশেই ঘোরাফেরা করে। কেউ কেউ ভেতরে যায়, তাঁর কপালই খুলে না। সে বসে থাকে, এদিকে তাঁর আশ্রয় নাই। মোরব্বার একটু অংশ সিকিউরিটি গার্ডের মাধ্যমে ভেতরে পাঠায়। তাও সে শিউর না, যে আসলেই অমিতাভ বচ্চন খেয়েছে কিনা। সে গার্ডকে ফলো করে বাসা পর্যন্ত। কান্নাকাটি করে গার্ডের পা ধরে। গার্ডের দয়া হয়। তাঁর মোরাব্বা ভেতরে আবার দেয়। এবার অমিতাভ বচ্চন সত্যি খায়, তবুও তাঁর বিশ্বাস হয় না। তাঁর সামনাসামনি খেতে হবে। শেষে অমিতাভ বচ্চনকেই পেয়ে যায়, খাওয়ায়, সাথে সাথে ট্রেনে রওনা দেয়। ট্রেনে সবার সাথে যখন বচ্চন সাব কিভাবে খেলো তা নিয়ে আলাপ করছে, এক বদ ব্যাটা উপর থেকে মোরাব্বার ডিব্বাটা, উপরের রেক থেকে নিচে ফেলে দেয়। সে কি কান্না তখন ছেলেটার। ময়লা সেই মোরাব্বাই সে তুলে। ইশ্বরের অদ্ভুত ইশারায় সে মোরাব্বাই তাঁর বাবা একটু একটু চেখে আর দেখে, অনেকদিন বেচেও থাকে। ছেলেটা যা অভিনয় করছে। এক কথায় অসাধারণ। আর গল্পটাই এত ভালো আপনি আবেগের সাগরে ভাসবেন। সিনেমা শেষ এখানেই। যুগের পর যুগ লেইম লেইম হিন্দি সিনেমাও যে একটা জনগোষ্ঠীকে কিভাবে আবেগ আর ভালোবাসার স্থানে নিয়ে যেতে পারে তা দেখে আমি মুগ্ধ। কাল ধানমন্ডী থেকে একটা ডিভিডি কিনে ফেলছি এই সিনেমার। যদিও আমার পিসিতেই আছে তা। এরকম সিনেমা আগামীতে আর আসবে কিনা, তা বলা মুস্কিল। আমি মুগ্ধ 'বম্বে টকিজে'।
এই পোষ্ট আমি নিবেদন করলাম, বিষণ্ণ বাউন্ডুলেকে। ছেলেটা যে দারুন দারুন সব গান শুনে আর ফেসবুকে শেয়ার দেয়, আমি মুগ্ধ হই।
দেখিনি বম্বে টকিজ সিনেমাটা। লেখা পড়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। দেখা হবে কিনা কে জানে! যাই হোক। দারুণ লিখেছো সিনেমা নিয়ে পোস্ট।
দেখে ফেলেন ডিভিডি কিনে, আপনি তো আবার কেনাকাটা করেন সিডি ডিভিডি, বাড়িতে ভালো থাকেন।
আমি আর মেঘও হিন্দি সিনেমার ভকত। বম্বে টকিজ এর রিভিউ এসেছিল ভাল। দেখবো ভেবে ভেবেও আর দেখা হয়নি।
লাইফ ইজ বিউটিফুল দেখলাম। দারুন লেগেছে। না দেখে থাকলে দেখে নিও।
মৃত্যুসজ্জায় >>>> মৃত্যুশয্যায়
লাইফ ইজ বিউটিফুল দেখেছি আপু, দারুণ!
আমি কালকে দেখলাম টেক ওয়ান আর অপুর পাঁচালী। এক কথায় দারুন!
টেকওয়ানটা আমার দেখা হলো কিছুদিন আগে, মৈনাক ভৌমিকের মুভি আরো ভালো হয়। তাও যা হয়েছে মন্দ না। আর অপুর পাঁচালী তো দারুন, ক্লাস এক্টিং, অসাধারণ ডিরেকশন, সত্যজিতের সেই অপুর ট্রিলোজীর দুর্দান্ত মিউজিক নতুন করে ফিরিয়ে আনা!
অপুর পাঁচালি মনোমুগ্ধকর।
এবির কোন লেখাই সাধারনত না পড়া থাকেনা।
তবুও কিনা আমাকে নিবেদন করা লেখাই এত দেরি তে পড়লাম,
মন একই সাথে ভালো এবং খারাপ হয়ে গেল!
বম্বে টকিজ দেখে ফেলব, ভালো প্রিন্ট হাতে পেলেই।
দেখছো নাকি? মনে করায় দিলাম
ভালো প্রিন্ট পাইনাই।
মন্তব্য করুন